
এ বিষয়টি আজ সুপ্রমাণিত যে ইসরায়েল রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে এক ‘দুষ্টক্ষত’। ইসরায়েলের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ও কার্যকলাপ আরব বিশ্ব এমনকি সারাবিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এর জন্য দায়ী ইসরায়েল একা নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইসরায়েলকে আশকারা দিচ্ছে এবং অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থকড়ি দিয়ে সহায়তা দিচ্ছে।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা
আমরা যদি পেছনের দিকে ফিরে তাকাই দেখা যায় যে, যুক্তরাজ্যই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বালফোর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর জায়নবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে এক পত্রে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ইহুদি জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার কথা জানান। এটি পরবর্তীতে ‘বালফোর ঘোষণাপত্র’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বৃটিশদের অধীনে চলে যায়। যুক্তরাজ্যের ইন্ধন ও সম্মতিতে দলে দলে ইহুদিরা ইউরোপ ও অন্যান্য আরবদেশ থেকে ফিলিস্তিনে আসতে থাকে। ১৯৩৯-৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ও তদ্পূর্বে জার্মানিতে হিটলারের ইহুদি নিধন ইউরোপীয় জায়নবাদীদের ফিলিস্তিনে পাড়ি দিতে উদ্বুদ্ধ করে। হিটলারের শাসনামলে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি নিধন করা হয় যা ইতিহাসে ‘হলোকাস্ট’ হিসেবে স্বীকৃত। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গড়ার প্রশ্নে ঐক্যমতে উপনীত হয়। ১৯৪৭ সালে ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে দুইভাগ করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করেন।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরবদের প্রতিরোধ যুদ্ধ
রাষ্ট্র গঠনের পূর্ব থেকেই জায়নবাদীরা প্ল্যান দালেত বা প্ল্যান ‘ডি’ পরিকল্পনা অনুসরণ করে। প্ল্যান ডি ছিল হত্যা-ধর্ষন-লুটতরাজ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ বা নিশ্চিহ্ন করা। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রগঠনের সময় প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ সংঘটিত হয় যাকে ইসরায়েল তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে মনে করে। ঐ যুদ্ধে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত ৭ লাখ এবং পরবর্তীতৈ আরো ৩ লাখ অর্থাৎ প্রায় দশ লাখ ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এরা প্রতিবেশী জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। এরা আর কখনো নিজ দেশে ফিরে আসতে পারেননি। ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পরের দিন অর্থাৎ ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা নাকাবা বা ‘দুর্ভোগ’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং প্রতিবছর এ দিবস পালন করে।
প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে কয়েকটি আরব দেশ যেমন সিরিয়া, মিশর, লেবানন, ইরাক ও জর্ডান অপরিকল্পিত ও বিচ্ছিন্নভাবে তাদের সৈন্য প্রেরণ করে। জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ ইসরায়েলের প্রধান মন্ত্রী বেন গুরিয়ানের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করেন। ফলে যুদ্ধে ইসরায়েল জয় লাভ করে।
১৯৫৬ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল মিশর আক্রমণ করে । এ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল গাজা, রাফাহ ও আল আরিশ দখল করে। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের আবর-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনী গোলান উপত্যকা, পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর দখলে নেয়।
ইসরায়েলের দখলদারি মনোভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো বরাবরই মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এরা ইসরায়েলকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিচ্ছে অবিরত। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে হত্যাযজ্ঞ চালালেও ২০১৬ সালে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রতি বছর ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে। এক হিসেবে প্রকাশ, ১৯৪৮ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
