কোটি কোটি টাকার মালিক, যাকে বলা হত ক্রিপ্টোমুদ্রার মুকুটহীন সম্রাট। অথচ জীবন শেষ হয় কারাগারের কালো কুঠুরিতে। সবশেষে আত্মহত্যা করে শেষ করেন নিজেকে। বলছিলাম অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার সংস্থা ‘ম্যাকাফি’র প্রতিষ্ঠাতা জন ডেভিড ম্যাকাফির কথা।
২০২১ সালের জুনে স্পেনের বার্সেলোনার একটি কারাগারে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় ম্যাকাফিকে। পুলিশ জানিয়েছিল, আত্মহত্যা করেছেন তিনি। বর্ণময় চরিত্রের ম্যাকাফি কেন আত্মহত্যা করলেন তা আজও রহস্য।
পুলিশের দাবি ছিল, স্পেনের জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন ম্যাকাফি। আর সে কারণেই নাকি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি। ম্যাকাফির বর্ণময় জীবনে ছিল ঘটনার ঘনঘটা। জীবিত অবস্থায় বিতর্কের জেরে বহুবার সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসেন তিনি।
ম্যাকাফির জন্ম ইংল্যান্ডের গ্লাস্টারশায়ারের সিন্ডারফোর্ডে। পরে আমেরিকায় চলে যান তিনি। যখন ম্যাকাফির ১৫ বছর বয়স, সেই সময় তার বাবা আত্মহত্যা করেন। সেই মৃত্যু তার মনে গভীর ছাপ ফেলে।
কম্পিউটার প্রোগ্রামার এবং ব্যবসায়ী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন ম্যাকাফি। আমেরিকার লিবার্টারিয়ান পার্টির সক্রিয় সদস্যও ছিলেন তিনি।
অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার তৈরি করে প্রযুক্তিক্ষেত্রে ঝড় তুলেছিলেন ম্যাকাফি। তবে যে সংস্থার জেরে এত নামযশ হয়েছিল, পরবর্তীতে সেই সংস্থাকে ১০ কোটি ডলারে বিক্রি করে দেন। পরে বিনিয়োগ শুরু করেন আবাসন শিল্পে। কিন্তু ২০০৮ সালে এই শিল্প মুখ থুবড়ে পড়লে তিনি বড়সড় ধাক্কা খান। পরবর্তীতে বিটকয়েনেও বিনিয়োগ করেছিলেন ম্যাকাফি। বিস্তর আয়ও করেন ক্রিপ্টোমুদ্রা থেকে।
২০০৯ বছর ম্যাকাফির বিরুদ্ধে এক প্রতিবেশীকে খুনের অভিযোগ ওঠে। সেই সময় ম্যাকাফি বেলিজে থাকতেন। তার দু’টি কুকুরের চিৎকার নিয়ে প্রতিবেশী গ্রেগরি ফাউলের সঙ্গে বচসা শুরু হয়। পরে গ্রেগরিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার মাথায় দু’টি গুলির চিহ্ন ছিল। অভিযোগ ওঠে ম্যাকাফির বিরুদ্ধেই।
বেলিজে থাকাকালীন ম্যাকাফির বিরুদ্ধে মাদক রাখা এবং বেআইনি কার্যকলাপে যুক্ত থাকারও অভিযোগ ওঠে। মনে করা হয়, বেলিজে নিজস্ব একটি ‘হারেম’ ছিল ম্যাকাফির। সেখানে তিনি একাধিক নারীদের সঙ্গে থাকতেন। যৌবন ধরে রাখতে প্রতি সপ্তাহে টেস্টোস্টেরন হরমোনের ইঞ্জেকশনও নিতেন।
বন্দুকের শখ ছিল ম্যাকাফির। বিভিন্ন ধরনের বন্দুকের মালিকও ছিলেন। প্রায়শই সেই সব বন্দুক নিয়ে ছবি তুলতে দেখা যেত তাকে।
বলা হয়, ম্যাকাফিকে পঞ্চাশেরও বেশিবার খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যেক বারই তিনি প্রাণে বাঁচেন। পাশাপাশি অবৈধ কার্যকলাপের জন্য তিন দেশের পুলিশ নাকি তাকে খুঁজছিল।
ম্যাকাফির ব্যক্তিগত জীবনও ছিল রঙিন। তিনটা বিয়ে করেছিলেন তিনি। তার তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন যৌনকর্মী। অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের জন্য ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ম্যাকাফিকে গ্রেফতার করে গুয়াতেমালা সরকার। গুয়াতেমালা থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর ম্যাকাফিকে আমেরিকায় ফেরত পাঠানো হয়।
আমেরিকা পৌঁছে ফ্লোরিডার মিয়ামি বিচে তার থেকে ৩০ বছরের ছোট যৌনকর্মী জ্যানিস ডাইসনের সঙ্গে আলাপ হয় ম্যাকাফির। একসঙ্গে রাত্রিযাপন করেন তারা। সেই থেকে তাদের সম্পর্কের শুরু। ২০১৩ সালে বিয়েও করেন তারা। বিয়ের পর ওরেগনের পোর্টল্যান্ডে চলে আসেন দম্পতি।
ম্যাকাফির বিরুদ্ধে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে একাধিক মামলা চলছিল। একটি মামলায় যুক্তরাষ্ট্র তার প্রত্যর্পণ চায়। স্পেনের একটি আদালত তার অনুমতি দেয়।
সেই রায়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ম্যাকাফির মৃত্যু হয়। পুলিশে দাবি, জেলে ঝুলন্ত অবস্থায় তার দেহ উদ্ধার হয়। স্পেনের একটি সংবাদমাধ্যম সেই সময় দাবি করেছিল, রায় শুনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ব্যবসায়ী। জেলের চিকিৎসকেরা তাকে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। রায় শোনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি আত্মহত্যা করেন।
কর ফাঁকি থেকে শুরু করে খুন, একাধিক অভিযোগ ছিল ম্যাকাফির বিরুদ্ধে। বিপুল কর ফাঁকির অভিযোগ এড়াতে ২০২০ সালে তিনি আমেরিকা থেকে স্পেনে পালিয়ে যান। কিন্তু বার্সেলোনা বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
জেলে থাকাকালে টুইটও করেন ম্যাকাফি। সেই টুইটে লিখেছিলেন, ‘আমি এখানে সন্তুষ্ট। আমার বন্ধু আছে। খাবার ভাল। সব ঠিক আছে। ওই টুইটে আরও লিখেছিলেন, ‘জেনে রেখো, আমি যদি নিজেকে ফাঁসিতে ঝোলাই, সেটা আমার কোনো দোষ নয়। তার এই টুইটকে কেন্দ্র করে বিতর্কও তৈরি হয়েছিল।
অনেকের দাবি, তার ওই টুইটের অন্য অর্থ ছিল। সফটওয়্যার সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা নাকি বোঝাতে চেয়েছিলেন, খুন করে তাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হতে পারে।
ম্যাকাফির আইনজীবীরও দাবি ছিল, ম্যাকাফিকে কখনোই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মনে হয়নি তার। তার সঙ্গে যে সব সাংবাদিক জেলে দেখা করতে যেতেন, তাদেরও একাংশ একই দাবি করেন। তাই তার মৃত্যু নিয়ে রহস্য থেকে গিয়েছে আজও।
