Image description

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র নেওয়ার পরও গত বছর ১৭ হাজার ৭৭৭ জন কর্মীর মালয়েশিয়ায় পাঠাতে না পারার দায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর। হাইকোর্টে দাখিল করা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। রবিবার বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি মুবিনা আসাফের হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ শফিকুর রহমান প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। আদালতে রিটকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ।

উপস্থাপিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দায়ী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষকে তা জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। প্রতিবেদনের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ অংশে বলা হয়েছে, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ (সংশোধিত) এর ১৫(ক) ধারার আওতায় প্রণীত বিধিমালা মোতাবেক বিএমইটি থেকে অভিবাসী কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র সংগ্রহ করা, অভিবাসী কর্মীকে কর্মে নিয়োগের ব্যবস্থা করা এবং তার কর্মপরিবেশসহ অন্য সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করা সম্পূর্ণভাবে রিক্রুটিং এজেন্সির দায়িত্ব। বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র সংগ্রহ করার পরও ১৭ হাজার ৭৭৭ জন কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে না পারার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ওপর বর্তায়।

এতে আরো বলা হয়, কর্মী পাঠানোর ব্যর্থতার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো শেষ মুহূর্তে বিমানের টিকিট না পাওয়াকে মূল কারণ বললেও পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অযাচিত বিলম্ব করেছে। বিলম্ব না করলে শেষ মুহূর্তে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এ ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দায়িত্বহীনতাই দায়ী এবং তাদের কোনো অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।

কর্মী পাঠানোর ব্যর্থতা এবং দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া এবং মালয়েশিয়া যেতে না পারা ব্যক্তিদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা অবিলম্বে ফেরত দেওয়াসহ ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির আর সৃষ্টি না হয়, সে সুপারিশও করা হয়েছে। প্রতিবেদনের এই অংশে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুসারে রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচনের বিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে বৈধ সব রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায়। মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে, যাতে বিদেশে পাঠানোর পর কর্মীদের পরবর্তী পরিস্থিতি তদারকি করা যায়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে কর্মীদের নিয়োগ অনুমতি নেওয়ার পর বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র নেওয়া, কর্মী পাঠানোর সময়সীমা নির্দিষ্ট করা, অভিবাসী কর্মীদের কাছ থেকে অভিবাসন ব্যয় গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সুপারিশও করা হয়েছে এতে। 

আদেশের পর রিটকারী আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বেলন, প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে কি না এবং তাদের মালয়েশিয়ায় পাঠানোর ব্যপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি নাএসব বিষয় তুলে ধরে রাষ্ট্রপক্ষকে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত। এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ২৭ আগস্ট তারিখ রাখা হয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী।

 

গত ১৫ বছরে তিন দফায় মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে। প্রতিবারই শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে চক্রের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের অভিযোগ ওঠে।

২০০৯ সালে প্রথম দফায় বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০১৬ সালের শেষে খোলা হয় বাজারটি। তখন বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে চক্র গড়ে তোলার অভিযোগ ওঠে। এরপর দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আবার বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ২০২২ সালে আবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে। গত বছর মার্চে মালয়েশিয়া জানায়, তারা আপাতত আর কর্মী নেবে না। যাঁরা অনুমোদন পেয়েছেন, ভিসা পেয়েছেন, তাঁদের ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ঢুকতে হবে। ১ জুন থেকে বন্ধ করে দেওয়া হবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। আপাতত নতুন করে কোনো কর্মী যেতে পারবেন না দেশটিতে।

তার আগেই বিএমইটি থেকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো চার লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ কর্মীর ছাড়পত্র নেয়। এর মধ্যে চার লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ কর্মী পাঠানো হয়। বাকিরা যেতে পারেননি। চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়েও হাজার হাজার কর্মীর মালয়েশিয়া যেতে না পারা নিয়ে দেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যম খবর-প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব খবর-প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ ও আইনজীবী বিপ্লব পোদ্দার। এ রিটে প্রাথমিক শুনানির পর আদালত গত বছর ৩০ জুন একটি মৌখিক আদেশ দেন। মালয়েশিয়া কাণ্ডে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সাত দিনের মধ্যে তা রাষ্ট্রপক্ষকে জানাতে বলা হয়। সে ধারাবাহিকতায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। সেই প্রতিবেদন দেখে গত বছর ১৬ জুলাই রুলসহ আদেশ দেন হাইকোর্ট। ১৭ হাজার ৭৭৭ জন কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা ও খামখেয়ালিপনাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং যেতে না পারা কর্মীদের টাকা সুদ ও যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ ফেরত দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে। আর প্রতি তিন মাস পর পর এ ঘটনায় হালনাগাদ তথ্য প্রতিবেদন আকারে দাখিল করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর আদেশ দিলেন উচ্চ আদালত।