ফিলিস্তিন সংকটে ভূমিকা রাখার জন্য ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ১৯৬৯ সালে ওআইসি (অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন) গঠিত হয়। ৫৭ টি মুসলিম দেশ নিয়ে গঠিত ওআইসির এ যাবত সাফল্য খুবই সীমিত। ইসরায়েলের আগ্রাসন, গণহত্যা বিভিন্ন আরব দেশে নির্বিচার বোমা বর্ষণ, স্থাপনা ধ্বংসকরণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে ওআইসি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। ওআইসি গঠনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের দখল থেকে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার। কিন্তু এ ব্যাপারে এ প্রতিষ্ঠানের কোনো সাফল্য নেই। ফিলিস্তিনের দুর্দিনে ওআইসি কখনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এর কারণ হলো আরব দেশসহ বহু মুসলিম দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনা রয়েছে এবং/অথবা ব্যবসায়িক সুসম্পর্ক রয়েছে। এরা যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়তে চায়না। ১৯৮১ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘ফিলিস্তিন স্বাধীন হোক এটা আরব দেশগুলোই চায়না। কারণ ফিলিস্তিন স্বাধীন হলে এদেশ শিক্ষিত ও শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হবে যা আরব দেশগুলোর ঈর্ষার কারণ। ফিলিস্তিন সংকটে আরব দেশগুলো শুধু লিপ সার্ভিস দেয়, কার্যত কিছু করেনা’।
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) নেতা ইয়াসির আরাফাতের সময়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সমর্থন এবং ইসরায়েলের আগ্রাসন, অত্যাচার এবং নির্বিচার হত্যার বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বসহ অন্যান্য দেশে ফিলিস্তিনের পক্ষে জনমত গঠন বিশেষ মাত্রা পেয়েছিল। এছাড়া ফিলিস্তিনিদের বিভিন্ন সংগঠন যেমন হামাস, ফাত্তাহ প্রমুখ ঐক্যবদ্ধ ছিল। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধি পর্যবেক্ষক হিসেবে স্থান পায়। নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বেশ ক’টি নিন্দা প্রস্তাব ও যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। অবশ্য সেগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রয়োগে পাশ হতে পারেনি। ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনের মুসলমানরা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৯৭৩ সালের আরব ইসরায়েল যুদ্ধে (যা ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ নামে খ্যাত) মিশর সিনাই এবং গোলান হাইটস পুনর্দখল করে। সিরিয়াও এর সীমান্তবর্তী কিছু ইসরায়েল অধিকৃত এলাকা ফিরে পায়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের লজ্জাজনক পরাজয়ের পর ১৯৭৩ সালের যুদ্ধটি ছিল আরব দেশগুলোর জন্য অনেকটা স্বস্তিদায়ক। এই যুদ্ধের পরবর্তী আলাপ আলোচনা শান্তি প্রক্রিয়ায় সুদূরপ্রসারী ফল বয়ে আনে। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও ইসরায়েল ‘ক্যাম্প ডেভিড’ শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং প্রথম আরব দেশ হিসেবে মিশর ইসরায়েল কে স্বীকৃতি প্রদান করে। ক্যাম্প ডেভিড শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী নেতৃবৃন্দ ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাহেম বেগিন।
১৯৮২ সালে ইসরায়েল কর্তৃক লেবানন আক্রমণ ছিল মূলতঃ ‘পিএলও’ এর বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষে বহু হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়। পিএলও’র সাথে লেবানন ও সিরিয়ার সেনাবাহিনীও যুদ্ধে যোগ দেয়। ৬ জুন ১৯৮২ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় ২০ হাজার সেনা সদস্য ও সাধারণ মানুষ নিহত হয় এবং ৩০ হাজার জন আহত হন। এ যুদ্ধের ফলে লেবানন থেকে পিএলও কে সরে যেতে হয়েছে। ইসরায়েল বৈরুত দখল করে লেবাননে তাদের অনুগত খ্রিষ্টান সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ১৯৮৫ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে লেবানন থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয় যা ২০০০ সালে সমাপ্ত হয়। ইতোমধ্যে লেবাননে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের পক্ষে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লা গ্রুপের উত্থান হয় যারা লেবাননে ইসরায়েলি সেনাদের উপর গেরিলা অপারেশন চালায়।
ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন বিরোধে কখনো আরবদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে উঠেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশসমূহের সাহায়তায় পরবর্তীতে বেশ ক’টি ‘শান্তি চুক্তির’ মাধ্যমে মিশর, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও কাতারের সাথে ইসরায়েলের কুটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এসব ‘শান্তি চুক্তি’ কিংবা আরব রাষ্ট্র সমূহের সাথে ইসরায়েলের কুটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কিংবা ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনে আগ্রাসন, নির্যাতন ও গণহত্যা বন্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ওয়াশিংটন ডিসিতে স্বাক্ষরিত ‘আব্রাহাম চুক্তি’র ফলে বাহরাইন ও ইউএই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়।
দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান
ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বেই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৪৭ সালে প্যালেস্টাইন ভাগ করে দু’টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবে ৬০ শতাংশ ভূমি মুসলিম রাষ্ট্রের অধীন রাখা হয়, ফিলিস্তিনি মুসলমানগণ এ প্রস্তাব মেনে নেয়নি। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকে পূর্ব জেরুজালেম (পশ্চিম তীর) ও গাজা কার্যত ইসরায়েলের সামরিক দখলে চলে যায়। ১৯৮২ সালে পিএলও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান এ শর্তে মেনে নেয় যে, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হবে। অবশ্য হামাস ২০১৭ সালে ঘোষণা করে যে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পূর্বের সীমানা নিয়ে দু’টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। ইসরায়েল প্রাথমিক পর্যায়ে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয়। মূলত: ২০০৬-০৮ এবং ২০১৩-১৪ সালের আরব শান্তি আলোচনা এ দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হয়। কিন্তু বর্তমানে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ -এটি চাইলেও ইসরায়েল আর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা চায়না। বিগত প্রায় ৭৫ বছরে বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে তার ভৌগলিক আয়তন সম্প্রসারিত করেছে।
ফিলিস্তিনের মুসলমানরা তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পুণরুদ্বারের জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর হাতে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
চলমান আরব ইসরায়েল যুদ্ধ
গত ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের অন্যতম যুদ্ধবাহিনী হামাস ইসরায়েলের উপর মিসাইল নিক্ষেপসহ অতর্কিত সশস্ত্র আক্রমণ করে। এতে ইসরায়েলের প্রায় ১২০০ লোক নিহত এবং ২৪০ জন পণবন্দি হয়। এর প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনের গাজা, রাফাসহ অন্যান্য অঞ্চলে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। গত ২১ মাসের যুদ্ধে ফিলিস্তিনে সরকারি হিসাব প্রায় ৬০ হাজার লোক নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে নারী ও শিশুই বেশি। আহত লক্ষ্যাধিক। তবে এ হিসাব সঠিক নয়। বাস্তবে হতাহতের সংখ্যা আরো কয়েক গুণ বেশি। ইসরায়েলের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু শুধু সামরিক স্থাপনা বা হামাস নিশ্চিহ্নকরণ নয়,বরং ফিলিস্তিন মুসলমানদের নির্মূল করা। সেজন্য ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র প্রভৃতিতেও বোমা ফেলে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। হাজার হাজার টন বোমা ফেলে, সবরকম মারণাস্ত্র ব্যবহার করে গাজা ও রাফা এলাকা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। খাদ্য ও ত্রাণের অভাবে অনাহারে মারা যাচ্ছে বহু লোক। অপুষ্টিতে, অনাহারে মৃত্যুর মুখোমুখি আরো প্রায় ৬০ হাজার শিশু।
ইসরায়েলের এ আগ্রাসনে প্রত্যক্ষভাবে মদদ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলমান যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। কিন্তু ঘটছে তার বিপরীত। তিনি সকল ফিলিস্তিনিকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানসহ অন্যান্য দেশে আশ্রয় দিতে প্রস্তাব করেন। ফিলিস্তিন দখল করে আমেরিকা সেখানে উন্নয়ন ও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলবে।
