Image description

অব্যাহত বোমা হামলা। সরাসরি গুলি। ক্ষুধা। হাহাকার। আর লাশের স্তূপ গাজায়। অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরছে নিরীহ মানুষ। এর অর্থ গাজায় দুর্ভিক্ষ চলছে। গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর  থেকে সতর্ক করা হয়েছে, গাজা দুর্ভিক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখনো সেটাই বলা হচ্ছে। কিন্তু আসলে পরিস্থিতি যা বলে, তাতে গাজায় চরম আকারে দুর্ভিক্ষ চলছে। অসংখ্য মানুষ আছেন দুই তিনদিন ধরে কিছু খান না। কারণ, খাবার পাচ্ছেন না। শিশুরা অনাহারে থাকতে থাকতে, তাদের গায়ের চামড়া হাড়ের সঙ্গে লেগে গেছে। তাদের জন্য নেই কোনো খাদ্য, শিশুখাদ্য। মায়েদের বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে। তারাই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। কোথাও কিছু নেই। চারদিকে শুধু হাহাকার। একে দুর্ভিক্ষ ছাড়া কি বলা যায়! তারপরও সেখানে অব্যাহতভাবে বোমা হামলা করছে ইসরাইল। তারা আসলে গাজাবাসীকে চাপে ফেলে গাজা থেকে উৎখাত করতে চায়। এরপরই গাজায় তাদের কথিত ‘ভূমধ্যসাগরের রিভেরা’ বা রিসোর্ট গড়ে তুলতে পারবে। এরই মধ্যে এমন আয়োজন শুরু হয়েছে। 

গাজাবাসীকে পশ্চিমতীরে ধ্বংসস্তূপের ওপর নির্মিত মানবিক শহরে আটকে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে ইসরাইল। সেখানে একবার তাদেরকে  ঢোকাতে পারলে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। কারণ, ইসরাইলি সেনারা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তারা সেই মানবিক সিটির বাইরে যেতে পারবেন না। তাদের নড়াচড়ার কোনো অধিকার থাকবে না। ঠিক পশ্চিমা দেশে অবৈধ অভিবাসীদের যেভাবে আটকে রাখা হয়, সেই একই পরিণতি হবে তাদের। এ অবস্থায় গাজাকে আসলে কী বলা যায়, তা মাথায় ঠাহর হচ্ছে না। বৃটেন সহ ইউরোপের অনেক দেশ এ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গাজায় অবরোধ তুলে নেয়ার জন্য জোর দাবি জানানো হচ্ছে। জাতিসংঘ কথা বলছে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি বৃটিশ পার্লামেন্টারিয়ানদের মধ্যে তীব্র হয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারকে এ জন্য খোলা চিঠি দিয়েছেন। গাজাকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ফ্রান্স। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির সঙ্গে আলোচনা করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন। সব মানুষ গাজায় হত্যাযজ্ঞ, অনাহারে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার বিরুদ্ধে কথা বলছে। কিন্তু হায়, মুসলিম বিশ্ব! তাদের মধ্যে এ নিয়ে তেমন কোনো সাড়া নেই। 

মুসলিম বিশ্বের একীভূত কোনো উদ্যোগ নেই। হয়তো এ কারণে গাজাবাসীকে ক্রমশ নিষ্পেষণ করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়ার সাহস দেখাচ্ছে ইসরাইল। ওদিকে  ফ্লোটিলা হানাদা ত্রাণ নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল গাজার দিকে। তাতে ২১ জন ক্রু ছিলেন। তাদের সবাইকে আটক করেছে ইসরাইল। তাদের পরিণতিও হয়তো ফ্লোটিলা মেডেলিনের গ্রেটা থানবার্গদের মতো হতে পারে। হানদালা নৌযানে ১০টি দেশের ১৯ জন কর্মী ও আল জাজিরার দু’জন সাংবাদিক আছেন। কর্মীদের মধ্যে আছেন ফরাসি-সুইডিশ ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য এমা ফুরো, ফরাসি সংসদ সদস্য গ্যাব্রিয়েল ক্যাথালা, ফিলিস্তিনি-মার্কিন মানবাধিকার আইনজীবী হুয়াইদা আরাফ, ইহুদি-আমেরিকান কর্মী জ্যাকব বার্গে, তিউনিশীয় ট্রেড ইউনিয়নিস্ট হাতেম আওইনি, ৭০ বছর বয়সী নরওয়েজীয় কর্মী ভিগডিস বিওরভ্যান্ড এবং অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক তানিয়া সাফি প্রমুখ। ওদিকে, গাজায় খাদ্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, মে মাসে বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) চালু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি বাহিনী ও মার্কিন ভাড়াটে সেনাদের হাতে এক হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তারা খাদ্য সংগ্রহে গিয়েছিলেন। কেবল শনিবারই খাদ্যের জন্য লাইন ধরার সময় ৪২ জন নিহত হন। গাজাবাসীর দিকে ইসরাইলি সেনারা এমনভাবে গুলি ছুড়ছে, দেখে মনে হতে পারে তারা পাখি শিকার করছে। কিন্তু তারা এ কাজ করে উল্টো সুরে কথা বলছে। তারা বলছে, যারা নিহত হয়েছেন তারা খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের বাইরে মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক সিনেটর কোরি বুকার গাজায় মানবিক পরিস্থিতিকে ‘বিধ্বংসী ও হৃদয়বিদারক’ আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে ব্যাপক ত্রাণ সরবরাহের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতিটি মুহূর্ত দেরি মানে শিশুরা, গর্ভবতী নারীসহ অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ও তা এক স্থায়ী ক্ষতি।

অন্যদিকে, ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-নোয়েল ব্যারো জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো হামাসকে নিন্দা জানাবে আরব দেশগুলো এবং এর নিরস্ত্রীকরণের দাবি তুলবে। এর মাধ্যমে ইউরোপের আরও দেশকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার পথে আনা হবে। এদিকে বৃটেনে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি) হুঁশিয়ারি দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিরোধিতা অব্যাহত রাখলে তারা সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে ‘প্যালেস্টাইন রিকগনিশন বিল’ উত্থাপন করে ভোটে বাধ্য করবে। ইতিমধ্যে ২২০ জনের বেশি বৃটিশ এমপি, যার মধ্যে স্টারমারের লেবার পার্টির বহু সদস্য আছেন, বৃটেনকে ফ্রান্সের মতো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ৫৯,৭৩৩ ফিলিস্তিনি নিহত ও ১,৪৪,৪৭৭ জন আহত হয়েছেন। গাজায় দুর্ভিক্ষ নিয়ে বিশ্ব জুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখে ইসরাইল আকাশপথে কিছু ত্রাণ ফেলার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এই ত্রাণ চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। আকাশ থেকে ফেলা ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে, সংঘর্ষে মানুষ আহত হচ্ছেন। জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিষয়ক কমিশনার জেনারেল ফিলিপ্পে লাজারিনি এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের কথা বলার কারণে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের সেবা থেকে তিনি সরে যাবেন না বলে অঙ্গীকার করেছেন।