
আদালতে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া, প্রতারণামূলকভাবে নিবন্ধিত ও ভুয়া বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) রেফারেন্স টেনে রাজধানীর নর্দান ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (এনইউবি) ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ নিয়ে কালক্ষেপণ ও টালবাহানার অভিযোগ উঠেছে। এর নেপথ্যে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন রয়েছেন বলে অভিযোগ এনইউবি সংশ্লিষ্টদের।
সূত্র জানিয়েছে, নর্দান ইউনিভার্সিটিতে ভিসি নিয়োগের জন্য গত ১৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং একই তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর ২ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের তালিকা পাঠায় প্রতিষ্ঠানটি। এ প্রেক্ষিতে নর্দান ইউনিভার্সিটির চাহিদার আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইউজিসির কাছে ‘ভাইস চ্যান্সেলর’ নিয়োগের বিষয়ে আইনগত দিক পর্যালোচনাপূর্বক মতামত/প্রতিবেদন’চেয়ে গত ১৪ জুলাই একটি চিঠি দেয়। কিন্তু ইউজিসি এখন পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কোনো প্রতিবেদন না দিয়ে অতিউৎসাহী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘প্রশাসক’নিয়োগে মতামত দিয়েছেন। যেটিকে ইউজিসির এখতেয়ার বহির্ভূত বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ইউজিসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নর্দান ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি) নিয়ে মামলা চলমান থাকায় ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের অগ্রগতি হচ্ছে না। তারা জানিয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় প্রশাসক নিয়োগের বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে।
তবে এনইউবি কর্তৃপক্ষ বলছে, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ভুয়া পক্ষকে ‘বিবাদমান পক্ষ’ বানাচ্ছেন। জেলা জজ চতুর্থ আদালত (মামলা নম্বর ১৭/২০২৫) অবৈধ ও প্রতারণামূলক নিবন্ধিত সাপ্লিমেন্টারি আইবিএটি এবং এনইউবি ট্রাস্টের সকল কাজে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, সর্বশেষ চিঠি অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় এনইউবিতে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের সুনির্দিষ্ট মতামত চেয়েছে। এরপর এই বিষয়ে মতামত ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে মতামত প্রদানে সংস্থাটির সুযোগ নেই। প্রচলিত আইন (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন) অনুসারে, ভাইস চ্যান্সেলর প্যানেলভুক্ত শিক্ষকগণ ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার শর্ত পূরণ করেন কি না—তার বাইরে ইউজিসির মতামত প্রদান এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না।
জানা গেছে, এ বিধিবহির্ভুতভাবে ইউজিসি অতি উৎসাহী হয়ে এনইউবিতে প্রশাসক হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহ আল ইউসুফের নাম প্রস্তাব করে। কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টা প্রস্তাবটি বাতিল করে চিঠিটি নথিজাত (বাজেয়াপ্ত) করে।
নর্দান ইউনিভার্সিটি সংশ্লিষ্টদের আরও অভিযোগ, ভুয়া ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশ করে ড. আনোয়ার হোসেন এনইউবিতে প্রশাসক নিয়োগের চেষ্টা করছেন। এর আগে এনইউবি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনেও তিনি ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। যা প্রমাণিত হওয়ার পর একটি তদন্ত কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় কমিটি করা হয়, কিন্তু সেই কমিটিতেও ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নিজেদের ট্রাস্টি পরিচয় দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল ফিরে পেতে আবেদন করেন বোরহান উদ্দিন ও লুৎফর রহমান নামে দুই ব্যক্তি। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটিতে প্রতারণামূলক, ভুয়া বিওটি গঠনকারীদের ঘনিষ্ঠ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নোমান ফারুক নামে এক ব্যক্তিকে রাখা হয়। ভুয়া বিওটিদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ সাপেক্ষে দ্বিতীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এ দফায় গঠিত কমিটির আহ্বায়ক করা হয় সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আলতাফ হোসেনকে—যিনি ভুয়া বিওটি গঠনকারীদের এলাকার লোক। এক সময়ে নর্দান ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিতেন (খণ্ডকালীন)। এছাড়া আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সচিব ও অগ্রণী ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুবিধাভোগী হিসেবে চুক্তিভিত্তিক লিগ্যাল অ্যাডভাইজর ছিলেন। আলতাফ হোসেন কমিশনের অপর দুই সদস্যের সম্মতি ছাড়াই একটি মনগড়া প্রতিবেদন জমা দেন। কিন্তু হাইকোর্ট সেই প্রতিবেদন গ্রহণ করেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগ জানিয়ে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এনইউবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা নিয়মনীতি মেনেই ভাইস চ্যান্সেলর প্যানেল ইউজিসিতে জমা দিয়েছি। এরকম কোনো আবেদন বা চিঠি গেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ম অনুসারে ইউজিসি মতামত চায়। কিন্তু ইউজিসি অজ্ঞাত কারণে মতামত দিচ্ছে না, আটকে রেখেছেন। আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, একটা গ্রুপ গত ৫ আগস্টের পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় দখলের পাঁয়তারা করছে। নানা অপচেষ্টা করেও তারা সফল হতে না পেরে তারা বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছে। যেগুলো তারা কোর্টেও প্রমাণ করতে পারেনি এবং কোথাও গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা নানাভাবে ঝামেলা করতে চাচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে তারা ভিসি নিয়োগ বিলম্বিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ইউজিসি ভুয়া পক্ষকে বিবদমান পক্ষ দেখাচ্ছে। অথচ আদালত সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে ওই বিওটির যেকোনো ব্যবহার নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে। আর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ভাইস চ্যান্সেলরের পরিবর্তে ইউজিসি প্রশাসক নিয়োগের বিষয়ে মাথা ঘামাতে পারেনা। এটা বিধিবহির্ভূত।
বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় দখলের অপচেষ্টাকারীদের দাবির মুখে পর পর গঠিত দুটি তদন্ত কমিটিতেই পক্ষপাতিত্ব করেছেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। যার প্রেক্ষিতে প্রথমটি গ্রহণযোগ্যতা হারায় এবং দ্বিতীয়টির একপেশে প্রতিবেদনও আদালতে ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়।
তিনি আরও বলেন, একটা ভুয়া ট্রাস্টি বানিয়ে সেখান থেকে দাবি জানানো হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাদ দিয়ে সর্বশেষ একটা চিঠির মাধ্যমে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের ব্যাপারে ইউজিসির কাছে আইনগত মতামত চায়। এ মতামতের বাইরে তো ইউজিসি কিছু করতে পারে না। কিন্তু ইউজিসির বেসরকারি ব্যবস্থাপনা বিভাগীয় প্রধান তালবাহানা করে সেই ভুয়া ট্রাস্টির এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন।
তবে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ভাইস চ্যান্সেলর ইস্যুতে প্রতিবেদনের জন্য বোর্ড অব ট্রাস্টি (বিওটি) সংক্রান্ত তথ্য প্রয়োজন। এখন আমরা যদি বিওটি ইস্যু সম্পর্কে যদি কথা বলতে চাই তাহলে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে ভাবতে হয়। বিশেষ করে, এ সংক্রান্ত মামলা আদালতে চলমান রয়েছে।
বিওটি ইস্যুতে তদন্ত কমিটিতে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, ইউজিসিতে আমার ব্যক্তিগত কোনো এজেন্ডা নেই। কোনো বিষয়ে কোথাও আমার প্রভাব বিস্তারের প্রশ্ন আসেনা।
প্রশাসক নিয়োগের অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় এ বিষয়ে মতামত দেওয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সর্বশেষ চিঠিতে সুনির্দিষ্ট করে ‘ভাইস চ্যান্সেলর’ নিয়োগ নিয়ে মতামত চেয়েছিল বলে জানা গেছে।
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।