
সম্প্রতি ইহুদিবাদী ইসরায়েলের কিছু চাঞ্চল্যকর গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের মাধ্যমে ইরান একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—‘আমরা সব দেখি। তোমাদের পাইলটদের চিনি।
তোমাদের বাঙ্কার চিহ্নিত। তোমাদের সাইবার করিডোরে আমরা হাঁটছি। হয়তো তোমরা ভাবছো, কেউ কিছু বুঝছে না। ’
ইসরায়েলি আগ্রাসন, নিষ্ক্রিয় ইরানের প্রতিরক্ষা
ইহুদিবাদী ইসরায়েল গত ২৩ জুন তেহরানসহ ইরানের বিভিন্ন শহরে হামলা চালায়, যাতে শহীদ হন বহু সামরিক কমান্ডার, পরমাণু বিজ্ঞানী ও বেসামরিক নাগরিক। নিহতদের মধ্যে ছিলেন, সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরি, আইআরজিসির প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি, আইআরজিসির মহাকাশ শাখার প্রধান জেনারেল আমির আলি হাজিজাদেহ, পরমাণু বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি, ফারিদুন আব্বাসি প্রমুখ।
আকস্মিক এই হামলার ঘটনায় ইরানের গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কোনো বাধা ছাড়াই ইরানের বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে লক্ষ্য করে বোমা বর্ষণ করে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। সেসময় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। ৮ ঘণ্টা পর ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সচল হয় এবং প্রতিশোধ নিতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী শুরু করে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩’। সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনগুলো ইসরায়েলের বহু সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানে।
ইসরায়েলি পাইলটদের বাড়িতে হামলা
একটি রিপোর্টে বলা হয়, ইরানের পাল্টা হামলায় কেন্দ্রীয় ইসরায়েলের ইয়াভনে শহরে এক ইসরায়েলি পাইলটের বাসায় সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এ ছাড়া আরও কিছু পাইলটের বসতভিটাও ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানায় আসে। ১২ দিনের যুদ্ধে ইরান ১৫০টি লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে ২২ দফা হামলা চালায়।
১৯ জুন ইরান একটি নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র গুঁড়িয়ে দেয়, যা ছিল পাইলট প্রশিক্ষণ ও ড্রোন যুদ্ধ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই অভিযানে ইসরায়েলের মূল মোসাদ কেন্দ্র, সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স এবং অন্যান্য কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে সরাসরি ও নিখুঁত আঘাত হানা হয়।
মেজর ইয়েল অ্যাশ (বামে) এবং তার স্বামী প্রিন্স বার
পাইলটদের পরিচয় উন্মোচনের কৌশল
পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে ইরানের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এক নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছে। এই সাফল্যের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো—ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর বহু পাইলট ও কমান্ডারের পূর্ণাঙ্গ পরিচয়, তাদের আবাসন, দায়িত্বপূর্ণ ইউনিট এবং ইরানের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক হামলাগুলোর বিস্তারিত তথ্য ফাঁস করা।
যেসব ইসরায়েলি গণহত্যাকারী এতদিন ছায়ায় বসে অপারেশন চালাত, ইসলামি প্রজাতন্ত্র সেই অন্ধকারে আলো ফেলে দিয়েছে। কিন্তু ইরান শুধু পরিচয় প্রকাশেই থেমে থাকেনি। তারা জানে—এরা কারা, কোথায় থাকে, কীভাবে চলে—আর সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো, তারা ইতিমধ্যেই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর কিছু সদস্য থাকে—যে ইয়াভন শহরে, যা দখলকৃত ভূখণ্ডের গভীরে অবস্থিত—সেসব জায়গায় ইরানের নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।
এই হামলার কারণে এখন থেকে, প্রতিটি ইসরায়েলি সামরিক পাইলট যখন আরেকটি প্রাণঘাতী মিশনের প্রস্তুতি নেবে, তার মনে প্রশ্ন আসবে: ‘আমি কি ইতোমধ্যেই টার্গেট? আমার ঠিকানা কি চিনে ফেলেছে ওরা?’