বিভিন্ন পক্ষের উদ্যোগ ও মধ্যস্থতায় গত ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ গাজার মুক্তিকামী সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয়। ফিলিস্তিনিরা তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ি ঘরে ফিরে তাঁবু খাটিয়ে বসবাস শুরু করে। জাতিসংঘও বিভিন্ন দেশের সহায়তায় ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু যুদ্ধ বিরতির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরুর পূর্ব মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজাসহ অন্যান্য এলাকায় তীব্র আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। ইসরায়েল কখনো আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান কিংবা যুদ্ধবিরতি চুক্তির তোয়াক্কা করেনি। মার্চ মাসে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী গাজায় যে লিফলেট ফেলে তাতে লেখা ছিল- গাজার সব মানুষ যদি মাটির সঙ্গেও মিশে যায়, তাতে দুনিয়ার কিছু বদলাবে না। কেউ তোমাদের নিয়ে ভাববেনা, কেউ তোমাদের ব্যাপারে জানতে চাইবে না।
নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) মানবতা বিরোধী অপরাধ করার কারণে ২০২৪ সলের নভেম্বরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। কিন্তু তা শুধু কাগজে কলমে। এর কোনো বাস্তব প্রতিফলন নেই। আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞদের মতে ইসরায়েলের আক্রমণে হামাসের প্রায় ৯৫ শতাংশ ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হামাসের প্রধান নেতা ইসমাইল হানিয়া নিহত হলে তারা আর একজনকে নেতা নিযুক্ত করে। তিনিও ইসরায়েলি আক্রমণে নিহত হন। এবারের আক্রমণের লক্ষ্য শুধু হামাস নিশ্চিহ্নকরণই নয়, ইসরায়েল নিরীহ জনগণ, তাঁবুতে আশ্রয় নেওয়া নারী ও শিশুদেরও হত্যা করছে। জাতিসংঘের ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ করে দিয়ে তাদের অনাহারে মারছে। তাদের আক্রমণে ডাক্তার, সাংবাদিক এমনকি বিদেশি ত্রাণসহায়তাকারীরাও রক্ষা পাচ্ছে না। জাতিসংঘকে সীমিত আকারে ত্রাণ দিতে অনুমতি দেয়ার পর ত্রাণ নিতে আসা অসহায় মানুষকে পাখির মত গুলি করে হত্যা করছে। এটিকে জাতিগত নিধন ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে ! ইসরায়েলের গণহত্যার ব্যাপারে ইসরায়েলি বিবেকবান মানুষও সোচ্চার হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বলেছেন, ‘গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধ করছে। হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি মারা যাচ্ছেন, সেইসাথে ইসরায়েলের অনেক সেনাও মারা পড়ছেন’। ইসরায়েলের ডেমোক্র্যাট দলের প্রধান ও সেনাবাহিনীর সাবেক ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ইয়াইর গোলান বলেন, ‘একটি সুস্থ দেশ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনা’। ইসরায়েলের হারেৎজ পত্রিকায় গত ২৭ জুনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত মৃতের সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। অক্টোবর ২০২৩ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ইসরায়েল আগ্রাসনে গাজায় ১ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ সংখ্যা ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশের সমান। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক ও গবেষক মাইকেল স্পাগাট বলেন, ‘একুশ শতকে মৃত্যুর এমন হার আর কোনো সংঘাতে দেখা যায়নি’।
শুধু ফিলিস্তিন নয়, অন্যান্য আরব দেশকেও আক্রমণ করে তাদের দুর্বল করার চেষ্টা করছে ইসরায়েল। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের পতনের পর সিরিয়া আক্রমণ করে বিমান বন্দর, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যুদ্ধবিমাণ ও অন্যান্য কৌশলগত সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করে ধ্বংস করে দেয়। হিজবুল্লাহ নিধনের অজুহাতে ইসরায়েল গত ১৪ মাস ধরে লেবাননে হামলা করে সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা ধ্বংস করছে। লেবাননে প্রায় এক হাজার জন সামরিক বেসামরিক লোক নিহত হন। ইরানে আক্রমণ চালিয়ে হিজবুল্লাহর প্রধান নেতাকে হত্যা করে। ইয়েমেনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে বন্দর, সামরিক স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস করে ।
গত এপ্রিলে (২০২৫) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ইরানের সাথে পারমাণবিক আলোচনা শুরু করে তখন ১৩ জুন ইসরায়েল অতর্কিত বিমান হামলা চালায়। এ হামলায় ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা সমূহকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। আক্রমণের প্রথম অবস্থায়ই ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও ৬ জন পরমাণু বিজ্ঞানীসহ বহু লোক নিহত হয়। এর পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে ইরান ইসরায়েলের দিকে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান যে, ইসরায়েলের আক্রমণ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। আমেরিকান স্থাপনায় যাতে ইরান হামলা না করে সে ব্যাপারে ইরানকে অনুরোধ করেন। আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে উভয় দেশের সামরিক স্থাপনা সরকারি - বেসরকারি অবকাঠামো, বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় প্রভূত ক্ষতি হয়। এর আগে ২০২৪ সালের এপ্রিল ও অক্টোবরে ইসরায়েল দুই দফা আক্রমণ করে ইরানের সামরিক সক্ষমতার ক্ষতি করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মিত্ররা বলেছিল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতার ক্ষতি করাই এসব আক্রমণের লক্ষ্য। ইসরায়েল দাবি করে ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংস এবং ইরানের সরকার পরিবর্তনই তাদের আক্রমণের লক্ষ্য। কিন্তু প্রতি আক্রমণে ইরান শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও সহস্রাধিক ড্রোন নিক্ষেপ করে ইসরায়েলকে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। ইরান সমর্থিত ইয়েমেন হুতি বিদ্রোহীরাও ইসরায়েলে বেশ কিছু মিসাইল আক্রমণ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে নিরপেক্ষতার কথা বললেও ক’দিন বাদেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলের পক্ষ হয়ে ইরানকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং ইরানের ধর্মীয় প্রধান নেতা আলি খামেনিকে হত্যার হুমকি দেন। এ পর্যায়ে যুদ্ধের নবম দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে আসা অত্যাধুনিক স্টীলথ যুদ্ধ বিমাণ আক্রমণ করে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। জবাবে ইরানও কাতারস্থ মার্কিন সামরিক ঘাটিতে মিসাইল নিক্ষেপ করে। ১২ দিনের যুদ্ধের পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধ-বিরতিতে সম্মত হয়। ইসরায়েলকে রক্ষা করতে গিয়ে আমেরিকা তাৎক্ষণিক প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়েছে বলে সমর বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
ইরান ইসরায়েল যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিনে একতরফা যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলের সামরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলে। ইসরায়েলের ২০২৫ সালের সামরিক বাজেট ইরান ও ফিলিস্তিন যুদ্ধে নিংশেষ হয়ে গেছে। ইরান ইসরায়েলের দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম-এ আঘাত করে এটি সাময়িক অকার্যকর করে ফেলে। এছাড়া বহু গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, ব্যবসাকেন্দ্র, সামরিক ও সরকারি স্থাপনা, বেসরকারি বাড়িঘরও ধ্বংস হয়ে যায়। দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়েছে। উৎপাদন ও সরবরাহ কমে গেছে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। অনেক শান্তিপ্রিয় ইসরায়েলি ইউরোপ ও আমেরিকায় চলে যাচ্ছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইসরায়েলের আগ্রাসী আক্রমণে ইরান ও ফিলিস্তিনিদের ‘সহানুভূতি জ্ঞাপন’ ও উদ্বেগ প্রকাশ করলেও আরব দেশগুলো কার্যত: নিষ্ক্রিয় ছিল। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমার ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল মাখো সহ ইউরোপীয় দেশের সরকার প্রধানগণ গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা করেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধের হুমকি দেয়।
আপাতত: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধ হলেও ইসরায়েল ফিলিস্তিনি মুসলমান নিধন পুরোদমে অব্যfহত রেখেছে। প্রতিদিনই তাদের আক্রমণ, বোমাবর্ষণ ও গুলিবর্ষণে ৫০ থেকে ২০০ জন ফিলিস্তিনি মারা পড়ছে। প্রায় ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশে উদ্বাস্তু হয়েছে। এপ্রিলে (২০২৫) আল জাজিরার খবরে প্রকাশ ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে ১৭ মাসে মা-বাবা হারিয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার শিশু এতিম হয়েছে। আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এতিমখানায় পরিণত হয়েছে গাজা।
