
দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, নয়নাভিরাম পাহাড়-সাগর মিলন, অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য—সবই আছে কক্সবাজারে। নেই শুধু বিদেশি পর্যটকের আনাগোনা। হাতে গোনা যে কজন বিদেশি পর্যটক আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই উন্নয়ন সংস্থার কর্মী বা প্রবাসী বন্ধুদের অতিথি। বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারকে ‘একক গন্তব্য’ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে চালু হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর প্রায় এক কোটি স্থানীয় ভ্রমণকারী আসেন। এক গন্তব্যে সাগর-পাহাড়ের এই মেলবন্ধন বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের অবারিত সুযোগ থাকলেও সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর সমন্বয় এবং পর্যটকবান্ধব পরিবেশ না থাকায় সেই সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হচ্ছে। দেশের প্রধানতম এই সমুদ্রসৈকতে দরকার আন্তর্জাতিক মানের পরিবেশ, সেবা প্রদানের সংস্কৃতি ও নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসবের অনেকটাই অনুপস্থিত।
হাতে গোনা দু-একজন পর্যটকের একজন কলম্বিয়া থেকে আসা এলিনা কক্সবাজারে কাটিয়েছেন তিন দিন। তিনি বলেন, ‘সমুদ্র সুন্দর, কিন্তু সৈকত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না। হোটেলের খরচ ইউরোপের মতো, কিন্তু মান অনেক কম। রাতের বেলা কোথাও ঘুরে বেড়ানোর মতো পরিবেশ পাইনি।’
শুধু এলিনাই নন, এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে আরো অনেক বিদেশির। তাঁরা মনে করেন, এই পর্যটন শহরটি এখনো ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিস্ট-ফ্রেন্ডলি’ নয়।
জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের প্রস্তুতি : এমন পরিস্থিতির মধ্যেই জুলাই মাসের শেষে উদ্বোধনের অপেক্ষায় কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সাগরের বুকে দেশের সবচেয়ে লম্বা ও সর্বাধুনিক রানওয়ে, নাইট ল্যান্ডিং সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনালের মাধ্যমে এটি হয়ে উঠতে যাচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের আকাশপথের দরজা।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সদ্যোবিদায়ি চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, ‘জুলাই মাসের শেষের দিকে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এটা দেশের পর্যটনের মেইন স্পট, আশা করছি অনেক এয়ারক্রাফট এখানে আসবে। পর্যটকরা এসে এখানে সরাসরি নামবেন।’
কারা আসবেন? : খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নেপাল, ভুটান, উজবেকিস্তান, ভারতের সেভেন সিস্টার ও চীনের ইউনান প্রদেশের মতো ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য কক্সবাজার সবচেয়ে কাছের সমুদ্র গন্তব্য, যার পর্যটন সম্ভাবনা অপার। কিন্তু এই বিমানবন্দর যেসব বিদেশি পর্যটককে আকর্ষণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে, তাঁদের জন্য কক্সবাজার কতটা প্রস্তুত?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শাকের আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকরা ঢেউ গুনতে আসবেন না। দু-এক দিন পরই তাঁরা কাঙ্ক্ষিত সুবিধা না পেলে ধৈর্য হারাবেন। তাঁদের জন্য এখানে নেই কোনো নাইট লাইফ। আশপাশে কিছু জাদুঘর, শপিং মল, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, বার, ক্যাসিনোর মতো সুবিধা দরকার। পাহাড়ে যেসব সৌন্দর্য-ঐতিহ্য আছে, সেগুলো দেখানোর জন্য ভালো যানবাহন, ট্যুর গাইডসহ আনুষঙ্গিক সুবিধা নেই। এগুলো না থাকলে ফ্লাইট চালু হলেও পর্যটক আসবেন না।’
