Image description

তুরস্কে ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও ইস্তানবুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুর গ্রেফতারের পর থেকে ক্রমেই পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের।

 

তুরস্কে ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও ইস্তানবুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুর গ্রেফতারের পর থেকে ক্রমেই পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই দশকের বেশি সময় ক্ষমতা ধরে রাখার পর রাজনৈতিকভাবে এবারই সবচেয়ে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তিনি। এর আগে ২০১৬ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে উৎখাতের প্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়েছিল এরদোগানের সমর্থক ও অনুগত সেনা কর্মকর্তারা। তবে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাওয়া তুরস্কে এবারের এরদোগানবিরোধী বিক্ষোভ আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত আকার নিয়েছে।

বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন এরদোগানবিরোধী বিক্ষোভে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। ব্যাপক ধরপাকড় ও পুলিশের মারমুখী অবস্থান সত্ত্বেও এ বিক্ষোভ দমন করতে পারছে না এরদোগান সরকার। যেকোনো সময় তা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা।

এ বিক্ষোভের সূত্রপাত বুধবার ইস্তানবুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুর গ্রেফতারের পর। এর পরপরই বিরোধী দল উদারপন্থী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) দেশটির জনগণকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানায়। তাতে সাড়া দিয়ে প্রথমে ইস্তানবুলের রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ তুর্কি জনগণ। রাজধানী আঙ্কারা ছাড়াও উপকূলীয় ইজমির ও দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আদানায় গতকাল পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।

 

বিরোধী দল ও ইমামোগলুর সমর্থকদের অভিযোগ, ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই থেকে সরিয়ে দিতেই ইস্তানবুলের মেয়রকে গ্রেফতার করিয়েছেন এরদোগান। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ গ্রেফতার এরদোগানের সরকারকে এখন গুরুতর ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে একজন জনপ্রিয় বিরোধী নেতাকে দমনের এ কৌশল তুরস্কের পরিস্থিতিকে আরো উত্তাল করে তুলেছে, যা শেষ পর্যন্ত এরদোগান শাসনামলের অবসান ঘটাতে পারে।

 
SDAZDUXSB5JJJN4PK76ATV6SPA

 

গ্রেফতারের আগের দিন মঙ্গলবার ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয় ইমামোগলুর ডিগ্রি বাতিল করে। দেশটিতে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে হলে ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ধরনের কৌশল দেশটির মানুষকে ব্যাপক বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। বৃহস্পতিবার রাতেও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই বিক্ষোভকারীরা দ্বিতীয় দিনের মতো ইস্তানবুলের রাস্তায় নেমে আসে। তাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে তুর্কি পুলিশ। এর পর গতকাল তা তুরস্কের অন্যান্য বড় শহরে ছড়িয়ে পড়ে।

ইমামোগলুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তার অভিযোগ এনেছে এরদোগান সরকার। তার সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছে আরো ১০৫ জনকে, যাদের অধিকাংশই সিএইচপির শীর্ষ নেতা। তুরস্কের কর্তৃপক্ষ সোশ্যাল মিডিয়ার উসকানিমূলক পোস্টের জন্যও কয়েক ডজন মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় এরদোগানের অভিযোগ, বিরোধীরা রাস্তায় ‘অভিনয়’ করছে। তিনি বলেন, ‘তারা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। পুলিশকে আক্রমণ করছে, বিচারক ও প্রসিকিউটরদের হুমকি দিচ্ছে।’

ইস্তানবুল সিটি হলের বাইরে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে ইমামোগলুর দলীয় সহযোগী ও সিএইচপি নেতা ওজগুর ওজেল প্রতিবাদকারীদের সমর্থন করে সরকারের বিরুদ্ধে ‘অভ্যুত্থান’ চেষ্টা করার অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের বিক্ষোভ করার অধিকার রয়েছে।’ ইমামোগলুর এক্স অ্যাকাউন্টে বৃহস্পতিবার একটি বার্তা পোস্ট করা হয়, যাতে তুরস্কের জনগণকে ‘শয়তানের’ বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়। এতে বিচার বিভাগ এবং এরদোগানের দলের সদস্যদের অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানানো হয়। এক্স হ্যান্ডেলে লেখা হয়, ‘এটা শুধু আমাদের দল এবং রাজনৈতিক আদর্শের বিষয় নয়। এখন সময় এসেছে আমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করার।’

বর্তমান পরিস্থিতি এরদোগানকে তুরস্কের ভেতরে ও বাইরে—দুদিক থেকেই চাপে ফেলছে বলে মনে করছেন ব্রিটিশ থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের বিশ্লেষক গালিপ দালায়। এক বিশ্লেষণে তিনি লিখেছেন, ‘ইউরোপের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্ক জোরদার করার যে আশা এরদোগানের রয়েছে তা ইমামোগলুর গ্রেফতারে ক্ষুণ্ন হতে পারে। সব মিলিয়ে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়বেন এরদোগান। ইস্তানবুলের মেয়র পদটি প্রেসিডেন্টের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখন যা দেখছি তা পারস্পরিক সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলবে।’

স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ইমামোগলু এবং অন্যদের গ্রেফতার সাম্প্রতিক মাসগুলোয় একটি বড় ধরনের অভিযানের অংশ, যেখানে বিরোধী রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন, ভীতি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে আগামী সপ্তাহগুলোয় আরো বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হতে পারে। তবে ইমামোগলুর গ্রেফতারের পেছনে এরদোগানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তুরস্কের বিচার মন্ত্রণালয় বলছে, ‘দেশে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ রয়েছে।’

ইমামোগলু গত বছর ইস্তানবুলের মেয়র হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ী হন, যখন তার দল সিএইচপি স্থানীয় নির্বাচনে ইস্তানবুল ও আঙ্কারায় জয়লাভ করে। এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবারের মতো তার দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (এ কে পার্টি) দেশব্যাপী স্থানীয় নির্বাচনে পরাজিত হয়। এটা ছিল এরদোগানের জন্য বড় ধাক্কা, যার রাজনৈতিক জীবনের শুরুটাই হয়েছিল ইস্তানবুলে। এমনকি ক্ষমতায় আসার আগে তিনি নিজেও এ শহরের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন।

এরদোগান ২২ বছর ধরে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মেয়াদসীমার কারণে ২০২৮ সালে সংবিধান পরিবর্তন না করলে আবার নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। সংবিধান পরিবর্তন করে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তাকে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্থানীয় নির্বাচনে ইমামোগলুর দলের কাছে এরদোগানের হারে এরই জোর ইঙ্গিত পাচ্ছেন পর্যবেক্ষকরা। এ কারণে তিনি বিরোধীদের দমন-পীড়নের ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি।

আসন্ন নির্বাচনে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশঙ্কায় ইমামোগলুর প্রার্থিতা শুরুতেই বন্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্য থেকে এরদোগান তাকে গ্রেফতারের মতো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে মনে করছেন থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির সিনিয়র ফেলো সোনের চাগাপটাই।

তবে গত কয়েক মাসে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ অনুকূল সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন এরদোগান। ইউরোপের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দূরত্ব কমে আসছিল। ন্যাটোয় মিত্রদেশ হিসেবে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছিল আঙ্কারা। কমছিল দীর্ঘদিন ধরে লাগামহীন অবস্থায় থাকা তুরস্কের মূল্যস্ফীতিও। এমনকি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ৪০ বছরের বিদ্রোহ শেষ হওয়ার ইঙ্গিতও দেখা যাচ্ছিল। আস্থা ফিরছিল বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরও। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইমামোগলুর গ্রেফতারের পর ফের বদলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। ইমামোগলুর গ্রেফতারের খবর প্রকাশের পর তুর্কি লিরার দ্রুত অবমূল্যায়ন ঘটছে। ইস্তানবুল স্টক এক্সচেঞ্জের গড় মূল্যসূচক হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ।

ইমামোগলুর গ্রেফতারের ঘটনায় তুরস্কের অর্থনীতিকে আবারো বড় ধরনের ধসের মুখে ঠেলে দিয়েছে বলে ক্যাপিটাল ইকোনমিকসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এসব ঘটনা তুরস্কের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। একই সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এরদোগানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও।