Image description

দেশের প্রধান চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। এ যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বড় ধরনের জয় পেয়েছে ইসলামি এ ছাত্রসংগঠন। দেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে কোনো ছাত্রসংগঠন ছাত্র সংসদগুলোতে এভাবে একচেটিয়া জয় কখনো পায়নি। চার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ভোট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শিবিরের প্রার্থীদের সঙ্গে প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেলের প্রার্থীর ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যায় বড় ব্যবধান ছিল।

ডাকসুতে ভোট হয় ৯ সেপ্টেম্বর। সেখানে কেন্দ্রীয় সংসদের ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৪৭১ জন প্রার্থী। নির্বাচনে শিবিরের নেতৃত্বে ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ ছাড়াও ছাত্রদল ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) পূর্ণ প্যানেলে নির্বাচনে অংশ নেয়। এ নির্বাচনে ভিপি, জিএস ও এজিএসসহ ১২টি সম্পাদকীয় পদের ৯টিতেই শিবিরের প্যানেলের প্রার্থী জয়ী হন। মোট ২৮ পদের মধ্যে ২৩ পদে জয় পান শিবিরের প্রার্থীরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (জাকসু) ভোট হয় ১১ সেপ্টেম্বর। নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল, শিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’, বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ অংশ নেয়। ভোটে ২৫ পদের মধ্যে জিএস ও এজিএসসহ ২০টি পদে বিজয়ী হন শিবিরের প্যানেলের প্রার্থীরা। ভিপি পদে জয় পান জুলাই বিপ্লবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দেওয়া এক শিক্ষার্থী। দুটি পদে বাগছাসের প্রার্থী ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) ভোট হয় ১৫ অক্টোবর। নির্বাচনে ১৩টি প্যানেল অংশ নেয়। কেন্দ্রীয় সংসদে ২৬ পদে লড়েন ৪১৫ প্রার্থী। সেখানে ভিপি, জিএসসহ ২৪ পদে শিবিরের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ছাত্রদলের একজন প্রার্থী এজিএস পদে বিজয়ী হয়েছেন। এছাড়া একজন স্বতন্ত্রী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এর মাধ্যমে ৪৪ বছর পর শিবির এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্বে এলো। সর্বশেষ ১৯৮১ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে জয় পায় শিবির।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) ভোট হয় গত বৃহস্পতিবার। এতে ১০টি প্যানেল অংশ নেয়। ২৩টি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৩০৫ জন। এ ২৩ পদের মধ্যে ভিপি ও এজিএমসহ ২০ পদে জয়ী হয়েছেন শিবিরের প্যানেলের প্রার্থীরা। জিএস পদে বিজয়ী হয়েছেন আধিপত্যবিরোধী ঐক্য প্যানেলের সালাহউদ্দিন আম্মার। বাকি দুই পদে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

দেশের প্রধান চার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের এ বিজয়ের কারণ নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক গবেষক ও অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, শিবিরের সময়োপযোগী রাজনৈতিক বক্তব্য, সুশৃঙ্খল সাংগঠনিক অবস্থান, মার্জিত আচরণ ও প্যানেল দেওয়ার ক্ষেত্রে ভিন্নমতের শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দেওয়া বিজয়ে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া গত এক বছর ধরে ছাত্রসংগঠনটির মধ্যে মেধাবীদের উপস্থিতি ও ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করেছে।

তিনি আরো বলেন, শিবিরের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সুস্পষ্ট কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল না। এছাড়া বামপন্থা ও সেক্যুলার মতাদর্শের প্রতি তরুণরা আর আগের মতো আগ্রহী নন। তারা ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

এ রাজনৈতিক গবেষক মনে করেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিবিরের বিজয়কে পরোক্ষভাবে আদর্শিক বিজয় হিসেবে দেখা যেতে পারে। ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনের প্রভাব আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পড়বে।

ভোট বিশ্লেষণ : ডাকসু

ডাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন। এর মধ্যে ৭৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ ভোটার ভোট দেন। নির্বাচনে ভিপি পদে শিবির নেতা আবু সাদিক কায়েম ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান পান পাঁচ হাজার ৭০৮ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন পান তিন হাজার ৮৮৩ ভোট। স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের উমামা ফাতেমা পান তিন হাজার ৩৮৯ ভোট। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আবদুল কাদের এক হাজার ১০৩ ভোট এবং বাম সংগঠনের জোট প্রতিরোধ পর্ষদের তাসনিম আফরোজ ইমি পান মাত্র ৬৮ ভোট।

