
গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গান ‘আওয়াজ উঠা’ গেয়ে গেয়ে দেশ কাঁপিয়েছিলেন তরুণ র্যাপসংগীত শিল্পী হান্নান হোসেন শিমুল ওরফে র্যাপার হান্নান। জাগিয়েছিলেন প্রতিবাদী তারুণ্যকে। তার সেই চেতনা, সংগ্রাম ও প্রত্যাশা নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন এই শিল্পী।
জাগো নিউজ: হান্নান হোসাইন শিমুল নামের সঙ্গে ‘র্যাপার’ যুক্ত হলো কবে থেকে?
র্যাপার হান্নান: র্যাপার যুক্ত হয়েছে আমি গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিন পর থেকে। মানুষের মুখে মুখে নামটা ছড়াতে শুরু করলো – ‘কে এই র্যাপার হান্নান’! একজন র্যাপার গ্রেপ্তার হয়েছে, তার নাম র্যাপার হান্নান। ৫ আগস্টের পর মানুষের মুখে মুখেই বেশি শোনা গেছে নামটা। তার আগে আমি হান্নান নামে পরিচিত ছিলাম।
জাগো নিউজ: র্যাপসংগীত চর্চার শুরু কবে থেকে?
র্যাপার হান্নান: র্যাপসংগীতে আমার যাত্রা ২০১৮ সাল থেকে, ট্রাই করছিলাম। এখন ২০২৫। এর মধ্য অনেকগুলো গান করেছি। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে অ্যালবাম করেছি। ২০২৪ সাল পযর্ন্ত কাজ করেছি। ২০২৫ সালে আবারও অ্যালবাম আসছে।
জাগো নিউজ: ৫ আগস্টের আগের র্যাপার হান্নান, ও ৫ আগস্টের পরের র্যাপার হান্নান, বিদ্রোহটা কখন বেশি ছিল?
র্যাপার হান্নান: আমরা যে সময় আওয়াজ উঠাইছি, তখন অনেকে চুপ ছিল। অনেকে আওয়াজ উঠায় নাই। সেই খারাপ সময়টা চলে গেছে। এখন ভালো সময় আসছে। অবশ্যই বিদ্রোহটা এখন বেশি। এখন পরিস্থিতি অনুযায়ী গান চলছে। আবার দেশ যে খুব ভালো অবস্থার দিকে যাচ্ছে, তেমনও না। ওইসব চিন্তা-ভাবনা মাথায় নিয়ে গান তৈরি হচ্ছে। ঈদের পরপর নতুন একটা অ্যালবাম বের হবে আমার। আরও কিছু গান আছে। অ্যালবাম রিলিজ করলে সবাই শুনতে পাবেন।
জাগো নিউজ: ২০১৮ থেকে র্যাপসংগীত করতেন, শুনতে শুরু করেন কবে থেকে?
র্যাপার হান্নান: অনেক শিল্পীর গান শোনা হতো। বিশেষ করে দেশের বাইরের গান শোনা হতো। তাদের মধ্যে আইস কিউব অন্যতম। আরও অনেক শিল্পী আছেন, যাদের শুনতে শুনতে নিজের একটা আইডেনটিটি বানাইছি, ওই রকম একটা পার্সোনালিটি বানাইছি। ২০১৬ সালের দিকে মনে হয়েছে, অনেক তো শুনলাম, এবার নিজে ট্রাই করি। দেখি নিজে কিছু লেখা যায় কি না, গাওয়া যায় কি না। এ রকম করতে করতে ২০১৮ সাল লেগে গেল। প্রথম গান বের হয় সেইটার নাম ছিল ‘ডিসকাউন্ট’। এর পর অ্যালবাম রিলিজ করছি। এর মধ্যে বাংলাদেশের র্যাপারদের গান শোনা হতো।
জাগো নিউজ: ‘আওয়াজ উঠা’ গানের পেছনের গল্পটা জানতে চাই। কীভাবে আওয়াজ ওঠালেন?