ফাঁস হওয়া পরিচয় ও পটভূমি
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও বার্তা সংস্থাগুলো নিশ্চিত করেছে, ইরানি গোয়েন্দারা ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর বহু পাইলট, ড্রোন অপারেটর এবং উচ্চপদস্থ কমান্ডারদের বিস্তারিত তথ্য হাতে পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম—মেজর ইয়ায়েল অ্যাশ, যিনি স্কোয়াড্রন ১১৯-এর ডেপুটি কমান্ডার।
ইসরায়েলের ডানপন্থী সংবাদপত্র ‘ইসরায়েল হায়োম’ এই তথ্য ফাঁসকে একটি ‘গুরুতর ও বিপজ্জনক ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। পত্রিকাটি জানিয়েছে, শুধু ওই নারী পাইলটই নয়, তার স্বামী বার প্রিন্স ও তাদের সন্তানের ছবিও সম্প্রচার করেছে ইরানি গণমাধ্যম। এ ছাড়া, স্কোয়াড্রনের নম্বর, দায়িত্ব, এবং অপারেশনাল ঘাঁটির নামও প্রকাশ করা হয়েছে।
ইরানি গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ইয়ায়েল অ্যাশ হচ্ছেন ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে নিখোঁজ হওয়া ইসরায়েলি পাইলট মেজর শিমন অ্যাশের নাতনি।
‘তারা আর নিরাপদ নয়’
ইরানের এক সংবাদ চ্যানেলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই গোয়েন্দা সাফল্যের মধ্য দিয়ে ইরানি বাহিনী এখন কেবল সেই পাইলটের নাম নয়, বরং তাদের বসবাসের সঠিক স্থান, চলাফেরার পথ, এমনকি উপগ্রহ চিত্র সহকারে তাদের দৈনন্দিন রুটিন পর্যন্ত হাতে পেয়েছে।
এই পটভূমিতে চ্যানেলটি ব্যঙ্গ করে উল্লেখ করে—ইয়ায়েল অ্যাশ একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি চাই ইসরায়েলিদের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে। ’ জবাবে চ্যানেলটি বলেছে, ‘এখন তিনি নিজেই আর নিরাপদ নন। ’
ইসরায়েলি সামরিক দুনিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে একটি ‘অদৃশ্যতা ও অভেদ্যতা’র দেয়াল ছিল, বিশেষ করে যুদ্ধকালীন পাইলটদের পরিচয় অন্ধকারে রাখা হতো। এবার সেই দেয়াল চূর্ণ হয়ে গেছে।
ইসরায়েলি পাইলটদের সুরক্ষা বলয় চূর্ণ
ইরানি গণমাধ্যমের মতে, ফাঁসকৃত পরিচয়গুলো কেবল সামরিক স্তরে প্রতিশোধ নয়, বরং এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। ইসরায়েলি পাইলটরা, যারা এতদিন যুদ্ধবিমান চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করলেও অজ্ঞাত থেকে যেত, এখন তারা বিশ্বব্যাপী নজরদারির আওতায়।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি একধরনের ‘সাইকোলজিক্যাল শিফট’— যেখানে ইসরায়েলের আকাশ-নির্ভর আগ্রাসনের ওপর ছায়া পড়েছে।
ইরানের এক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেছেন, ‘এই তথ্য ফাঁস ভবিষ্যতের যেকোনো আগ্রাসনের আগেই ইসরায়েলের মনোবল ধসিয়ে দেবে। কারণ তাদের কেউ জানে না কবে তার নাম বা পরিবার টেলিভিশনে প্রকাশিত হবে। ’
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের দৃষ্টিতে, এটি শুধুমাত্র একটি তথ্য ফাঁস নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ মনস্তাত্ত্বিক ও গোয়েন্দা যুদ্ধের অংশ যেখানে ইসরায়েলের ‘অদৃশ্য উড়ন্ত ঘাতকদের’ সুরক্ষা বলয় চূর্ণ হয়ে গেছে।
ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর কয়েকজন নারী পাইলট
ইসরায়েলের ‘মানবিক ঢাল’ কৌশল ব্যর্থ
ইরানি মিডিয়া আরও দাবি করেছে, যখন ইসরায়েলি গোয়েন্দারা বুঝতে পারেন যে, পাইলটদের অবস্থান ফাঁস হয়ে গেছে, তখন অনেককে স্কুল ও হাসপাতালে সরিয়ে নেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল—যদি ভবিষ্যতে সেখানে হামলা হয়, তাহলে বিশ্বমঞ্চে ইরানকে ‘সিভিলিয়ান কিলার’ হিসেবে দোষারোপ করা যায়।
কিন্তু এই ছলচাতুরীও ইরানি গোয়েন্দাদের চোখ এড়ায়নি। ফলে এই ‘মানবিক ঢাল’ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।
মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ এখনও শেষ নয়
ইরান ও ইসরায়েলের চলমান সংঘাতের ইতিহাসে এই গোয়েন্দা সাফল্য এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইরানি গোয়েন্দারা জানিয়ে দিয়েছে—এখনো যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়নি, সেগুলো ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে। অর্থাৎ, এই মনস্তাত্ত্বিক ও তথ্যযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।
ইরান প্রমাণ করেছে—ইসরায়েলের তথাকথিত ‘অভেদ্য’ বিমানবাহিনী আর নিরাপদ নয়। পাইলটদের পরিচয়, মুখাবয়ব, ঘরবাড়ি—সবই এখন খোলা তথ্যভান্ডারে। এটি শুধু একটি গোয়েন্দা প্রতিশোধ নয়, এটি অস্তিত্বগত এক সংকেত: ‘উড়ন্ত ঘাতকরা’ এখন আর অদৃশ্য নয়।
ককপিটে নতুন সঙ্গী—‘ভয়’
ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলোর প্রতিটি ককপিটে এখন এক অদৃশ্য সঙ্গী—‘ভয়’, যা মনে করিয়ে দেয়: তারা নজরদারির আওতায়। এটি আর শুধু মনস্তাত্ত্বিক চাপ নয়, এটি অস্তিত্বগত সংকট।
‘আমার নাম কি ইরানের শাস্তির তালিকায় লেখা হয়েছে?’
এই প্রশ্নই এখন হয়তো ঘুরপাক খাবে ‘উড়ন্ত ঘাতকদের’ মনে, যখন তাদের আরেকটি আত্মঘাতী অভিযানে পাঠানো হবে। কারণ এটাই হলো আধুনিক অসম যুদ্ধের ন্যায়বিচার। বিমানবাহী রণতরী দরকার নেই। দরকার কেবল দৃষ্টি, সাহস আর আদর্শিক প্রতিশ্রুতি। ইরান এই তিনটি দিয়েই এক বিস্ময়কর কৌশলগত বিজয় অর্জন করেছে।