Image description

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসব আমেজ বিরাজ করছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা নিজেদের ইশতেহার নিয়ে ভোট চাইতে শিক্ষার্থীদের দরজায় দরজায় পৌঁছে যাচ্ছেন। এসব ইশতেহার কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য কিংবা একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর জন্য প্রত্যক্ষভাবে কতটুকু প্রভাব ফেলবে তা নিয়েও হচ্ছে আলোচনা। তবে প্রার্থীদের ইশতেহার যাই হোক না কেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থী‌রই প্রত্যাশা ‘একটি গণরুম ও গেস্টরুমমুক্ত ক্যাম্পাস’। বিষয়টি মাথায় রেখে প্রার্থীরাও তাদের ইশতেহারে এ সংকট সমাধানের পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। 

জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল ১০ দফা, বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের জোট ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেল ১৮ দফা,  বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’  ৩৬ দফা , ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল ১১ দফা, ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল ৮ দফা, ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল ২৭ দফা, ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ, ভোট ফর চেঞ্জ’ প্যানেল মোট ১৪ দফাসহ বিভিন্ন প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ইশতেহার ঘোষণা করেছে। তাদের প্রত্যেকে‌ই ইশতেহারগুলোর অন্যতম দফা গণরুম গেস্টরুম মুক্ত ক্যাম্পাস বিনির্মাণ। তবে এই অন্যতম প্রধান ইশতেহার কতটুকু বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের শঙ্কা‌ও কাটছে না।

শিক্ষার্থীদের তথ্যমতে, বিগত সময়ে তাদের ক্যাম্পাস জীবনে মূল সমস্যা ছিল আবাসন সংকটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী‌ই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন। যার ফলে অনেকের পক্ষেই বাইরে থাকা সম্ভব না হওয়ার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন প্রতিটি হলে তৈরি করেছিল ‘গণরুম’ যেখানে এক রুমে ৩০-৫০ জন বা তা‌রও বেশি শিক্ষার্থীদের থাকতে দেওয়া হতো। এইটুকু আবাসন সুবিধাও ভোগ করতে শিক্ষার্থীদের অংশ নিতে হত রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে। ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে সারাদিন প্রোগ্রাম করার পর‌ও রাতের বেলায় সারাদিনের আমলনামা নিয়ে বসানো হত  যা শিক্ষার্থীদের কাছে ‘গেস্টরুম’ নামেই পরিচিত। সেখানে রাতভর চালানো হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। 

এদিকে, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাজনীতির ধরণের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলেও এখনো শিক্ষার্থীদের কাছে এই ‘গণরুম’ ও ‘গেস্টরুম’ এক আতঙ্কের নাম। তাদের দাবি- থাকা, খাওয়া এবং পড়াশোনার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করাই হোক ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের মূল অঙ্গীকার এবং তা নির্বাচনের পর রূপ নিক বাস্তবতায়। কারণ, একজন শিক্ষার্থী যদি প্রথম বর্ষ থেকে হলে বৈধ সিট পায়, তাহলে এই ‘গণরুম-গেস্টরুম’ কালচার থাকার সম্ভাবনা কম।

এ বিষয়ে দাবি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসমিন আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, পরিবার ছেড়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছোট একটা রুমে কয়েক ডজন শিক্ষার্থী ফ্লোরিং করে ক্লাস-পরীক্ষা দেওয়ার কষ্ট আমি বুঝি। কারণ, আমি নিজেই দেড় বছর গণরুমে থাকা মেয়ে। সারারাত শারীরিক-মানসিকভাবে নিপীড়িত হয়ে, অকথ্য গালিগালাজ শুনে, জোর করে রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে যেতে বাধ্য করাসহ অসংখ্য ভয়াবহ অত্যাচারের ঘটনা গেস্টরুম কালচারে থাকা আমাদের ছেলে বন্ধুদের মুখে শুনেছি। কাজেই গণরুম-গেস্টরুম নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রবল ভয়, ট্রমা এবং ক্ষোভের বিষয়টা এখনো কাজ করছে। বিভিন্ন প্যানেলের যে ইশতেহার সেগুলো কতটা বাস্তবায়িত হবে বা প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের কাজ আসবে তা জানি না, তবে আমরা চাই থাকা ও খাওয়ার একটা সুষ্ঠু পরিবেশ। একজন শিক্ষার্থী যদি থাকার জন্য একটা বৈধ সিট পায়, তাহলে আর গেস্টরুম, গণরুম ফিরে আসবে না বলে আমি মনে করি। 

অমর একুশে হলের শিক্ষার্থী আসিফ আহমেদ বলেন, ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে নানা প্যানেল বড় বড় ইশতেহার ঘোষণা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো তারা সবাই কি আসলে জানেন, ডাকসুর প্রকৃত দায়িত্ব কতটুকু? শুধু মতাদর্শিক সংঘাতের মঞ্চে পরিণত করলেই চলবে না; প্রয়োজন কার্যকর ও শিক্ষার্থীবান্ধব সংস্কার। আমার মতে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সামনে সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত দুটি কাজ। প্রথমত, আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, একাডেমিক সংস্কারকে সামনে আনা যার মধ্যে থাকবে পাঠ্যসূচির মানোন্নয়ন, বিভাগভিত্তিক শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের আধুনিক প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি। এসব মৌলিক বিষয়ে প্রার্থীদের সোচ্চার হতে হবে।

সৌরভ আহমেদ নামে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের স্বীকার করতে হবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকট একদিনে দূর হওয়ার নয়। তবে কিছু মৌলিক চাহিদা আছে, যেগুলো দ্রুত সমাধান করা সম্ভব এবং করা উচিত। যেমন: আবাসন সংকট নিরসন, মানসম্মত ক্যানটিনের ব্যবস্থা, নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা, অনাবাসিক নারী শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া এবং সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সব সুবিধা শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা। একজন ভোটার হিসেবে প্রতিনিধিদের কাছে এগুলোই আমার প্রাথমিক প্রত্যাশা।

কবি জসীম উদদীন হলের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সজিব বলেন, আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেন আর রাজনীতি ফিরে না আসে। সেই সাথে হল গুলোতে গণরুম গেস্টরুম ক্যালচার ও যেন ফিরে না আসে। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার যে অধিকার গুলো প্রয়োজন ডাকসু প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সেগুলো পূরণ হোক।

তিনি আরও বলেন, আমরা ডাকসুর গঠনতন্ত্রের দিক লক্ষ্য করলে দেখব যে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতিটা প্যানেল যে যে ইশতেহার গুলো দিয়েছে সে অনুযায়ী একজন প্রার্থীর ততটা ক্ষমতা নেই। তবে তারা ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগ করে অধিকার গুলো আদায় করে নিতে পারবে বলে আশা করি। 

একাত্তর হলের শিক্ষার্থী রিয়াজ উল্লাহ বলেন, গণরুম-গেস্টরুম না ফেরানোর প্রতিশ্রুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কতদিন এ সংস্কৃতি বজায় থাকবে সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আমার মূল প্রত্যাশা, ক্যাম্পাসটাকে একটু পড়াশোনা, বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। সকল ধরনের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির অবসান আর নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন আয়োজন।

আনিকা তাসনিম নামে আরেক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই গ্রাম থেকে উঠে আসেন, যাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আবাসনের অভাব। প্রথম বর্ষ থেকেই সুস্থ ও পর্যাপ্ত আবাসনের নিশ্চয়তা দেওয়া গেলে ধীরে ধীরে শিক্ষার মানোন্নয়ন, সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা সম্ভব হবে।