Image description

আনসার সদস্য, পুলিশ কনস্টেবল এবং সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের দখলে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের মানিকমিয়া অ্যাভিনিউয়ে সংসদ সদস্যদের বাসভবন (ন্যাম ভবন)। তাদের বসবাসের কারণে ভিআইপি এ ভবনগুলো ‘গণরুম’-এর তকমা পেয়েছে।

পরিণত হয়েছে বহিরাগতদের আখড়ায়। প্রতিটি ফ্ল্যাটে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত লোক বসবাস করছেন। তবে এমপিদের বাসভবনে থাকছেন এতেই তারা খুশি। কেননা বিশেষ বাসভবন হওয়ায় এসব ফ্ল্যাটে রয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা। তবে এমপিদের বাসভবনে অন্যদের থাকার সুযোগ নেই বলে জানা গেছে। ন্যাম ভবনের নিরাপত্তাকর্মীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, মানিকমিয়া অ্যাভিনিউয়ে ন্যাম ভবনের ছয়টি বিল্ডিংয়ে ২১৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এসব ফ্ল্যাট এক হাজার ৮০০ বর্গফুটের। প্রতিটি ফ্ল্যাটে তিনটি বেডরুম, একটি ড্রয়িংরুম, একটি ডাইনিংরুম, একটি কিচেন ও দুটি বাথরুম রয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের পেছনে রয়েছে ব্যালকনি।

সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, এসব ভবনে বহিরাগতরা ততদিন সেখানে থাকতে পারবেন, যতদিন পর্যন্ত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না হবে। বসবাসকারীদের জন্য সংসদ সচিবালয় বিশেষ এই শর্তজুড়ে দিয়েছে। দেশের সচেতন নাগরিকরা বলছেন, এটি বেআইনি। এমপিদের প্রতি অসম্মানের শামিল।

সংসদ সচিবালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, জুলাই অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার পাশাপাশি এমপিরাও পালিয়ে যান। সংসদ বিলুপ্ত করা হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ কারণে দেশে বর্তমানে সংসদ কার্যক্রম এবং এমপি দুটির কোনোটিই নেই। তাদের অনুপস্থিতিতে বহিরাগতদের ঠিকানা হয় ন্যাম ভবনে। এ তালিকায় আছেন—আইনজীবী, আমলা, সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। যদিও সেখানে এমপিদের বাইরে অন্যদের থাকার কথা নয়। কিন্তু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সেখানে বহিরাগতদের থাকার সুযোগ দেওয়ায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছয়টি ভবনের চারটি এখন বহিরাগহতদের দখলে। ১ নম্বর ভবনে পুলিশ সদস্য, ২ নম্বরে আনসার সদস্য, ৩ নম্বরে আর্মির ক্যাম্প স্থাপন করে সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিকরা এবং ৬ নম্বর ভবনে সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির অধীন কৌঁসুলিরা (যাদের পদমর্যাদা সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল) বসবাস করছেন। বাকি দুটি ৪ ও ৫ নম্বর ভবন বসবাস অনুপযোগী ছিল।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১ নম্বর ভবনে প্রায় ২০০ পুলিশ সদস্য রয়েছেন। এ কারণে একটি কক্ষে কয়েকজন করে গণরুম হিসেবে গাদাগাদি করে থাকছেন। ২ নম্বর ভবনে জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এপিবিএন আনসার সদস্যরা চারটি ফ্ল্যাটে থাকছেন। আর্মি অফিসার, কমান্ডার থেকে সৈনিকরা পুরো ৩ নম্বর ভবনে বসবাস করছেন। আর ৬ নম্বর ভবনে সংসদ সচিবালয়ের সচিব, যুগ্ম সচিবসহ চারটি পরিবার আলাদা ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন।

এ বিষয়ে জানতে সংসদ সচিবালয়ের সচিব মিজানুর রহমানকে কল করা হলে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে সচিবের একান্ত সচিব পরিচয়ে শাহেল আহমেদ নামে একজন প্রতিবেদককে কল করেন। ওনার স্যারকে কী প্রয়োজনে কল করা হয় জানতে চান। তাকে পুরো বিষয় খুলে বলার পর তিনি এই বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করেননি।

একইভাবে এ ভবনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদমর্যাদার সরকারি কৌঁসুলি থাকছেন পাঁচটি ফ্ল্যাটে। সংসদের আবাসন থেকে জানা যায়, সাতটি ফ্ল্যাটে বসবাসের জন্য আবেদন করেছিল অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরের অফিস। দুটি ছাড়া বাকিগুলোকে বসবাস করছেন তার অধীনস্থরা।

সংসদ সচিবালয়ের হোস্টেল শাখার সহকারী সচিব আলম মিয়া আমার দেশকে জানান, এমপিদের ন্যামভবনে ৫ আগস্টের পর অনেকেই থাকছেন। সবাই আবাসনের আবেদন করেন। যারা আছেন নিয়ম মেনে থাকছেন।

এসব বাসভবনে এমপিদের বাইরে অন্য কারো বসবাসের সুযোগ আছে কি নাÑ জানতে চাইলে আলম মিয়া বলেন, আইন দেখে আপনাকে বলত হবে। তবে সেখানে পুলিশ, আনসার, ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির অফিসের কয়েকজন থাকছেন। ৪ ও ৫ নম্বর ভবনে কেউ নেই। প্রতিটি ফ্ল্যাটের বিপরীতে শুধু প্রসিকিউটর অফিসের যারা আছেন, ওনারা তাদের বেসিকের ৩০ হাজার টাকা করে ভাড়া দিচ্ছেন। বাকিরা কোনো ভাড়া দেন না।

সংসদ সচিবালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে বলেন, বিশেষ কারণে এবার কোনো এমপি নেই। তারা না থাকলে সেখানে অন্যদের থাকার কথা নয়। কারণ তাদের জন্য বরাদ্দ করা এই ভবনে নামমাত্র ভাড়ার বিনিময়ে সরকার বরাদ্দ করেছে। যথাক্রমে ভাড়ার হার দুই হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা। সংসদ না থাকলে অতীতে সেখানে কাউকে থাকতে দেওয়ার নজির নেই। এই প্রথম সংসদ সদস্যদের আবাসনে বহিরাগতরা থাকছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আমার দেশকে বলেন, বর্তমানে আইন অনুযায়ী কিছুই চলছে না। এমপিদের বাসভবনে অন্যদের থাকার সুযোগ নেই। যদি কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেটাও বেআইনি। এটি আইনপ্রণেতাদের জন্য অসম্মানজনক।

সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধির ২৫০ অনুচ্ছেদে সংসদ কমিটির কাজ নির্ধারণ করার কথা বলা আছে। এ কমিটি সংসদ সদস্যদের আবাসিক ব্যবস্থাসম্পর্কিত সব কাজ, ঢাকায় অবস্থিত সদস্য ভবনসমূহে সদস্যদের দেওয়া আবাসিক ব্যবস্থা, খাদ্য, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ওপর তত্ত্বাবধান করা এবং কমিটির কাজ হবে উপদেশমূলক। কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, সংসদ কমিটির সভাপতি থাকবেন চিফ হুইপ। কিন্তু বর্তমানে সংসদ ও সংসদীয় কার্যক্রম কোনোটিই নেই। ফলে এসব কার্যক্রম সংসদ সচিবালয়ের সচিবের ওপর অর্পিত হয়েছে। এ ছাড়া সংসদ সদস্যদের আবসানগুলো তদারকের দায়িত্ব সংসদ সচিবালয়ের হোস্টেল শাখার।

নীতিমালায় বলা আছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা আইন প্রণেতা কিংবা সংসদ সদস্যদের বাইরে অন্য কেউ সেখানে থাকতে পারবেন না। কিন্তু নীতিমালা লঙ্ঘন করে বহিরাগতরা দিব্যি বসবাস করছেন।

জানতে চাইলে সংসদ সচিবালয়ের হোস্টেল শাখার সহকারী সচিব আলম মিয়া আমার দেশকে বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী এমপিদের বাইরে কারো থাকার কথা নয়। তবে অনেকেই থাকছেন।

অষ্টম সংসদে সংসদ বহাল ছিল। স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা এবং প্রধান হুইপ ও হুইপদের সবাই সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু সংসদীয় কার্যক্রম ছিল না। তবে ব্যতিক্রম শুধুমাত্র সংসদটি। কারণ সংসদটি ভিআইপিশূন্য।

এদিকে অষ্টম সংসদের মেয়াদ শেষ হয় ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর। রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে সেনা সমর্থিত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার টানা দুই বছর সরকার পরিচালনা করেছিল। ওই সরকারে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা। তিনি এমপিশূন্য ন্যাম ভবনগুলোকে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তৎকালীন স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের কাছে। কিন্তু উপদেষ্টার প্রস্তাবটি নাকচ করে সাবেক স্পিকার বলেছিলেন, পরবর্তী সংসদ কার্যক্রম শুরু না হওয়া পর্যন্ত এমপিদের বাসভবনগুলো সংরক্ষিত থাকবে। ভবনগুলোয় শুধু জনপ্রতিনিধিরাই থাকবেন। এর বাইরে কাউকে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।

২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান সংসদ সচিবালয়ের সাবেক সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ। এখন তিনি সংসদ ভবনের এ-টু বাসায় বসবাস করছেন। অবসরের আগে বাসাটির জন্য গণপূর্তের কাঠের কারখানা থেকে ১৪ লাখ টাকার ফার্নিচার নেন। এই বাসায় থাকতেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসবভন লাগোয়া এ বাসায় সব সময় ভিআইপিরা থেকেছেন। তবে এবারই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে।

জানতে চাইলে সংসদ সচিবালয়ের সাবেক সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ আমার দেশকে বলেন, সংসদ সদস্যদের বাসভবনে তাদের অবর্তমানে কারো থাকার সুযোগ নেই। এমনকি নীতিমালায়ও নেই। তবে পরিত্যক্ত হিসেবে এবং বাড়িগুলোর সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর স্পিকারের অবর্তমানে অধ্যাদেশ জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা এবং সংসদ সচিবালয়ের সচিবকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে ন্যাম ভবনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সহকারী কয়েকজন কৌঁসুলিকে আমি সচিব থাকা অবস্থায় থাকার অনুমতি দিয়েছিলাম।

তিনি বলেন, আমার অবসরের পর নতুন করে কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কি না, আমি তা জানি না। অবসরের পর ভিআইপিদের বাসায় কেন আপনি এখনো থাকছেনÑজানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, যে কোনো সময় এখান থেকে চলে যেতে পারি। কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলাম, তাই বিলম্ব হচ্ছে। কারণ দুই জায়গার ভাড়া গুনতে হচ্ছে আমাকে।