
সড়কে বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই ছড়িয়ে পড়েছে বিপজ্জনক এ বাহনটি। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা গলিপথ ছেড়ে রাজপথে উঠে আসায় বিপদের মাত্রা বেড়েছে আরও। রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ এবং চালুর দাবিতে পাল্টাপাল্টি আন্দোলন পর্যন্ত হয়েছে। নিত্যদিনই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে ওঠার পরও বারবার উদ্যোগ নিয়েও ব্যাটারিচালিত রিকশা বাগে আনা যায়নি। ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য ঠেকাতে এবার তাই বিকল্প পথে হাঁটছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) নির্দেশিত নতুন মডেলের ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়কে নামানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের ডিজাইন করা অটোরিকশার নির্মাণ খরচ সাধারণ রিকশার মতো হলেও এটি অনেক বেশি নিরাপদ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) জানিয়েছে, তারা নতুন নকশা বা মডেলের রিকশা ঢাকার রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দেবে। পুরোনো রিকশা পর্যায়ক্রমে সড়ক থেকে তুলে নেওয়া হবে।
বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. এহসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের গবেষক দল নতুন রিকশার নকশা করেছেন। দলে ছিলেন যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এ সালাম আকন্দ ও মো. আমান উদ্দীন, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক মো. জিয়াউর রহমান খান এবং গবেষণা প্রকৌশলী হিসেবে ছিলেন মো. আসাদুজ্জামান ও আবদুল আজিজ ভূঁইয়া।
নতুন রিকশার আদ্যোপান্ত জানতে কথা হয় তাদের সঙ্গে। তারা জানান, বুয়েটের দলটির নকশা করা রিকশা মূলত রাস্তায় চলাচলকারী ইজিবাইকের মতো। রিকশায় ১৬টি বৈশিষ্ট্য যোগ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তারা দেশে প্রচলিত ১২ ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশার নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করেছেন। রিকশার দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ২ মিটার, প্রস্থ দেড় মিটার এবং উচ্চতা ২ দশমিক ১ মিটার। সব মিলিয়ে আকার হবে এখনকার রিকশার মতোই। রিকশাটি ৩২৫ থেকে ৪২৫ কেজি পর্যন্ত ওজন সহজেই বহন করতে পারবে। ফলে দুজন যাত্রী নিয়ে চালক সহজেই রিকশাটি চালাতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পায়েচালিত রিকশা ঢাকায় ঘণ্টায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। তবে তাতে মোটর লাগিয়ে ৩০ কিলোমিটার গতি ওঠানো হচ্ছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়টি মাথায় রেখে নতুন রিকশায় ব্রেকিং ব্যবস্থা এখনকার চেয়ে অনেক ভালো করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে গবেষক দলের সদস্যরা জানান, এর তিনটি চাকায় ‘হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক’ ও বিকল্প ‘পার্কিং ব্রেক’ সংযোজন করা হয়েছে। ফলে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। সাধারণ রিকশায় ‘লুকিং গ্লাস’ থাকে না। ফলে রিকশাচালককে পেছনে তাকিয়ে দেখতে হয় কোনো যান আসছে কি না। আবার সাধারণ রিকশায় ‘ইন্ডিকেটর’ নেই। ফলে রিকশা ডানে অথবা বাঁয়ে মোড় নিলে পেছনের যানবাহনের চালকরা তা বুঝতে পারেন না, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে। নতুন রিকশায় ‘লুকিং গ্লাস’ ও ‘ইন্ডিকেটর’ থাকবে।
গবেষক দলের সদস্যরা আরও জানান, নতুন রিকশায় ছাউনি ও কাচের ‘উইন্ডশিল্ড’ থাকবে। ফলে বৃষ্টিতে চালক ও যাত্রীদের ভিজতে হবে না। নতুন রিকশায় কাঠামোর সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত করা হয়েছে হেডলাইট, যাতে রাস্তার দৃষ্টিসীমা ঠিক থাকে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই রিকশার দাম হতে পারে দেড় লাখ টাকার আশপাশে। রিকশাটির ব্যাটারির জন্য খরচ হবে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। বাকিটা কাঠামোর খরচ।
একজন রিকশা প্রস্তুতকারক বলেন, ব্যাটারি একবার চার্জ দিলে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে পারবে নতুন রিকশা। দেড় বছর পরপর ব্যাটারি পরিবর্তন করা লাগবে। পুরোনো ব্যাটারিগুলো ‘রিসাইকেল’ করা হয়। কোম্পানিগুলো পুরোনো ব্যাটারি আবার কিনে নেয়।
বুয়েটের অধ্যাপক মো. এহসান বলেন, পায়েচালিত রিকশার কাঠামো ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলার জন্য শক্তিশালী নয়। এগুলোয় যে ব্রেক ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়, তা সর্বোচ্চ ১০ কিলোমিটার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নতুন রিকশায় সর্বোচ্চ গতি ওঠানো যাবে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। তবে এর তিনটি চাকায় ‘হাইড্রোলিক ব্রেক’ ব্যবহার করার কারণে তা নিরাপদ।
ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ঢাকার সড়কে এখন যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছে, সেগুলো থাকবে না। বুয়েট আমাদের ব্যাটারিচালিত রিকশার একটি নকশা তৈরি করে দিয়েছে। এটি হলে অটোরিকশা চালকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে লাইসেন্স দেওয়া হবে। প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করতে দেওয়া হবে না। নতুন মডেলে এখন ব্যাটারিচালিত রিকশায় যে ধরনের হাতে ব্রেক থাকে, তেমন থাকবে না। পায়ে ব্রেক থাকবে। রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট মোটর থাকবে।
এ সময় তিনি বলেন, আপনাদের এলাকায় অবৈধ অটোরিকশার গ্যারেজের তথ্য দিন, আমরা সেগুলো বন্ধ করে দিব। আপনারা বাড়ির মালিক সমিতি থেকে উদ্যোগ নিন, আপনাদের এলাকায় অবৈধ অটোরিকশা প্রবেশ করতে দিয়েন না। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা চেষ্টা করছি। সরকার নির্ধারণ করে দেবে কোন কোন এলাকায় রিকশা চলতে পারবে। পুরো ঢাকা শহর ঘোরার অনুমতি দেওয়া হবে না। রিকশাভাড়াও সরকার নির্ধারণ করে দেবে।