
আওয়ামী লীগের সর্বাধিক সুবিধাভোগী শিল্পগ্রুপ ইউনাইটেডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের তুমুল আন্দোলনের মুখে প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য, ডিনসহ বিভিন্ন বিভাগের ১১ জন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। শনিবার দিবাগত রাতে তারা পদত্যাগপত্র জমা দেন।
হঠাৎ কেন শিক্ষার্থীরা এতটা ক্ষেপলেন ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের বিরুদ্ধে? এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে ঢাকাটাইমস জানতে পারে এক অমানবিকতার চিত্র।
রবিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়ুয়া একাধিক শিক্ষার্থী ঢাকাটাইমসকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনৈতিক ফি আদায়, অদক্ষ শিক্ষক, মানহীন শিক্ষাব্যবস্থা, ডিপার্টমেন্ট অফিসে শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ আচরণ, কঠোর পরীক্ষা পদ্ধতি, স্বৈরাচারীদের পুনর্বাসন, ক্যান্টিনে মানহীন খাবার সরবরাহসহ অসংখ্য অভিযোগ আছে এই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে তারা বারবার প্রশাসনকে জানালেও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এসব অভিযোগর সঙ্গে যোগ হয় সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক ছাত্রীর বাবার মৃত্যুসনদ নিয়ে বিভাগীয় প্রধানের হয়রানিমূলক আচরণ।
বাবার মৃত্যুজনিত কারণে ওই ছাত্রী নির্ধারিত সময়ে মিডটার্ম পরীক্ষা দিতে পারেননি। বিষয়টি লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানান তিনি। কিন্তু সিএসই বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নুরুল হুদা ওই ছাত্রীর বাবার মৃত্যুসনদ নিয়ে তাকে নানাভাবে হয়রানি করেন বলে অভিযোগ।
বাবার মৃত্যুর মেডিক্যাল ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার পরও ছাত্রীটিকে তার জেলার কাউন্সিলর বা প্রশাসনের স্বাক্ষরসহ ডেথ সার্টিফিকেট আনতে বলেন ওই শিক্ষক। সময় দেন তিন দিন। কিন্তু এই সময়ে সেটি জোগাড় করা সম্ভব হয়নি এ ধরনের কাজে অনভিজ্ঞ ছাত্রীটির পক্ষে। মেয়েটির কষ্ট, একজন শিক্ষক কী করে সন্দেহ করেন কেউ বাবার মৃত্যু নিয়ে ভুয়া মেডিক্যাল সনদ জমা দেবে! মেয়েটির আরও নানা হয়রানির চিত্র ফুটে ওঠে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে (নিচে পুরো স্ট্যাটাসটি সংযুক্ত)।
ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ ওই শিক্ষার্থী গত ২৪ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) বিশ্ববিদ্যালয়টির ফেসবুক গ্রুপে একটি হৃদয়স্পর্শী পোস্ট দেন যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরপরই শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসজুড়ে বিক্ষোভ শুরু করেন, যা পরে উপাচার্য আবুল কাশেম মিয়া ও সিএসই বিভাগের প্রধান নুরুল হুদার পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশনে গড়ায়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে রাত ৯টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক আবুল কাশেম মিয়া পদত্যাগ করেন। তার সঙ্গে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সব ডিন, বিভাগীয় প্রধান ও পরিচালকরা। তবে পদত্যাগ করেননি অভিযুক্ত নুরুল হুদা।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা বলছেন, উপাচার্য ও সিএসই বিভাগের প্রধানের পদত্যাগ ছিল তাদের প্রধান দাবি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট দাবি না মেনে অতিরিক্ত পদত্যাগের মাধ্যমে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একজন শিক্ষকের পদত্যাগের দাবি না মেনে অন্য ১০ শিক্ষক-কর্মকর্তার পদত্যাগকে সাজানো নাটক বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। এই আবহে আবার আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলছেন তারা।
অমানবিক ইউনাইটেড! ইউনিভার্সিটি ছাত্রীর হৃদয়স্পর্শী ফেসবুক স্ট্যাটাস
যা ছিল ওই ছাত্রীর ফেসবুক স্টাটাসে
নিরাপত্তার স্বার্থে এখানে ছাত্রীটির নাম ব্যবহার করা হলো না। তার স্ট্যাটাসটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো।
‘আমার মিড পরিক্ষার ৫ দিন আগে আমার বাবা মারা যায়। আমার মানসিক অবস্থা এতটাই বেশি খারাপ ছিল যে কারণে আমি প্রথম দিকের মিড পরীক্ষা দিতে পারিনি। এই নোটিশ অনুযায়ী আমি তিন দিনের মধ্যে ক্যাম্পাসে ডিপার্টমেন্ট হেডের সাথে কথা বলি। (উনি এতটাই বেশি ব্যস্ত যে কথাই বলবে না এবং কিছু শুনবেও না। তাও সকাল ৯টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত উনার রুমের আশেপাশে ঘোরার কারণে শেষমেষ কথা বলে)। আমি আমার বাবার মেডিকেল ডেথ সার্টিফিকেট দেখাই। এরপর আমাকে বলা হয় এটা দিয়ে কাজ হবে না। আমাকে আমার জেলার কমিশনার বা কনসিলার বা জেলা প্রশাসক যেই আছে তার কাছ থেকে সনদপত্র বা স্বাক্ষর ইত্যাদি আনতে হবে। তাহলে আমার ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষার ফি ফ্রী করে দিবে। এবং উনি বলেছিল বৃহস্পতিবার দিন আসতে অর্থাৎ আজকে। তিনি বৃহস্পতিবার দিন নাকি ফ্রি থাকবে, এর আগে অনেক ব্যস্ত।
যেহেতু আমার বাবা মারা গিয়েছেন এবং আমার কোন ভাই নেই (ছিল সেও মারা গিয়েছে অনেক বছর আগে)। এসব কাগজপত্র জিনিস তেমন একটা বুঝার কথা না আমাদের। তাও অনেক চেষ্টা করে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে পেপারস ম্যানেজ করার ট্রাই করি। কিন্তু কোনভাবেই তিন দিনের মধ্যে এসব পেপার্স ম্যানেজ করা পসিবল হয়নি। … তারপর আজকে আমি যাই এই বিষয়ে স্যারের সাথে কথা বলতে। যদি সে একটু শুনে এই আশায়। আমার অন্য একটি কোর্সের ল্যাবের মিড ছিল আজকে, তাই মিড পরীক্ষার পর দুপুর ১টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ৫ ঘন্টা ওয়েট করার পরও স্যার আসেনি। (উনি বলেছিলেন আজকে ফ্রি থাকবে)।
আমার কথা হচ্ছে একটা মানুষের ডেথ সার্টিফিকেট ও ফেক বানিয়ে আনবে কেউ??
এ রকম আরো অনেক সিরিয়াস কন্ডিশন নিয়ে স্টুডেন্টরা এসেছিল কথা বলতে। এমনও দেখেছি অ্যাক্সিডেন্ট করে ব্যথা পেয়ে হাত-পা ছিলে গিয়েছে। কিন্তু কোনো হাড় ভাঙ্গেনি। এমন সিরিয়াস কন্ডিশন দেখেও বলে এক্সরে রিপোর্ট আনতে। অনেকে আইসিইউ মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে গেলেও তাদের বলে এগুলা ফেক বানানো যায়!! তার মানে আপনারা টাকা দিয়ে পরীক্ষা দিতে বাধ্য। মনুষত্ব কোথায়। কাকে যেয়ে কমপ্লেইন করবো। যাকে যেয়ে করব তারাই এ রকম!’
এই ছাত্রীর প্রতি ইউনাইটেডের অমানবিকতার ঘটনায় তাদের আরও নানা অপকর্ম ও অমানবিকতার কথাও চলে আসে স্বাভাবিকভাবে।
ইউনাইটেডের যত অনিয়ম ও অমানবিকতা
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তাপক্ষ ইউনাইটেড গ্রুপের বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম-লুটপাট, আয়কর ফাঁকি, তাদের করপোরেট অফিসের ভবন নির্মাণে অনিয়ম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনাকে সহায়তা (ভাটারা থানায় হত্যা মামলার আসামি), ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলা- এমন অভিযোগের শেষ নেই। এমনকি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা ও ভবন নির্মাণের অনিয়ম নিয়ে আছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অভিযোগ। এ নিয়ে তাদের চিঠিও দিয়েছে সংস্থাটি।
অমানবিক ইউনাইটেড! ইউনিভার্সিটি ছাত্রীর হৃদয়স্পর্শী ফেসবুক স্ট্যাটাস
ইউনাইটেডের অমানবিকতার গল্পেরও অন্ত নেই। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হঠাৎ অবনতিশীল শারীরিক অসুস্থতায় ইউনাটেডের কাছে জরুরি ওষুধ ও অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে প্রত্যাখাত হওয়ার ঘটনা তো বহুল সমালোচিত সব মহলে। এ ছাড়া খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ক্ষেত্রে অতি উৎসাহীর ভূমিকা পালন করেন এই ইউনাইটেডের সংশ্লিষ্ট তখনকার সেনাপ্রধান মুবিন, যিনি বর্তমানে ইউনাইটেড পাওয়ারের চেয়ারম্যান।
আরেক অমানবিকতার উদাহরণ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেরুলখোলায় ইউনাইটেড গ্রুপের আবাসন প্রতিষ্ঠান নেপচুন ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। কৌশলে একে একে বসতি উচ্ছেদ করে গড়ে তোলে বহুতল ভবন। কিন্তু ওমর আলী নামের এক অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি কর্মকর্তাকে উচ্ছেদ করতে না পেরে অমানবিক এক কৌশলের আশ্রয় নেয় ইউনাইটেড। সরকারি রাস্তা কেটে আর ওমর আলীর বাড়ির পাশের খোলা জায়গার মাটি কেটে সেখানে বানায় আবাসনের স্যুয়ারেজের জলাধার। ইউনাইটেডের বহুতল ভবনের সব ময়লা পানি এসে জমা হয় সেখানে। যে বাড়ির উঠানে একসময় মেয়ের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন ওমর আলী, সেখানে আজ ময়লা পানিতে টইটুম্বুর।