Image description
১৭ বছর কেটেছে কারাগার আর আদালতের বারান্দায়
  • ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা মামলা
  • ২০০০ সালের ২০ জুলাইয়ের কোটালিপাড়ায় হেলিপ্যাডে বোমা পুঁতে রাখা মামলা
  • ২০০১ সালের ৩ জুনে গোপালগঞ্জে বানারীপাড়ায় গির্জায় বোমা হামলা মামলা
  • ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিলের রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলা
  • ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা
  • ২০০৮ সালে মোহাম্মদপুর থানায় আরো ২টি মামলা দায়ের করা হয়

মাত্র ২০ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন এএসপি ফজলুল কবির। আর সেই টাকা না দেয়ায় রাষ্ট্রের সব স্পর্শকাতর মামলায় আসামি করা হয় সুমনকে। ন্যায়বিচারের আশায় গত ১৭ বছর ধরে আদালতের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে সুমনের পরিবার।

সুমনের পরিবার জানায়, ২০০৮ সালের ১২ এপ্রিল ঢাকার মালিবাগে অবস্থিত সিআইডি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে গ্রেফতার দেখানো হয় ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র আরিফ হাসান সুমনকে। সিআইডির রেজিস্ট্রি খাতায় নিজের নাম, ঠিকানা, তারিখ এবং সময় উল্লেখ করে সিআইডি কার্যালয়ে প্রবেশ করেন সুমন। তারপর থেকে আজও ঘরে ফেরা হয়নি সুমনের। সেই থেকে জেলখানা আর আদালতের বারান্দাই সুমনের ঠিকানা। রাষ্ট্রের এমন কোনো স্পর্শকাতর মামলা নেই যে মামলায় সুমনকে আসামি করা হয়নি।

পারিবারিক সূত্র জানায়, ঢাকার মোহাম্মদপুরে সুমনদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দীন আহমেদ। তার সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য ২১ আগস্ট মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি ফজলুল কবির সুমনকে সিআইডি কার্যালয়ে দেখা করতে বলেন। তারই ডাকে সুমন নিজের গাড়িতে করে ড্রাইভারসহ ঢাকার মালিবাগের সিআইডি কার্যালয়ে যান।

সেদিন পুলিশ সুমনের সাথে কথা বলে এবং তাকে সারা দিন বসিয়ে রেখে বিকেলে সুমনের ছবি তুলে সেই ছবি দু’জন পুলিশ সদস্যকে দিয়ে রাতেই পাঠিয়ে দেন সে সময় সিলেট কারাগারে আটক হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি হান্নানের কাছে। যে দু’জন পুলিশ সদস্যকে সিলেটে পাঠানো হয়েছিল তাদের একজন ছিলেন এসআই কুদ্দুস, আরেকজন ছিলেন রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার সপ্তম তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আবু হেনা মুহাম্মদ ইউসুফ।

উদ্দেশ্য ছিল মুফতি হান্নানের পূর্বে দেয়া জবানবন্দীতে হাসান নামে ঢাকা কলেজের এক ছাত্র তাদের সাথে জড়িত ছিল বলে জানান। সেই হাসান আর আরিফ হাসান সুমন একই ব্যক্তি কিনা সেটা যাচাই করা।

মুফতি হান্নান সুমনের ছবি দেখে পুলিশ সদস্যদেরকে জানিয়ে দেন যে, যার ছবি দেখানো হচ্ছে তাকে তিনি চেনেন না। এই তথ্য তখনই রমনা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবু হেনা মুহাম্মদ ইউসুফ ফজলুল কবিরকে ফোনে জানিয়ে দেন এবং ১৩ তারিখ তারা ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর শুরু হয় সুমনের পরিবারের সাথে দরকষাকষি। জানানো হয় টাকা দিলেই ছেড়ে দেয়া হবে সুমনকে, তা না হলে সুমনের সমস্যা হবে। পুলিশের একটি সোর্সের মাধ্যমে চাওয়া হয় ২০ লাখ টাকা। এত টাকা দিতে পারবে না বলে জানায় সুমনের পরিবার। রাতারাতি আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে দুই লাখ টাকা ম্যানেজ করে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের কাছে সেই টাকা দেন যেন তা পুলিশের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়। তিন বোন আর এক ভাইয়ের সংসারে সুমনই ছিলেন পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য। সুমনের বাবা মারা যান ২০০৫ সালে। তারপর থেকে সুমনের কাঁধেই ছিল পরিবারের দায়িত্ব।

