
ইসরাইলের সম্প্রচারমাধ্যম চ্যানেল-১২ সম্প্রতি ইসরাইলের সাবেক সামরিক গোয়েন্দা (আমান) প্রধান মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আহারুন হালিভার ফাঁস হওয়া একটি রেকর্ডিং সম্প্রচার করেছে। সেখানে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার জন্য যে কজন ইসরাইলি মারা গিয়েছিলেন, তাদের একজনের বদলে ৫০ ফিলিস্তিনিকে মরতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
শনিবার তুরস্কভিত্তিক গণমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য বলা হয়েছে।
ওই অডিওতে এই ইসরাইলি সেনা কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, “৭ অক্টোবরের ঘটনায় যত মানুষ মারা গেছে, তাদের প্রত্যেকের বদলে ৫০ ফিলিস্তিনিকে অবশ্যই মরতে হবে।” এই গণহত্যা ‘ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য’ প্রয়োজনীয় বলেও উল্লেখ করেন এ দখলদার।
হালিভা তার বক্তব্যে ১৯৪৮ সালের নাকবার উল্লেখ করে বলেন, ফিলিস্তিনিদের ওপর গণবিধ্বংসী নীতি প্রয়োগ না করলে ভবিষ্যতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তিনি আরও শিন বেত এবং প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেন।
হালিভা ছিলেন ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দা শাখার (আমান) প্রধান। ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের আকস্মিক হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার দায় নিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। হামাসের সেই হামলায় অন্তত ১ হাজার ১৯৫ জন নিহত হয়, যদিও প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে।
তার ভাষায়, ‘কোনো বিকল্প নেই, ফিলিস্তিনিদের বারবার নাকবার মুখোমুখি হতে হবে। যাতে তারা (ইসরাইলে হামলার) পরিণতি বোঝে।’ তিনি আরও দাবি করেন, ‘আমি প্রতিশোধের কথা বলছি না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি বার্তা পৌঁছাতে চাই।’ গাজাকে তিনি আখ্যা দেন ‘এক বিকারগ্রস্ত এলাকা’ হিসেবে।
নাকবা শব্দটির অর্থ আরবিতে হলো ‘মহাবিপর্যয়’ বা ‘মহাদুর্যোগ।’ ফিলিস্তিনি জনগণের ইতিহাসে এটি এক বিশেষ ঘটনা। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় জায়নবাদী মিলিশিয়ারা পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনিদের গ্রাম, শহর ও ঘরবাড়ি আক্রমণ করে। তখন প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ হয় এবং শরণার্থী হতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি প্রায় ৫০০ টির বেশি ফিলিস্তিনি গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়া হয়, যাতে তারা আর ফিরে আসতে না পারে।
এই ঘটনাকেই ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বলে উল্লেখ করেন। তারা প্রতিবছর ১৫ মে তারিখে নাকবা দিবস পালন করেন। কারণ ১৪ মে ১৯৪৮ তারিখে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার পরের দিন থেকেই ফিলিস্তিনিদের জন্য শুরু হয় এই মহাদুর্যোগ।
সংক্ষেপে, নাকবা মানে হলো ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের ভূমি হারানো, গণহত্যা ও বাস্তুচ্যুতির সেই ভয়াবহ ইতিহাস, যার প্রভাব এখনো বহমান।
অডিওতে হালিভা আরও চাঞ্চল্যকর দাবি করেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে পশ্চিম তীরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে যাতে হামাস সেখানে প্রভাব বিস্তার করে। তার মতে, ‘যদি পুরো ফিলিস্তিনি সমাজই অস্থিতিশীল হয়ে যায়, তবে কোনো আলোচনার সুযোগ থাকবে না। তখন আর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না।’
হালিভার এই মন্তব্যের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো একজন জ্যেষ্ঠ ইসরাইলি ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে এমন চরমপন্থী বক্তব্য প্রচারিত হলো, যা গাজায় ফিলিস্তিনি গণহত্যার নৃশংসতাকে উন্মোচিত করেছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এটি গাজায় চলমান যুদ্ধকে “নীতিগত গণহত্যা” হিসেবে প্রমাণ করে।
উল্লেখ্য, দখলদার ইসরাইলের টানা অভিযানে গাজায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৬১ হাজার ৯০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বড় অংশই নারী ও শিশু।