একটি আন্তর্জাতিক সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ১৩ জুন পর্যন্ত, ইসরায়েল গাজা ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরানে প্রায় ৩৫ হাজার হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে সুপরিকল্পিতভাবে মানুষ হত্যা ও সম্পত্তি ধ্বংস করেছে। গাজার ৮৫ শতাংশ এলাকাই ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে।
গত ৭ জুলাই ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউজে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন ‘শপথ করেছি, কখনোই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হতে দেবনা’। আলজাজিরা জানায় নেতানিয়াহু আরো বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের নিজেদের শাসন করার অধিকার থাকা উচিত। তবে সামগ্রিক নিরাপত্তাসহ সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে ইসরায়েলের হাতে’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহী নন বলে মনে হচ্ছে। হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প-নেতানিয়াহু বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সাথে আলাপের সময় ট্রাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হয় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তার ভাবনা কী? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না’।
শেষ কথা:
ফিলিস্তিনে আর একটি যুদ্ধ বিরতি ও ইসরায়েলের জিম্মিদের মুক্তির ব্যাপারে কুটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। জিম্মিদের মুক্ত করতে পারলেই কি ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধ করবে? অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ত মনে হয় না। পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলকে অর্থকড়ি, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও আধুনিক সব যুদ্ধ-বিমান, মারণাস্ত্র, সরঞ্জাম ইত্যাদি সরবরাহ করছে। ফলে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। ইসরায়েল পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ আক্রমণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের মিত্ররা ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ায়। তারা বলে, ‘ইসরায়েলেরও অত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে’। ইরানের পারমাণবিক শক্তি অর্জনে আমেরিকার গাত্রদাহ হলেও ইসরায়েল পারমাণবিক শক্তি অর্জন করেছে কিনা সে প্রশ্ন কেউ করছেনা। যে ইসরায়েল একদিন ফিলিস্তিনের একাংশ ভূমি দখলে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারা এখন ফিলিস্তিন থেকে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের উচ্ছেদ করে সমগ্র দেশ দখল করতে চায়। ট্রাম্প ২২ লক্ষ্য গাজাবাসীদের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে নির্বাসন দিতে প্রস্তাব করেন। নেতানিয়াহু বলেছেন, সৌদি আরবে অনেক অব্যবহৃত ভূমি রয়েছ, ওখানে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যুদ্ধবাজ অত্যাচারী ইসরায়েলের গণহত্যাসহ যাবতীয় মানবতা বিরোধী অপরাধে বিশ্ববিবেক নীরব।
মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘পশ্চিমা সভ্যতা যেভাবে এ অন্যায়কে নীরবে মেনে নিচ্ছে, তা নৈতিক পতনের প্রতিচ্ছবি’। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো একদিকে মানবাধিকারের পক্ষে ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কথা বলে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে অর্থ ও মারণাস্ত্র দিয়ে ফিলিস্তিনে গণহত্যায় সহায়তা করছে। যতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন ও সহায়তা অব্যাহত রাখবে এবং আরব রাষ্ট্রসমূহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াবে ততদিন ইসরায়েলকে আগ্রাসন, গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধ থেকে নিবৃত করা যাবে না। ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের ‘বিষফোড়া’ হয়েই থাকবে।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রদূত