দূর সম্পর্কের যে আত্মীয়কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পুলিশকে টাকা পৌঁছে দেয়ার তিনি সেই টাকা পুলিশের কাছে পৌঁছে না দিয়ে তৎকালীন সময়ের ঊর্ধ্বতন এক ব্যক্তিকে দিয়ে ফোন করান ফজলুল কবিরের কাছে যেন সুমনকে ছেড়ে দেয়া হয়। আর এতেই ক্ষিপ্ত হন ফজলুল কবির। টাকা না পাওয়া এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানোতে সুমনের লাইফ শেষ করে দেয়ার হুমকি দেন এএসপি ফজলুল কবির।

তার একদিন পরেই ১৪ এপ্রিল ছিল পয়লা বৈশাখ আর সেদিনই সুমনকে রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়। পুলিশ মিডিয়াকে জানায়, মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে সাত বছর পর রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার আসামি জঙ্গি হাসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

২০০১ সালে ১৪ এপ্রিল ঘটনার সময় সুমনের বয়স ছিল ১৬ বছর ৭ মাস। সুমনের জন্ম ১৯৮৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। তাকে গ্রেফতার দেখানো হয় ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল। এরপর দুই দফায় পাঁচ দিন করে মোট ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে রমনা মামলায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায় করা হয়।

রমনা মামলার রিমান্ড শেষে তাকে আবার রিমান্ডে নেয়া হয় একুশে আগস্ট বোমা হামলা মামলায়। প্রথমে তিন দিন তারপর আবার দু’দিন। এই মামলাতেও রিমান্ডে নিয়ে তাকে উল্টো করে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে, ইলেকট্রিক শক দিয়ে, নানা রকম অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী না দিলে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। ফজলুল কবির এতটাই হিংস্র হয়ে ওঠেন যে, বাসার ল্যান্ডফোনে কল করে সুমনকে নির্যাতনের আর্তনাত শুনান।

সুমনকে গ্রেফতার দেখানো হয়, ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি সিপিবি সমাবেশে বোমা হামলা মামলায়, ২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালিপাড়ায় হেলিপ্যাডে বোমা পুঁতে রাখা মামলায়, ২০০১ সালের ৩ জুন বানারীপাড়ায় গির্জায় বোমা হামলা মামলায়। এ ছাড়াও ২০০৮ সালে তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় আরো দুটো মামলা দায়ের করা হয়।

প্রায় ৩০ দিন রিমান্ডে রাখা হয়েছিল তাকে। যেসব ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে তার বেশির ভাগ ঘটনা হচ্ছে ২০০০, ২০০১ এবং ২০০৪ সালের, যে সময়ে সুমন বয়সে একজন শিশু।

২০০৫ সালে পিতার মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলে হিসেবে পিতার ব্যবসা বাণিজ্য ও বাড়িঘর পরিবার সুমনই দেখাশুনা করত। সুমন ২০০০ সালে ‘ও‘ লেভেল এবং ২০০১ সালে ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে পড়াশুনা করেছিলেন। অথচ ২০০০ সালের এক মামলায় সুমনকে দেখানো হয়েছে মুফতি হান্নানের কোটালিপাড়ায় সাবানের ফ্যাক্টরিতে কাজ করা এক হাসান হিসেবে। কোটালিপাড়া হেলিপ্যাডে বোমা পুঁতে রাখা ঘটনায় মুফতি হান্নানদের সাথে তাদের সাবানের কারখানায় কাজ করত এক হাসান। সেই হাসান হিসেবে আরিফ হাসান সুমনকে আসামি করে দেয়া হয়। চার্জশিট ঘেঁটে দেখা যায় ২০০০ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় তখন নির্বাচনের আগে সংসদ থেকে শেখ হাসিনার পরিবারের আজীবন নিরাপত্তা বিল পাস করানোর জন্য শেখ হাসিনার নির্দেশেই সেখানে বোমা পুঁতে রাখার নাটক করা হয়েছিল, যেটা মুফতি হান্নানের ছোট ভাই আনিস তার আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানিয়েছিলেন।