‘একক গন্তব্য’ হতে যেসব বাধা : একক পর্যটন গন্তব্য এমনভাবে গড়ে তোলা হয়, যাতে পর্যটকরা সেখান থেকেই ভ্রমণ, কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবকিছু সেরে নিতে পারেন। বালিসহ বিশ্বের নামকরা বিচগুলোর মতো কক্সবাজারকে ‘একক গন্তব্য’ হিসেবে গড়ে তুলতে কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকদের জন্য বেশ কিছু সুবিধার অভাব রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো পর্যটকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন, তাঁদের উপযোগী খাবার, উন্নত যাতায়াতব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, বিদেশি ভাষা জানা ট্যুর গাইড, নিরাপত্তা, বিনোদন, মানি এক্সচেঞ্জ, শপিং মল, পার্ক, আধুনিক টয়লেট, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, তথ্যকেন্দ্র, লকার সুবিধা, বসার স্থান, প্রদর্শনী এবং উন্মুক্ত মঞ্চের অভাব। এ ছাড়া বিচকেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সিনেপ্লেক্স, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, থিম পার্ক, নাইট ক্লাব, ক্যাসিনো, সমুদ্রসৈকত ক্রুজ, প্রমোদতরি, বিশেষায়িত শপিং মল, এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন, বিদেশিদের জন্য আলাদা জোনের অভাব রয়েছে।
যেসব সমস্যা ও সম্ভাবনা দেখছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা : পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একটা সুন্দর সৈকতই যথেষ্ট নয়, বিদেশি পর্যটকের কাছে বিশ্বমানের ‘অভিজ্ঞতা’ চাই। এখনই উদ্যোগ না নিলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, হোটেল বা সমুদ্র—সবই হয়ে যাবে অলস সম্পদ।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি রাফিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কক্সবাজারে নেপাল, ভুটান, উজবেকিস্তান ও চীনের ইউনান প্রদেশের মতো স্থলবেষ্টিত দেশগুলোর পর্যটকদের আকর্ষণ করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এটি তাঁদের সবচেয়ে কাছের সমুদ্র উপকূল। কক্সবাজারের সঙ্গে কাঠমাণ্ডু, থিম্পু ও খুনমিংয়ের সরাসরি সপ্তাহান্তের বিমান চলাচল পর্যটকদের আগমনকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সেবা প্রদানের জন্য শহরে এখনো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও বিনোদনের অভাব রয়েছে।’
পর্যটন বিচিত্রার সম্পাদক ও পর্যটন করপোরেশন বোর্ডের পরিচালক মহিউদ্দিন হেলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নেপাল, ভুটান, খুনমিং, ভারতের সেভেন সিস্টারের মতো দেশগুলো থেকে পর্যটক আগমনের সুযোগ করে দেবে। কক্সবাজারে যেসব আকর্ষণ রয়েছে তা এখনো কাঁচামাল হিসেবে রয়েছে, সেগুলোকে পর্যটনপণ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’
ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম নেটওয়ার্কের (বাংলাদেশ অংশ) সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ গোলাম কাদের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পর্যটন গন্তব্যে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু করার জন্য যে প্রস্তুতি থাকা দরকার সেটি সরকারের নেই। টার্গেট মার্কেট কোনগুলো, কারা আসবে, তাদের জন্য কী কী সুবিধা থাকবে—এসবের কোনো বন্দোবস্ত হয়নি।’
ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিজিএবি) সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুল ইসলাম (বুলু) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ থেকে পর্যটকদের আনতে হলে শুধু বিমানবন্দর সাজালে হবে না, কক্সবাজারকে সাজাতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে। যেসব দেশ থেকে আমরা পর্যটক আনতে চাই সেখানে আমাদের রোড শো, প্রচার-প্রচারণা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের মধ্যে ঘাটতি আছে। বিদেশি ভাষা জানা গাইডেরও অনেক সংকট রয়েছে।’
পর্যটননীতিতে সমন্বয়ের অভাব : কক্সবাজারে পর্যটন নিয়ে নানা প্রকল্প চললেও সেগুলোর বাস্তবায়নে রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা ও আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের অভাব। পর্যটন করপোরেশন, পর্যটন বোর্ড, জেলা প্রশাসন, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—সবাই নিজস্ব গতিতে চলে, অথচ একীভূত পরিকল্পনা নেই।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অভাব : কক্সবাজারে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হোটেল ও মোটেল থাকলেও পর্যটকদের বিনোদনের জন্য ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অভাব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন কোনো প্রকল্প চালু করতে চাইলে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে ১৬টি ছাড়পত্র নিতে হয়। এ জন্য শেষ পর্যন্ত প্রজেক্ট চালু করা হয় না।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিজাম উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক্সক্লুসিভ সি-বিচ করার জন্য মেরিন ড্রাইভের লাল কাঁকড়া বিচ এলাকাটি একটি চমৎকার স্থান। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে তা করা দরকার, তাহলে বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ তিনি জানান, বিদেশি পর্যটকদের সুবিধার্থে এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের তরফে ‘ভ্রমণিকা’ নামের একটি অ্যাপস করা হয়েছে। ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স প্ল্যানার’-এর ওপর কাজ চলছে।
কক্সবাজার সাগরপারের পাঁচতারা মানের হোটেল সি-গালের প্রধান নির্বাহী (সিইও) রুমী সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হোটেলটিতে লাইসেন্সকৃত বার, সুইমিংপুল, সি-বিচে বসার ব্যবস্থা, পাঁচটি রেস্টুুরেন্ট, জিমনেসিয়াম, কনফারেন্স হলসহ আন্তর্জাতিক মানের যাবতীয় সুযোগ রয়েছে। কক্সবাজারে এ রকম মানের পাঁচটি তারকা হোটেল রয়েছে, যার সব কটিতেই রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা।’
কক্সবাজারের হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, কক্সবাজারে পাঁচ শতাধিক আবাসিক হোটেল রয়েছে। এক রাতে এসবের ধারণক্ষমতা রয়েছে ৮৫ হাজার পর্যটকের।
কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক গন্তব্য বানাতে ‘বালি মডেল’ : একটি ছোট দ্বীপ, সীমিত সৈকত, কিন্তু সারা বছর বিশ্বের লাখো পর্যটক ভিড় জমায় ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কক্সবাজারকে ‘সিঙ্গল ডেস্টিনেশন’ ভাবার ক্ষেত্রে ‘বালি মডেল’ অনুসরণের কথা বলছেন। জানতে চাইলে ট্যুরিজম ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিডাব) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ হাবিব আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পর্যটন খাতে যেসব দেশ উন্নতি করেছে, সেসব দেশে সরকারপ্রধান নিজেই যুক্ত। কিন্তু আমদের দেশে যে মন্ত্রী/উপদেষ্টাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাঁরা এই খাতটির উন্নয়ন কিভাবে করতে হবে সে সম্পর্কে জানেন না। কক্সবাজারসহ প্রধান পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে নির্দিষ্ট এলাকায় বিদেশিদের জন্য ক্যাসিনো, ম্যাসাজ, স্পার মতো সেবাগুলোকে লাইসেন্সিংয়ের আওতায় আনা, বৈধভাবে নাইট ক্লাব, বার চালুর দাবি জানিয়ে আসছি।’
সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও আবু তাহের মো. জাবের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কক্সবাজারে অভ্যন্তরীণ পর্যটক অনেক যাচ্ছে, কিন্তু বিদেশি পর্যটক কম। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে চীনা পর্যটক আরো আসতে পারে। অনেকগুলো চীনা গ্রুপের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে, তারা খুনমিং-কক্সবাজার সরাসরি ফ্লাইট চায়। এ ছাড়া নেপাল-ভুটানের সঙ্গে আমাদের ট্যুর অপারেটররা যৌথ পর্যটন প্যাকেজ নিয়ে কাজ করছে। আমরা আশাবাদী, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হলে আমরা আরো বেশি বিদেশি পর্যটক পাব।’