জিএস পদে বিজয়ী শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এসএম ফরহাদ পান ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারি হামিম। তিনি পান পাঁচ হাজার ২৮৩ ভোট। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মেঘমল্লার বসু পান চার হাজার ৯৪৯ ভোট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের আবু বাকের মজুমদার পান দুই হাজার ১৩১ ভোট।

এজিএস পদে শিবিরের মুহাম্মদ মহিউদ্দীন খান ১১ হাজার ৭৭২ ভোট, ছাত্রদলের তানভীর আল হাদী মায়েদ পাঁচ হাজার ৬৪ ভোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমীদ আল মুদাসসীর পান তিন হাজার আট ভোট। বাম ছাত্র সংগঠনের জোট প্রতিরোধ পর্ষদের জাবির আহমেদ জুবেল পান এক হাজার ৫১১ ভোট। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেত্রী আশরেফা খাতুন পান ৯০০ ভোট।

জাকসু

এ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ১১ হাজার ৯১৯। প্রায় আট হাজার ১৬ জন ভোট দেন। ভিপি নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের আব্দুর রশিদ (জিতু)। তিনি পান তিন হাজার ৩৩৪টি ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শিবির সমর্থিত প্যানেলের আরিফ উল্লাহ, তিনি পান দুই হাজার ৩৯২ ভোট। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের প্রার্থী আরিফুজ্জামান (উজ্জ্বল) পান এক হাজার ২১১ ভোট। নির্বাচন বর্জন করা ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ সাদী হাসান পান ৬৪৮ ভোট।

শাখা ছাত্রশিবিরের অফিস ও প্রচার সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম তিন হাজার ৯৩০ ভোট পেয়ে জিএস পদে জয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাগছাসের নেতা আবু তৌহিদ সিয়াম পান এক হাজার ২৩৮ ভোট।

এজিএস (নারী) পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের আয়েশা সিদ্দিকা (মেঘলা) তিন হাজার ৪০২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাগছাসের প্যানেলের মালিহা নামলাহ পান এক হাজার ৮৩৬ ভোট। ছাত্রদলের আঞ্জুমান আরা ইকরা পান ৭৬৪ ভোট।

এজিএস (পুরুষ) পদে শিবির সমর্থিত প্যানেলের ফেরদৌস আল হাসান দুই হাজার ৩৫৮ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাগছাসের প্যানেলের জিয়া উদ্দিন (আয়ান) পান দুই হাজার ১৪ ভোট। ছাত্রদলের সাজ্জাদ উল ইসলাম পান ৭০১ ভোট।

চাকসু

এ নির্বাচনে ভিপি পদে শিবিরের প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন সাত হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের সাজ্জাদ হোসেন পান চার হাজার ৩৭৪ ভোট। চাকসুর ভিপি ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণের সভাপতি।

জিএস পদে আট হাজার ৩১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন ছাত্রশিবিরের প্যানেলের সাঈদ বিন হাবিব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শাফায়াত পেয়েছেন দুই হাজার ৭৩৪ ভোট।

চাকসুতে মাত্র একটি পদে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের প্যানেলের প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান। তিনি এজিএস পদে পেয়েছেন সাত হাজার ১৪ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রশিবির প্যানেলের সাজ্জাদ হোসেন পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৪৫ ভোট।

রাকসু

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ২৮ হাজার ৯০১ জন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, ২০ হাজার ১৮৭ জন ভোট দেন। নির্বাচনে ভিপি পদে ছাত্রশিবিরের মোস্তাকুর রহমান (জাহিদ) ১২ হাজার ৬৮৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন (আবির) ভোট পেয়েছেন তিন হাজার ৩৯৭টি।

জিএস পদে আধিপত্যবিরোধী প্যানেলের সালাউদ্দিন আম্মার ভোট পেয়েছেন ১১ হাজার ৪৯৭টি। তার নিকটতম ছাত্রশিবিরের প্যানেলের জিএস প্রার্থী ফজলে রাব্বি ফাহিম রেজা পান পাঁচ হাজার ৭২৭ ভোট। আম্মার ও ফাহিম রেজা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক।

এজিএসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী এসএম সালমান সাব্বির নির্বাচিত হন। তিনি ভোট পেয়েছেন ছয় হাজার ৯৭৫টি। তার নিকটতম ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের জাহিন বিশ্বাস (এষা) পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৯৫১ ভোট।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্রশিবিরের প্রার্থীদের ভোটপ্রাপ্তির হার প্রমাণ করে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রচুর ভোট পেয়েছেন। এর মধ্যে নারী শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের ভোট ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা পেয়েছেন।