সুমনের পরিবারের অভিযোগ, রমনা মামলার ঘটনায় ত্রুটিপূর্ণ চার্জশিটের পরও বিচারিক আদালতে ঘটনাটিকে জঙ্গি ঘটনা হিসেবে অতি গুরুত্ব দিয়ে আসামিদের প্রতি ন্যায়বিচার না করে ফরমায়েশি রায় দিয়েছেন মর্মে অভিযোগ রয়েছে।

একেক সময় একেক তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে একেক আসামির কাছ থেকে নেয়া ১৬৪ ধারা জবানবন্দীতে কোনো রকম মিল না থাকা, চার্জশিটে নাম না থাকা, কোনো সাক্ষী আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেয়া, এমনকি সুমন ও অন্য আসামিদের কাছ থেকে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে তা জানিয়ে জবানবন্দী প্রত্যাহারের আবেদন করার পরও রমনা হামলা মামলায় সুমনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। ২০১৪ সালে নিম্ন আদালতে মামলাটির রায় হয়। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সুমন ও অন্যান্য আসামি উচ্চ আদালতে গেলে সেখানে শুনানির পর রাষ্ট্রপক্ষ যখন দেখেন কোনো যুক্তিতেই সুমন এবং এই মামলার অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে দেয়া নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখা সম্ভব নয়, তখন সরকারপক্ষ বারবার আদালত পরিবর্তন করেন। উচ্চ আদালতে চারবার আদালত পরিবর্তন করে দীর্ঘ ১০ বছরে ২১০ বার মামলা লিস্টে এলেও আসামি পক্ষকে মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানি করতে দেয়া হয় নাই। আওয়ামী সরকারের অ্যাটর্নিরা বারবার আদালতকে বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে বলে মামলাটি আটকে রাখেন বলে সুমনের পরিবার অভিযোগ করেছে।

২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টনে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সেই মামলাতেও আসামি করা হয় সুমনকে। সেই সময় সুমন একজন ১৫ বছর ৪ মাসের শিশু। এই মামলাতে সুমনের বিরুদ্ধে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। এই ঘটনাতেও না আছে তার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী, না আছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনো সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ। তবুও ১৯ বছর পর ২০২০ সালে হওয়া এই মামলার রায়ে সুমনের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়।

এই বিষয়ে সুমনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, স্পর্শকাতর মামলাগুলো শেষ করাই যেন লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা সরকারের। তড়িঘড়ি করে যেনতেনভাবে তদন্ত করে বা তদন্তের নামে প্রহসন করে নিরীহ অনেককে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদেরই একজন আরিফ হাসান সুমন। অভিযোগ রয়েছে এসব মামলায় যারাই তদন্তকারী কর্মকর্তা হয়েছেন তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন। অনেক নিরপরাধ মানুষকে টাকা না পেয়ে এই মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন তদন্তকারীরা।

আইনজীবী জানান, প্রথম থেকেই আদালতের কাছে আমরা জানিয়ে আসছিলাম মুফতি হান্নানের দেয়া ঢাকা কলেজের ছাত্র হাসান আর আমার মক্কেল আরিফ হাসান সুমন এক ব্যক্তি নন। আমার মক্কেল আরিফ হাসান সুমন কখনই ঢাকা কলেজে পড়েন নাই এবং মুফতি হান্নান নিজেও পরবর্তীতে আদালতে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন যে, এই আরিফ হাসান সুমনকে তিনি চিনতেন না। যে হাসানের কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন সেই হাসান আর আরিফ হাসান সুমন একই ব্যক্তি নন। তারপরও জঙ্গি তকমা লাগিয়ে তার সুন্দর ভবিষ্যৎকে কারাগারে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। তার জীবন থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে ১৭টি বছর। সুমনের সাথে যে অন্যায় ঘটেছে তা অকল্পনীয় অন্যায়।

সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে সুমন ২১ আগস্ট মামলায় বেকসুর খালাস পান। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর থানার দুটো মামলা ও কোটালিপাড়ার হেলিপ্যাডে ৭৬ কেজি বোমা মামলায় বিচারিক আদালত থেকে বেখসুর খালাস পাওয়ার পরও রমনা ও সিপিবি সমাবেশে বোমা হামলা মামলায় নিম্ন আদালতে সাজা ও উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়ায় কারাগারে আটক রয়েছেন সুমন।