
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় হঠাৎ বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়ছে, অন্যদিকে ঐতিহাসিক মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব দৃশ্যমান হচ্ছে। এমন পরিবর্তন কেবল তিন রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের শক্তির ভারসাম্যে প্রভাব ফেলছে।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক বরাবরই বৈরিতা ও অবিশ্বাসের বন্ধনে বাঁধা। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব এবং যুক্তরাষ্ট্রের তেহরান দূতাবাস দখলের ঘটনা তাদের সম্পর্কে দীর্ঘস্থায়ী অবনতি ঘটায়। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি ছিল এক সম্ভাবনাময় অধ্যায়, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের একতরফা চুক্তি ত্যাগ সে সম্ভাবনাকে ভেঙে দেয়। এরপর কয়েক বছর উত্তেজনা চললেও ২০২৫ সালে এসে দেখা যাচ্ছে এক নতুন ধারা- যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ঘিরে কিছুটা নমনীয়তা দেখাচ্ছে। এর নেপথ্যে রয়েছে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, তেল-গ্যাসের অর্থনীতি এবং চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে কৌশলগত প্রতিরোধ।
সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের সামরিক উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। প্রথমে ইরানে হামলা চালায় ইসরায়েল। পরে ইরান সরাসরি ইসরায়েলে শতাধিক ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, আবার ইসরায়েলও ইরানের বেশ কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে এই সংঘাতে সরাসরি জড়িত না হলেও পরে ‘নিয়ন্ত্রিত হস্তক্ষেপ’ নীতি অনুসরণ করে ইরানের কিছু স্থাপনায় লক্ষ্যভিত্তিক হামলা করে। কিন্তু এই হামলা ছিল এমনভাবে সীমিত, যা দেখে বিশ্লেষকরা একে ‘সামরিক ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টা’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।
এদিকে ইসরায়েলকে রক্ষায় ইরানে ৬০-৮০টি ইন্টারসেপ্টর ব্যবহার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মিলিটারি ওয়াচ ম্যাগাজিনের মতে, একটি উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী ব্যবস্থা টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) ইন্টারসেপ্টরের একক উৎক্ষেপণের খরচ ১২-১৫ মিলিয়ন ডলার, তাই এই ইন্টারসেপ্টরের মোট খরচ ৮১০ মিলিয়ন থেকে ১.২১৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি হারাতে হয়েছে।
ইসরায়েলের ঘুম হারাম করে ট্রাম্প কি ইরানের প্রেমে পড়লেন
হামলা করতে গিয়ে তেহরানের প্রেমে পড়েছেন ইসরায়েলের পাইলট
প্রেস ও কূটনৈতিক সূত্র অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পর্দার আড়ালে আলোচনা চলছে- বিশেষ করে ওমান, কাতার ও সুইজারল্যান্ডের মাধ্যমে। আলোচনার মূল বিষয় তিনটি- ইরানের পরমাণু কর্মসূচি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং ইরানের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা আংশিক শিথিলতা। কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা দাবি করছে, যুক্তরাষ্ট্র এমনকি ইরানের জন্য ৩০ বিলিয়ন ডলারের একটি শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিনিয়োগ প্রকল্প বিবেচনা করছে, যদিও ট্রাম্প প্রশাসন তা প্রকাশ্যে অস্বীকার করেছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই ইরানমুখী দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি বড় কারণ ইরানের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। ইরান পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস রিজার্ভের অধিকারী। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের মধ্যে এই সম্পদ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ইরানে রয়েছে বিরল খনিজ, যেমন লিথিয়াম, ইউরেনিয়াম ও কপার, যেগুলো আধুনিক প্রযুক্তি, গ্রিন এনার্জি ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরির জন্য অপরিহার্য। এর বাইরে রয়েছে ইরানের দ্রুত উন্নয়নশীল সামরিক সক্ষমতা- বিশেষ করে ড্রোন ও হাইপারসনিক মিসাইল প্রযুক্তি, যা বিশ্বশক্তিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্বের বিষয়টিও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রকে কৌশলগত দোটানায় ফেলেছে। ট্রাম্প প্রশাসন অভ্যন্তরীণভাবে বিরোধী রাজনীতিক, শিক্ষার্থী আন্দোলন ও মিডিয়ার চাপের মুখে পড়েছে। এর ফলে ওয়াশিংটন ইসরায়েলের প্রতি তাদের নিঃশর্ত সমর্থন কিছুটা সরিয়ে নিয়েছে। এমনকি কিছু সময় অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত রাখাও হয়েছে। এর আগে বাইডেন-নেতানিয়াহু সাক্ষাৎ একাধিকবার বিলম্বিত হয়েছে বা বাতিল হয়েছে, আর হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর সরকারকে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’ বলেও অভিহিত করেছে। এসব ঘটনাই ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক আগের মতো আর অটুট নেই।
মধ্যপ্রাচ্যে এই ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন আরও গভীর অর্থ বহন করে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্ক এখন তুলনামূলক ভালো, গালফ রাষ্ট্রগুলো (যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত) এখন ইরানের সঙ্গে সীমিত অথচ কার্যকর কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করছে। ইসরায়েলের এ আগ্রাসী ভূমিকায় তারা নিজেদের কৌশল নতুন করে ভাবছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রও উপলব্ধি করছে যে, ইরানকে পুরোপুরি দূরে ঠেলে দিলে তা চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে পারে। ফলে তারা ইরানকে আংশিকভাবে নিজেদের কৌশলগত বলয়ের মধ্যে রাখার প্রয়াস নিচ্ছে।
সর্বশেষ নেদারল্যান্ডসের হেগে ন্যাটোর সম্মেলনে হাজির হয়ে ইরানের ওপর থেকে তেল নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ইঙ্গিত দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মূলত ইসরাইলের সঙ্গে সংঘাতের পর দেশটির পুনর্গঠনে সাহায্য করতে এমন পদক্ষেপের কথা জানিয়েছেন তিনি। পরে ট্রুথ সোশালে ট্রাম্প লিখেছেন, চীন এখন ইরান থেকে তেল কেনা চালিয়ে যেতে পারবে। কারণ, দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য অর্থের প্রয়োজন রয়েছে।
এ বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কৌশল- ‘কন্টেইনিং বাই এনগেইজমেন্ট’। অর্থাৎ তারা ইরানকে সামরিকভাবে দমন না করে, বরং অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত রেখে নিয়ন্ত্রণে রাখার পথ বেছে নিচ্ছে। এতে করে একদিকে চীন-রাশিয়ার প্রভাব হ্রাস পাবে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। এ কৌশল সফল হলে ইরানকে একটি নিয়ন্ত্রিত শক্তি হিসেবে ধরে রাখা যাবে, যার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের কিছুটা স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
তবে, এই সামগ্রিক চিত্রের পেছনে একাধিক জটিলতা রয়েছে। প্রথমত, ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখনও কট্টরপন্থিদের দখলে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে এখনো ‘শয়তানের প্রতীক’ হিসেবেই দেখে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলও সহজে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল মেনে নেবে না। তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে আপোষহীন এবং ইরানকে প্রধান হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির ফলে ইসরায়েলের ক্ষুব্ধ হওয়া এবং নতুন করে অস্ত্র বা নিরাপত্তা চুক্তি অন্য কোনো দেশের সঙ্গে করা অস্বাভাবিক নয়।
এদিকে পারমাণবিক চুক্তি পুনর্জীবনের বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত রাখুক এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাজের সুযোগ দিক। ইরান চায় নিষেধাজ্ঞা শিথিল ও তেলের বাজারে পূর্ণ প্রবেশ করতে। উভয়পক্ষই কিছু ছাড় দিয়ে চুক্তির সম্ভাব্য নবায়ন করতে পারে। যদিও এ প্রক্রিয়া দৃশ্যত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ।
এ প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বাস্তবতার জন্ম হচ্ছে। একসময় যারা শত্রু ছিল, তারা এখন সম্ভাব্য আলোচনার টেবিলে। আর দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরায়েল এখন কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র এ কৌশলের মাধ্যমে বহুমুখী স্বার্থ অর্জনের চেষ্টা করছে- চীন-রাশিয়াকে ঠেকানো, তেল সরবরাহ নিরাপদ রাখা, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভারসাম্য তৈরি এবং নিজেদের বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে ধরে রাখা। এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইরানকে যতটা সম্ভব যুক্ত রাখতে হবে, আর ইসরায়েলকে পরোক্ষভাবে চাপ দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
শেষ কথা, যুক্তরাষ্ট্রের এ কৌশল মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ রাজনীতি আমূল বদলে দিতে পারে। ইরান যদি এ সমঝোতার পথে এগোয় এবং যুক্তরাষ্ট্র এই কৌশলগত ভারসাম্য ধরে রাখতে পারে, তা ইসরায়েলের গা জ্বালার কারণ হবে।