
আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এই হামলার লক্ষ্য ছিল তেহরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে পঙ্গু করা এবং দেশটির শাসন ব্যবস্থাকে দুর্বল করা। তবে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এই বেপরোয়া পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ এবং ভূ-রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই তাঁর জন্য বুমেরাং হতে পারে। অন্যদিকে এটি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য এনে দিতে পারে একটি কূটনৈতিক বিজয়।
যে কারণে নেতানিয়াহুর জন্য বুমেরাং হতে পারে
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঝুঁকি
নেতানিয়াহুর একতরফা হামলার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। ইরান তো বটেই পুরো মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা এখন চরমে। ইরানও এর জবাবে তেল আবিব এবং জেরুজালেমের মতো ইসরায়েলি শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে ব্যাপক যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়েছে। ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকেরাও শার্পনেলে আহত হচ্ছেন এবং অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গাজা যুদ্ধ পরিচালনার ধরন এবং অতি-রক্ষণশীলদের সামরিক নিয়োগে ছাড়ের মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জোটের টানাপোড়েনের কারণে এমনিতেই নেতানিয়াহুর জনসমর্থন কমেছে। যদি হতাহতের সংখ্যা বাড়ে বা সংঘাত দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে তাঁর জনসমর্থন আরও কমতে পারে।
ইসরায়েলি বিশ্লেষক ও সমালোচকেরা যুক্তি দিচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া নেতানিয়াহুর এই পদক্ষেপ ইসরায়েলকে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকি তৈরি করেছে। তাঁর জোট অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে পড়েছে, যেখানে শাস-এর মতো দলগুলো অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নেসেট (সংসদ) ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। যুদ্ধ আরও তীব্র, বিস্তৃতি ও দীর্ঘায়িত হলে সরকারকে অস্থিতিশীল করতে পারে।
আঞ্চলিক সংঘাতের বৃদ্ধি
ইরানের দুর্বল অবস্থা বিশেষ করে—আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অবনতি, হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো প্রক্সিদের দুর্বল হয়ে পড়া এবং কাসেম সোলেইমানির মতো শীর্ষ কমান্ডাররা নিহত হওয়া—নেতানিয়াহুকে হামলা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছে। তবে, ইরানের অবশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা এবং রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে জোট তেহরানকে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিশোধমূলক হামলায় প্ররোচিত করতে পারে। শেষ পর্যন্ত ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারে ইসরায়েলি বা মার্কিন অবকাঠামো ও সামরিক কাঠামো। অথবা হরমুজ প্রণালির মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যাহত করার মতো পদক্ষেপও নিতে পারে ইরান। একটি বৃহত্তর যুদ্ধ ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে বিপর্যস্ত করতে পারে। যেখানে ইতিমধ্যে গাজা ও লেবাননে বড় ধরনের সামরিক শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে। বাড়তি সংঘাত ইসরায়েলের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ইরানের শাসন পরিবর্তনে লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সরাসরি ইরানিদের বিদ্রোহ ঘোষণা করার আহ্বান জানাচ্ছেন। এটা স্পষ্টত একটি জুয়া। যদি বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা টিকে যায়, তাহলে এটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ সমর্থনকে আরও শক্তিশালী করতে পারে, সংঘাত দীর্ঘায়িত করতে পারে এবং ইসরায়েলের ভেতর নেতানিয়াহুকে অতি উচ্চাভিলাষী প্রমাণ করতে পারে।
৩. যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কে টানাপোড়েন
ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির আলোচনা চালিয়ে যেতে ট্রাম্প ইসরায়েলকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু নেতানিয়াহু সেটি উপেক্ষা করেছেন। এই অবাধ্যতা তাঁদের সম্পর্কের ফাটল উন্মোচন করেছে। ট্রাম্পের সঙ্গে নেতানিয়াহুর দূরত্ব যে বাড়ছে তা গত কয়েক মাস ধরেই প্রকাশ্য হচ্ছিল। সম্প্রতি ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরে সেটি স্পষ্ট হয়েছিল।
নেতানিয়াহুর পদক্ষেপে ট্রাম্প প্রকাশ্যে হতাশা প্রকাশ করেছেন। ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য মার্কিন বাহিনী পাঠানোর অঙ্গীকার করেননি। যদিও বলেছেন, ইসরায়েলের এই হামলা ইরানকে পরমাণু চুক্তিতে আসার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে।
ফলে প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলের প্রতি যে নমনীয়তা ট্রাম্প দেখিয়েছিলেন, এখন সেই অবস্থান থেকে সরে আসারই ইঙ্গিত মিলছে। এর ফলে মার্কিন সামরিক বা কূটনৈতিক সহায়তা হ্রাস পেতে পারে, যা ইরান আরও উত্তেজনা বাড়ালে ইসরায়েলকে অরক্ষিত করে তুলবে।
কিছু মার্কিন কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষক এই হামলাকে ট্রাম্পের কূটনীতিকে লন্ডভন্ড করার একটি ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, ইসরায়েলের এই হামলা আস্থা নষ্ট করছে। ইসরায়েলি মিডিয়াতে উদ্বেগ বাড়ছে, ইরান এবং হুতি যুদ্ধবিরতির মতো ইস্যুতে ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এই কৌশল ইসরায়েলের আঞ্চলিক প্রভাবকে দুর্বল করতে পারে।
ট্রাম্প যেভাবে লাভবান হতে পারেন
১. কূটনৈতিক সুবিধা
ইসরায়েলি হামলা, ইরানের দুর্বলতাগুলো উন্মোচন করার মাধ্যমে, তেহরানকে ট্রাম্পের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনায় ফিরে আসার জন্য একটি চাপ হিসেবে কাজ করতে পারে। ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেছেন, ১৫ জুন ওমানে নির্ধারিত আলোচনা হতে পারে। ইসরায়েলের এই হামলাকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধের মতো শর্তে ইরানকে রাজি করানোর একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।
যদি বেশ কয়েকজন কমান্ডার এবং বিজ্ঞানীকে হারানোর পরও ইরান একটি চুক্তিতে সম্মত হয়, তাহলে ট্রাম্প একটি ঐতিহাসিক কূটনৈতিক বিজয়ের দাবি করতে পারেন। তবে ইরান এরই মধ্যে বলেছে, এত কিছুর পর পরমাণু চুক্তির আলোচনা অর্থহীন।
‘শান্তির মানুষ’ হিসেবে ট্রাম্প নিজেকে প্রচার করতে চান, বিপরীতে নেতানিয়াহুর যুদ্ধংদেহী মনোভাব, এই বৈপরীত্য চুক্তি-সম্পাদনকারী হিসেবে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি বাড়িয়ে দিতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে এই মুহূর্তে ইসরায়েলের সঙ্গে ট্রাম্পের মৌখিক সমন্বয়কে কৌশলগত হিসেবে দেখছেন। ইসরায়েল সামরিকভাবে ইরানকে দুর্বল করে ফেলার পর তিনি একজন ‘ভালো পুলিশ’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন।
২. সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়া এড়ানো
ইসরায়েলের একতরফা পদক্ষেপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রাখার মাধ্যমে, ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এড়িয়ে যাচ্ছেন, যা তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে থাকার অবস্থানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ভোটাররা দেখতে পাবে, ট্রাম্পের প্রশাসন ইসরায়েলের হামলায় অংশ নিতে বা ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলা থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ না হয়ে মার্কিন সম্পদ ও জীবন বাঁচিয়েছে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র জড়ানো ছাড়াই সংঘাত বাড়ে, তাহলে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর ওপর দোষ চাপাতে পারবেন, যা মার্কিন স্বার্থকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করবে।
৩. ভূ-রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস
সৌদি আরব এবং কাতারের মতো আরব দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করার জন্য ট্রাম্প ইসরায়েলকে পাশ কাটাতে চাচ্ছেন, যার মধ্যে সম্ভাব্য পারমাণবিক প্রযুক্তি ভাগাভাগিও অন্তর্ভুক্ত। এই অবস্থান একটি বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য কৌশল নির্দেশ করে। যদি তিনি ইরানের সঙ্গে একটি পরমাণু চুক্তি করার ক্ষেত্রে সফল হোন, তাহলে এটি সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনার পথ প্রশস্ত করতে পারে। এতে ইসরায়েলকে ছাড়াই এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বাড়বে। একজন ভূ-রাজনৈতিক কৌশলবিদ হিসেবে ট্রাম্পের খ্যাতিকে শক্তিশালী করবে। মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের খেলা নেতানিয়াহুর সামরিক জুয়াকে ছাপিয়ে যাবে।
এদিকে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এবং দ্য গার্ডিয়ানের মতো সংবাদমাধ্যমগুলোতে, নেতানিয়াহুর হামলাকে বেপরোয়া এবং ট্রাম্পের কূটনীতিকে দুর্বল করার পদক্ষেপ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তবে, এই মূল্যায়নে ট্রাম্পের প্রকাশ্য সংযম যে একটি হিসেবি পদক্ষেপ হতে পারে সেই সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। ট্রাম্পের এই হিসেবি পদক্ষেপ ইসরায়েল সামরিক পদক্ষেপের বিনিময়ে কূটনৈতিক সুবিধা অর্জনের কৌশলও হতে পারে।
হতে পারে ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন, যেখানে উভয় নেতাই তাঁদের নিজস্ব এজেন্ডা অনুসরণ করছেন। নেতানিয়াহু রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য, আর ট্রাম্প তাঁর লিগ্যাসির জন্য কৌশলে খেলছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে দূরত্ব বজায় রাখছেন।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গি ইরানের সার্বভৌমত্বকেও অবমূল্যায়ন করছে। ট্রাম্পের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শূন্যে নামিয়ে আনার দাবি তেহরানের মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এতে বোঝা যায়, ইরান সহজে নতি স্বীকার করবে না। এই অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে। এটি নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা