
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতায় নতুন বিধান যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আর তা হলো-কোনো আদালত কাউকে ফেরারি ঘোষণা করলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন। ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’র (আরপিও) ১২ অনুচ্ছেদের (১) উপদফায় এই বিধান যুক্ত করে সংসদ নির্বাচনের প্রধান এই আইনের খসড়া মঙ্গলবার চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে ইসি। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত নির্বাচনগুলোতে সাজাপ্রাপ্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য হতেন। নতুন এই বিধান কার্যকর হলে মামলার রায় ঘোষণার আগে শুনানিতে অনুপস্থিতির দায়ে আদালত কাউকে পলাতক ঘোষণা করলে তিনি আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা হারাবেন। খসড়া আইনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের বিধানও তুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রার্থী বা তার প্রস্তাবকারী/সমর্থনকারীকে সশরীরে রিটার্নিং বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এসব বিধান কার্যকর হলেই আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়বেন বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের অভিমত-সারা দেশে দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মামলা চলমান। আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী দীর্ঘদিন ওইসব মামলায় হাজির না হওয়ার কারণে আদালত তাদের ফেরারি ঘোষণা করছেন। ফলে এসব নেতাকর্মী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অর্থ পাচারসহ অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধের মামলায় আদালত কর্তৃক ফেরারি হলে তারাও নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা নেই, কিন্তু রোষানলে পড়ার আতঙ্কে পলাতক রয়েছেন। তাদেরও অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার এতদিন যে সুযোগ ছিল, সেই পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন দফায় দফায় বৈঠকের পর মঙ্গলবার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) খসড়া চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। চূড়ান্ত খসড়ায় এসব বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে এই বিধান যুক্তের সুপারিশ ছিল। সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আদালত কর্তৃক ফেরারি আসামিরা নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার বিধান রয়েছে। এবার তা সংসদ নির্বাচনের আইনে যুক্ত করা হচ্ছে। যদিও ফেরারি আসামিকে ভোটে অযোগ্য ঘোষণার বিধান অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে-নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন এক চিঠিতে এমন মন্তব্য করেছিল। এখন কমিশন নিজেই ওই বিধান আইনে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিল।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আরপিও খসড়া চূড়ান্ত করেছি। এটি অধ্যাদেশ হিসাবে জারি করতে আইন মন্ত্রণালয়ে চলে যাওয়ার কথা। তিনি বলেন, আদালত কর্তৃক ফেরারিরা নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার বিধান আমাদের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে রেখেছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিধানের অপব্যবহার হতে পারে, সেই শঙ্কা থেকে ইসি তখন চিঠি দিয়েছিল। এখন আমরা সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করে এখন ফেরারি আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য করার কথা বলেছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমার সুযোগ বাতিলের প্রস্তাব করেছি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির সিংহভাগ কেন্দ্রীয় নেতা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান। নিয়ম অনুযায়ী, মামলা চলমান অবস্থায় আসামিরা ইচ্ছাকৃতভাবে আত্মগোপনে থাকলে আদালত নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তাদের পলাতক ঘোষণা করে থাকেন। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানাসহ অনেকের বিরুদ্ধে আদালতে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।
ফেরারি আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য করার বিধানের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিক রয়েছে বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইনে এই বিধান আগ থেকেই রয়েছে। যিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অযোগ্য, তিনি কীভাবে সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হবেন? এছাড়াও এ বিধানের আরও অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। তবে প্রশাসন ও পুলিশের ওপর দলীয় প্রভাব খাটানো হলে বা প্রভাবিত করা হলে অনেকেই হয়রানির শিকার হতে পারেন।
এছাড়া ইসির চূড়ান্ত করা আরপিওতে অন্তত ৪৫টি সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে সেখানে ‘না’ ভোট; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং কোস্টগার্ড যুক্ত করা; হলফনামায় দেশের ও বিদেশে থাকা সম্পদ উল্লেখ করা এবং অসত্য তথ্য দিলে নির্বাচনের পর সংসদ-সদস্য পদ বাতিল করা; নির্বাচনি জামানত ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ; জোটভুক্ত প্রার্থীরা নিজ দলীয় প্রতীকে ভোট করা; প্রার্থীর নিজ নির্বাচনি এলাকার ভোটারকে এজেন্ট ও পোলিং এজেন্ট নিয়োগ এবং পুরো সংসদীয় আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ইসির হাতে ফিরিয়ে আনা। নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার সংক্রান্ত সব অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া হয়েছে। ইসির এই সংশোধনী বুধবার আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় তা অধ্যাদেশ জারি করতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তোলার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। অধ্যাদেশ জারির পরই নতুন বিধান কার্যকর হবে।
বহিরাগতরা নির্বাচনি এজেন্ট হওয়ার পথ বন্ধ : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর নির্বাচনি এলাকার ভোটারকে নির্বাচনি এজেন্ট নিয়োগ করার বিধান যুক্তের প্রস্তাব করেছে ইসি। সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে যে কোনো ব্যক্তিকে নির্বাচনি এজেন্ট নিয়োগ দিতে পারতেন প্রার্থীরা। এখন ওই নির্বাচনি এলাকার ভোটার হতে হবে-এমন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। ফলে বহিরাগতরা নির্বাচনি এজেন্ট হতে পারবেন না।
কারাগারে আটক ব্যক্তিরা ভোট দিতে পারবেন : প্রস্তাবিত আরপিওর ২৭ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিজীবী ও কারাগারে আটক ব্যক্তিদের ভোটাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পোস্টাল ব্যালটে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যারা ভোটার এলাকা ছাড়া অন্য কোনো এলাকায় চাকরি বা সরকারি দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত আছেন, তারা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। এছাড়া কারাগারে আটক বা আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিরাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। আর পোস্টাল ব্যালটে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের আগের সুযোগও রয়েছে।
এআইর অপব্যবহারে দণ্ড : আরপিওর ৭৩ অনুচ্ছেদে নির্বাচনে তফশিল ঘোষণা থেকে ফলাফল পর্যন্ত প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বা নির্বাচনি ফলাফল প্রভাবিত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহার করে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য, ছবি, ভিডিও, অডিও প্রচার করা হলে তা অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবে।