
ইসরাইলের বর্বর যুদ্ধে ফিলিস্তিনে বেড়ে উঠছে মানসিক মারাত্মক ক্ষত নিয়ে একটি প্রজন্ম। স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে গেছে তাদের কাছ থেকে। ঘুমাতে যেতে হয় গগনবিদারী বোমা হামলার আতঙ্ক বুকে নিয়ে। ঘুম থেকে উঠে দেখে তার চারপাশে ধ্বংসস্তূপ অথবা কোনো কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে আছে। যার সঙ্গে খেলা করতো, সেই সব বন্ধুবান্ধবীদের মাথা থেঁতলে গেছে। রক্তের নদীতে যেন গোসল করেছে সে। অথবা যে পিতামাতার আদরে বড় হচ্ছিল তারা কেউ বেঁচে নেই। এসব দেখতে দেখতে এখন জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ গাজা, পশ্চিমতীরের শিশুরা। বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে তাদের জীবন। তাই এখন আর বাঁচতে চায় না তারা। তারা মৃত্যুকে কাছে ডাকে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক এজেন্সি ইউনিসেফের গত জুনের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, গাজার প্রায় ১২ লাখ শিশুর সবারই মানসিক সাপোর্ট প্রয়োজন। বারংবার মানসিক ক্ষতে তারা জীবনের বোধ হারিয়ে ফেলেছে। জানুয়ারিতে ইসরাইল ও হামাস যুদ্ধবিরতি ঘোষণার এক সপ্তাহ পরে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, মানসিক ক্ষত নিয়ে বড় হচ্ছে একটি প্রজন্ম।
তিনি বলেন, শিশুদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। তারা অনাহারে থাকতে থাকতে একসময় ক্ষুধার্ত অবস্থায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে। অনেক শিশু আছে, তারা জন্মের পর প্রথম নিঃশ্বাস নেয়ার আগেই মারা যাচ্ছে। মায়েরা তাদের জন্ম দেয়ার আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে মা ও গর্ভস্থ শিশুকে। জানুয়ারিতে প্রথম দফা যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও সোমবার রাতভর আবার ভয়াবহ বর্বর হামলা শুরু করেছে গাজায়। এতে শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবরের পর যে বাছবিচারহীন হামলা চালিয়েছে ইসরাইল, তাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। তার বেশির ভাগই নারী ও শিশু। হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র কিছুই বাদ যায়নি ইসরাইলের শ্যেন দৃষ্টি থেকে। জন্ম নিয়েই যে শিশু এমন পরিণতি দেখছে, তার কাছে জীবন হয়ে উঠেছে অর্থহীন। এ জন্য তারা এখন আর বাঁচতে চায় না। এই হায়েনার হামলার মধ্যে বেঁচে থাকার চেয়ে তারা এখন মৃত্যুকে কামনা করে। এমনই এক শিশু সামা তুবাইল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল নিজের চেহারা দেখে। তার হাতে চিরুনি। মাথা আঁচড়াতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছে যুদ্ধের আগের আয়না। সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবার নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে গিয়ে কেঁদে উঠছে সামা। তার বয়স আট বছর। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবরের আগে তার জীবন যেমন ছিল, তা কল্পনা করে। তখন ছিল তার লম্বা চুল। বন্ধুদের সঙ্গে গাজার জাবালিয়ায় খেলাধুলায় সময় কাটতো। কিন্তু গাজা থেকে যে ১৯ লাখ মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে তাদের মধ্যে সামা ও তার পরিবার অন্যতম। ইসরাইলি সেনাদের নির্দেশে তারা প্রথমে দক্ষিণের রাফা অঞ্চলে চলে যায়। সেখানেও যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এ সময় সামা ও তার পরিবার গাজার মধ্যাঞ্চল খান ইউনিসে শরণার্থী শিবিরে চলে যায়।
গত বছর চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখতে পান সামার মাথার সব চুল পড়ে গেছে। ‘নার্ভাস শক’-এর কারণে এমনটা হয়েছে। গত আগস্টে ইসরাইল বিমান থেকে রাফায় সামাদের প্রতিবেশীদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। এ সময়ই সে মানসিক ক্ষতে আক্রান্ত হয়। একে বলা হয় ‘অ্যালোপেসিয়া’। গত বছর ওয়ার চাইল্ড অ্যালায়েন্স এবং গাজাভিত্তিক কমিউনিটি ট্রেইনিং সেন্টার ফর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট এক রিপোর্টে বলে যে, গাজায় ইসরাইলের চলমান হত্যাযজ্ঞে শিশুদের মানসিকভাবে মারাত্মক ক্ষত করছে। বিপন্ন শিশুদের কমপক্ষে ৫০০ শিশুকে দেখাশোনা করে যারা তাদের ওপর একটি জরিপের রিপোর্টে দেখা যায়, ওই পরিস্থিতির শিকার এমন শতকরা ৯৬ ভাগ শিশু মনে করে তাদের সামনে মৃত্যু অত্যাসন্ন। প্রায় অর্ধেক শিশু বা শতকরা ৪৯ ভাগ শিশু ইসরাইলের এই নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা পেতে মৃত্যুকে বেছে নিতে পছন্দ করে। মাথা থেকে চুল পড়ে যাওয়ার জন্য সামাকে অন্য শিশুরা ক্ষেপায়। এ জন্য সামার মানসিক ক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে। এমন আচরণ থেকে রক্ষা পেতে সে ঘরের ভেতরে থাকে। কখনো ঘরের বাইরে গেলে মাথায় পরে একটি গোলাপি মাথা বন্ধনী। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সিএনএনের সাংবাদিক। এ সময় তার মা ওম মোহাম্মদের কাছে সামা আর্তি জানায়- ‘মা আমি খুবই ক্লান্ত। আমি মরে যেতে চাই। আমার মাথায় চুল নেই কেন? আমি মরে যেতে চাই। আল্লাহর ইচ্ছায় বেহেশতে আমার মাথায় আবার চুল থাকবে।’ ফেব্রুয়ারিতে সে আবার একই সাংবাদিককে বলে, আমাদের বাড়িতে বোমা হামলা করা হয়েছে।
এর ভেতরে আমার ছবি, সনদপত্র সহ দরকারি অনেক জিনিস ছিল। আমার পোশাক ছিল। ছিল অনেক জিনিসপত্র। কিন্তু বাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপর থেকে আমি আর এ বাড়িটি দেখতে পাই না। পরিবহন খরচ অনেক বেশি। যদি আমরা বাড়িতে ফিরে যাই তাহলে কোনো পানি পাবো না। কোথায় থাকবো তাও জানি না।
গাজায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়াও সব সময় একটি চ্যালেঞ্জ। গাজা কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামের পরিচালক ডা. ইয়াসের আবু জামেই বলেন, ইসরাইলের ১৫ মাসের নৃশংস যুদ্ধে তার স্টাফদেরও মানসিক মারাত্মক ক্ষত হয়েছে। ফলে তারা যে অন্যদের চিকিৎসা দেবে তাও জটিল হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ স্টাফই কাজ করছেন বাস্তুচ্যুত অবস্থায়। তাদের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগেরও কমের আছে বাড়িঘর। তবু তারা এখনো কিছু আশা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবারগুলোকে তারা সমর্থন দিচ্ছেন। শিশুরা বলে, আমার বন্ধুরা বেহেশতে চলে গেছে। কিন্তু তাদের একজনকে স্টাফরা দেখতে পায়, তার মাথা নেই। একটি শিশু তা দেখে চিৎকার করতে থাকে। বলতে থাকে, তার তো মাথা নেই। তাহলে কীভাবে সে বেহেশতে যাবে?
খান ইউনিসের আল মাওয়াসি শরণার্থী শিবিরে দাদী ওম-আলাবেদের সঙ্গে বসবাস করে সাত বছর বয়সী আনাস আবু ইশ এবং তার বোন ডোয়া (৮)। ইসরাইলের হামলায় পিতামাতাকে হারিয়েছে তারা। আনাস বলে, আমি বল নিয়ে খেলছিলাম। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে দেখি আমার পিতা ও মাতা রাস্তায় অবস্থান করছেন। একটি ড্রোন এলো এবং তাদের ওপর বোমা হামলা করলো। পিতামাতাকে কি মিস করো? এ প্রশ্নে নীরব নিথর আনাস। তার দু’গণ্ড গড়িয়ে অঝোরে ঝরতে থাকে অশ্রু। তার মুখে কোনো কথা থাকে না। তার দাদী ওম-আলাবেদ বলেন, যে ঘটনা ঘটে গেছে তাতে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত এই শিশুরা। অন্য অনেক শিশু তাদের মায়েদের হারিয়েছে। তাদের বেদনার সঙ্গে মিশে গেছে আনাসের কষ্ট। আনাস শুধু তার পিতামাতাকে হারিয়েছে এমন নয়। একই সঙ্গে নিরাপত্তা, আদর থেকে বঞ্চিত। সিএনএনের সাংবাদিক ডোয়ার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সে শুধু নিজের আঙ্গুলের নখ খোঁচাতে থাকে। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই কান্না শুরু করে। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়ার ইসরাইলি মনোবিজ্ঞানী ও প্রফেসর এডনা ফোয়া আশাবাদী যে, এসব শিশুরা মানসিক ক্ষত কাটিয়ে উঠবে। আমি এসব শিশুকে দেখেছি। তারা শুধু আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিছুই বলবে না। আবার তাদের চোখে কান্নাও নেই। শুধু তাদের চারপাশে শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। এসব শিশুকে নিয়ে আমি অধিক পরিমাণে উদ্বিগ্ন।
বাস্তুচ্যুতদের একই শিবিরে অবস্থান ৬ বছর বয়সী মানাল জোউদা’র। যে রাতে তার বাড়ি উড়িয়ে দেয় ইসরাইল সে রাতের কথা বেশ ভালোভাবে মনে আছে তার। ওই হামলায় নিহত হন তার পিতামাতা। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মানাল। সে অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করা হবে এ আশায় অপেক্ষা করতে থাকে। মানাল বলে- আমার মুখের ভেতর ছিল বালুতে ভর্তি। তবু আর্তনাদ করছিলাম। একটি শাবল দিয়ে কেউ একজন ধ্বংসস্তূপ খনন করছিলেন। একজন প্রতিবেশী বলছিলেন, এর ভেতরে মানাল আছে। এই যে, মানালকে পেয়েছি। এ সময়ই আমি সচেতন হই। ধ্বংসস্তূপের নিচে চোখ খুলি। আমার মুখ ছিল খোলা। ফলে আরও বালু এসে মুখ ভরে যাচ্ছে।