Image description
পীরগঞ্জ ডায়াবেটিক হাসপাতাল নির্মাণ । চুক্তির বাইরে ৬৩ লাখ টাকা খরচ, অনুমতি না নিয়েই মেয়াদ বৃদ্ধি । যা করা হয়েছে নিয়ম মেনেই, কোনো অনিয়ম হয়নি-প্রকল্প পরিচালক ।

একটি ছোট প্রকল্পে বড় ধরনের অনেক অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে ২০ শয্যা বিশিষ্ট ডায়াবেটিক হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পে এসব অনিয়ম ধরা পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-চুক্তির বাইরে প্রায় ৬৩ লাখ টাকা খরচ, অনুমতি না নিয়েই এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধি ও বেসরকারি অংশীদারের টাকা ফেরত, চার বছর আগে শেষ হলেও অডিট না হওয়া, রোগীর জন্য সাধারণ বেড কিনে খরচ বেশি দেখানো ইত্যাদি।

সম্প্রতি সমাপ্ত এই প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদন (পিসিআর) পর্যালোচনা এবং সরেজমিন প্রকল্প পরিদর্শন করে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে খরচ হয়েছে ৯ কোটি ১৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। সম্প্রতি সরেজমিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন সংস্থাটির পরিচালক মো. কামাল হোসেন। ইতোমধ্যেই প্রতিবেদনটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই নোটিশ জারি করা হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. আল মামুন রোববার যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটি অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এটি নিয়ে কাগজপত্র না দেখে কোনো কথা বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি এটি শেষ করার চ্যালেঞ্জ ছিল, আমি সে কাজটি করেছি। আমার আগে আরও দুজন প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর নিয়মের মধ্যে থেকেই সব কাজ করেছি। আইএমইডি এতদিন পর এসে কী অনিয়ম পেয়েছে আমার জানা নেই। তিনি বলেন, প্রকল্পটির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি নিজেই পীরগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির ওই সময়ের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে ব্যাপক অসহযোগিতা পেয়েছিলাম। তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে অনুদান নিয়ে আসতেন এবং একাই সব কাজ করতেন। কিন্তু তার কাজে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না। আমি সেগুলো বন্ধ করে ভালোভাবে প্রকল্পটি শেষ করেছি। এটি আমার কাছে এখন একটি বোঝার মতো। প্রকল্পের ঝামেলার বাইরে আমি একটু শান্তিতে থাকতে চাই।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির মূল মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। এতে কাজ শেষ না হওয়ায় ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই এক বছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এ পর্যায় পর্যন্ত নিয়ম সঠিক ছিল। কিন্তু পরে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত আরও এক বছর বাড়িয়ে প্রকল্পটি শেষ করা হয়েছে। আইএমইডি বলছে, এই মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে প্রকল্প সংশোধন না করে এবং আইএমইডির সম্মতি না নিয়ে কিভাবে মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে সেটির কোনো তথ্য পিসিআরে (প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদন) নেই। সেই সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকের কাছে জানতে চেয়েও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি সরকারি তহবিল (জিওবি) এবং প্রত্যাশী সংস্থার (পীরগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতি) যৌথ অর্থে বাস্তবায়িত হয়। এক্ষেত্রে জিওবি থেকে ৮ কোটি ১৬ লাখ এবং সংস্থার ২ কোটি ৯ লাখ টাকা খরচ করার কথা। ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ক্রয় পরিকল্পনার পণ্য ক্রয়ের ৬টি প্যাকেজের মধ্যে সরকারি অর্থায়নে চারটি পণ্য প্যাকেজ ক্রয় করা হয়। কিন্তু প্রত্যাশী সংস্থার অর্থে যানবাহন/অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হয়নি। এটির প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ৬০ লাখ টাকা। আইএমডি বলছে, পরিদর্শনের সময় প্রকল্প পরিচালক জানান বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স অনুদান পাওয়ায় সংস্থার অংশের টাকা খরচ করা হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইএমইডি বলছে, এই টাকা প্রত্যাশী সংস্থাকে ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক কোনো কাগজপত্রও দেখাতে পারেননি। এছাড়া প্রকল্পটির ভবন নির্মাণ খাতে ডিপিপিতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা ছিল ৬ কোটি টাকা। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করা হয় ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার। কিন্তু প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদনে দেখানো হয় এ খাতে খরচ হয়েছে ৫ কোটি ৯৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। আইএমইডি বলছে, প্রকল্প পরিচালকের কাছে বাড়তি টাকা খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজের ভেরিয়েশনে খরচ হয়েছে। কিন্তু কী ভেরিয়েশন করা হয়েছে সেটি তিনি জানাতে বা দেখাতে পারেননি।

আইএমইডি আরও বলেছে, প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সালের জুনে শেষ হয়। এই সময়ের মধ্যে বছরভিত্তিক অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটিতো হয়নি বরং প্রকল্প শেষ হওয়ার চার বছর পরও কোনো অডিট করা হয়নি। পাশাপাশি পিসিআরের (প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদন) মধ্যেও অসম্পূর্ণ এবং ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। কেননা প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী এটির মোট ব্যয় ছিল ১০ কোটি ২৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। পিসিআরে রাজস্ব এবং মূলধন খাতের ব্যয় যোগ করে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১০ কোটি ৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। যা ডিপিপির আনুমানিক ব্যয় থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা কম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মেডিকেল ফার্নিচারের ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা দিয়ে ৫টি (প্রতিটি ১ লাখ টাকা করে) উন্নতমানের কেবিন বেড ক্রয় দেখানো হলেও সরেজমিন পরিদর্শনের সময় সাধারণ মানের বেড দেখতে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে মালামাল ক্রয় কমিটির প্রতিবেদন দেখতে চাইলে পরিদর্শনের ২ মাস পর ই-মেইলে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে প্রকল্প পরিচালক মো. আল মামুন, সহকারী পরিচালক সাইয়েদা সুলতানা এবং ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার মো. ফারুক হোসেনের স্বাক্ষর থাকলেও কোনো তারিখ দেওয়া নেই।