Image description
বিলম্বিত বোধোদয় থেকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত

ফ্যাসিবাদবিরোধী জুলাই ঐক্যে ফাটলের সুযোগে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা হয়েছে। এমন বিলম্বিত বোধোদয় থেকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ সবকটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিগুলো এখন এক কাতারভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই অংশ হিসাবে শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির সংহতি সমাবেশ হতে যাচ্ছে। যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন জানান, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ফ্যাসিবাদ ঠেকানোর প্রশ্নে সবাইকে মনেপ্রাণে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কেউ কেউ বলেন, নির্বাচনের প্রশ্নে আমরা জনসমর্থন আদায়ের জন্য যে যার দলের নীতি, আদর্শ ও লক্ষ্য অনুযায়ী বক্তব্য দিতে পারি, কিন্তু তা যেন আমাদের মধ্যে চরম বিরোধ সৃষ্টি এবং পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট না করে।

এদিকে বিশ্লেষকরাও রাজনীতিবিদদের এমন বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, দেশ ও জনস্বার্থে গণতন্ত্রকামী নির্বাচনমুখী সব দলকে দৃশ্যমানভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তা না হলে ফ্যাসিবাদী শক্তি আরও শক্তি সঞ্চয় করে মাঠে নামার সাহস দেখাবে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা, জাতীয় নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র, হঠাৎ করে পতিত আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ঝটিকা মিছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতাসহ নানা ইস্যুতে দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এমন প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। রোববার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং মঙ্গলবার আরও সাতটি দলের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা প্রতিটি দলকে বিশেষ একটি বার্তা দেন। এতে বলা হয়, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কেউ যদি নির্বাচনের বিকল্প নিয়ে ভাবেন, সেটা হবে জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক। ফলে নির্বাচন পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পৌঁছাতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিকে ফ্যাসিবাদবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এ ঐক্য জনগণের সামনে দৃশ্যমান রাখার জন্য তিনি আহ্বান জানান।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে এমন বার্তা পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসে রাজনৈতিক দলগুলো। সোমবার গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ২৩টি দল বৈঠক করে। সেখানে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন নেতারা। একই দিন বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গুলশানের কার্যালয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এনসিপির নেতারা। যা রাজনীতিতে ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি করে। এই দুই ঘটনাকে ঐক্যের বার্তা হিসাবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা ও নুরের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে, ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার। এবং তা দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থেকেই করতে হবে। দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো অপশক্তি দেশে ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবে না। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও হবে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা পরস্পর তর্ক-বিতর্ক করব এবং ভিন্নমত পোষণ করব। কিন্তু সৌহার্দমূলক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা চালু থাকবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে হবে। এটাকে শক্তিতে পরিণত করে আগামীদিনে আমরা গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটাব।’

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের যুগান্তরকে বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা ছিলাম, সব দলেরই নিজস্ব একটা পরিকল্পনা আছে। আছে রাজনীতি ও দর্শন। তবে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার প্রতিবাদে সব রাজনৈতিক দল একই প্ল্যাটফর্মে এসেছে, এটিই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। তিনি বলেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য জরুরি এবং সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হবে না। সংহতি সমাবেশ প্রসঙ্গে বলেন, এটিকে আমরা ইতিবাচক হিসাবে দেখছি। জাতীয় সংকটে রাজনৈতিক প্রয়োজনে আমরা পাশাপাশি আছি, এটিই বড় বার্তা।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিবাদের দোসর হিসাবে জাতীয় পার্টি, ১৪ দল এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী সব ইস্যুতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ সবাই এক। শুধু পরবর্তী নির্বাচনের পদ্ধতি কিংবা জুলাই সনদের কিছু ধারার বিষয়ে কিছু দ্বিমত তৈরি হয়েছে। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এসব বিষয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে, পক্ষে-বিপক্ষে কঠোর সমালোচনাও থাকতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক ছাড়া কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব নয়। তিনি জানান, ফ্যাসিবাদবিরোধী যে ঐক্য ছিল, তা এখনো আছে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় নেই।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান যুগান্তরকে বলেন, ‘সোমবার বৈঠকে যারা ছিলেন তারা সবাই বলেছেন, আমাদের ভেতরে যে ধরনের বাক্যবিনিময় হয়েছে, বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে এটা দৃশ্যমান হওয়ার কারণে ফ্যাসিবাদীরা সুযোগ পেয়েছে। সেটা প্রশাসনের মাধ্যমে বলেন কিংবা প্রশাসনের বাইরে থেকে। তবে সময়ের প্রয়োজনে এখন সবাইকে এক হওয়া দরকার।’ তিনি বলেন, ‘সবার মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার উপলব্ধি ফিরে এসেছে। এজন্য এখন থেকে অন্তত বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সহনশীল হওয়াসহ সবার প্রতি সম্মান থাকা উচিত।’

শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির সংহতি সমাবেশ করার কথা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আলটিমেটলি ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হলে লাভটা কার? আওয়ামী লীগ ছাড়া কারও লাভ আছে বলে আমি মনে করি না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ভিপি নুরের ওপর হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষত ধরতে পেরেছে। যদিও অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। এখন ভালোভাবে নির্বাচনে পৌঁছাতে সবাইকে মনেপ্রাণে ও বাস্তবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকুক। কিন্তু বক্তব্য দিয়ে যেন কেউ কাউকে আঘাত না করি। তিনি বলেন, শুধু মুখে মুখে ঐক্য টেকসই হবে না। ফ্যাসিবাদবিরোধী প্ল্যাটফর্মগুলো ঠিক করতে হবে। জুলাই ঐক্য এমনভাবে দৃশ্যমান হতে হবে যেন ফ্যাসিবাদী শক্তি আওয়ামী লীগ স্বপ্নের মধ্যেও কোনো কিছু করার চিন্তা না করে।