র্যাপার হান্নান : ‘আওয়াজ উঠা’ আসার আগের দিন সেজান ভাই ‘কথা ক’ রিলিজ দিয়েছেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রেনডমলি ভাতিজাদের লগে কথা বলছি, কী করা যায়? দিনকে দিন তো দেশের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। বাট, কিছু একটা তো করা দরকার। সবাই আন্দোলন করতাছে, এইটা ওইটা করতাছে। আমার ভাতিজারা আছে, আমি, নাফিস, সালমান। ওরা বললো, ‘তুমি এখনো বসে আছো, সেজান ভাই গান গেয়েছে, তুমিও একটা গান লেখো। তুমি বাংলাদেশের র্যাপ শিল্পী হিসেবে তোমার একটা গান দেওয়া দরকার। তুমি করো। তোমার পার্সপেকটিভে করো, দেশের জনগণ জানুক জিনিসটা আসলে এই ঘটছে।’ আমি বাসায় গিয়ে ‘আওয়াজ উঠা’র বিটটা প্লে করছি। চোখটা বন্ধ করে ভাবলাম, গত দুই-চারদিন কী দেখছি। সেই কাহিনি ‘আওয়াজ উঠা’য় দিয়ে দিয়েছি। ৩৭ মিনিটে মধ্যে ‘আওয়াজ উঠা’ লেখা শেষ হয়েছে।
জাগো নিউজ: এ রকম একটা গান লিখে ফেললেন, ভয় কাজ করেনি?
হান্নান: আমরা যে জায়গায় থাকি, আশপাশে ভালো মানুষ থাকে না, ওইখানে গুন্ডা-বদমাশ থাকে, টু বি অনেস্ট। ছোটকাল থেকে এইগুলো দেখতে দেখতে মানুষ হয়েছি। আমাদের জানের ভয়টা একটু কম। আপনি ছুরি-চাকু বের করে ভয় দেখাবেন? আমি বলবো মেরে চলে যান, কোনো সমস্যা নাই। ছোটকাল থেকে এমনেই মানুষ হয়েছি। আমাদের কেউ ভালো কথা কয় না, যদি কয়, আমরা ওই মানুষকে মাপি, কেন ভালো কথা কয়! কথা কি ঠিক আছে? আমার তো ভাতিজা গ্রুপ আছে। ভাই-বন্ধু আছে, তাই এতো কিছু চিন্তা করি নাই। ‘আওয়াজ উঠা’ আরও নরমভাবে চিন্তা করতে পারতাম। কিন্ত আমার কাছে মনে হয়েছে, আসল জিনিসটা মানুষ জানুক। আন্দোলনটায় সবাই পাশে থাকুক।
জাগো নিউজ: ভাতিজা গ্রুপ কী?
র্যাপার হান্নান: আমার ছোট যারা, যারা আমার আশপাশে থাকে, আমি ওদের আদর করি। এদের সঙ্গে আমার সারাদিন কথাবার্তা চলে, গান বাজনা চলে। গানটা মুক্ত হওয়ার পর দুই দিন বাসায় থাকতে পেরেছি। অনেকে বলেছে, এই গানটা ডিলিট করে দাও, নইলে অনেক সমস্যা হবে। সমস্যা চলছিলও, কাউকে কিছু বলিনাই। কিন্তু আমার কথা হলো, তোমরা দশটা দিলে আমি একটা দিবো। এ রকম চিন্তা করেছি, যা আছে, দেখা যাবে। করার আগে তো ভাবি নাই, করে ভাবলে কী হবে? তারপর সবাই জানে, ১৬ দিন জেলে ছিলাম। প্রথম ১২ ঘণ্টা জানাতেই পারিনাই কোথায় ছিলাম।
জাগো নিউজ: কীভাবে আটক হয়েছিলেন?
র্যাপার হান্নান: আমার এলাকা থেকে ৫ মিনিটের হাঁটাপথ। সেখান থেকে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। আমি একটা জানাজা পড়তে গিয়েছিলাম। এক ভাতিজার ফুপুর জানাজা ছিল। আসার সময় ইনফরমার দিয়ে জানায়ে দিসে, ওই জায়গায় আছে হান্নান। আমাকে বুঝতে দেয়নি। সিভিল পোশাকে পুলিশ এসেছে ৭-৮ জন। আর বাকি ৭-৮ জন ছিল পোশাকে। পোশাকে যারা ছিল, তারা আসছে পরে। সিভিলে যারা ছিল, তারা এসেছে আগে। আমি বলছিলাম, কেন আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলছে, কথা বলে ছেড়ে দিবো।
জাগো নিউজ: ন্যাশনাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল র্যাপার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার গল্প জানতে চাই।
র্যাপার হান্নান: সোশাল মিডিয়ার কারণে সারা পৃথিবীর মানুষ জানতে পারসে যে, ছেলেটা একটা গানের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছে। সবাই সবার জায়গা থেকে কথা বলছে। ইন্টারন্যাশনাল র্যাপার সংগঠন কথা বলছে। আমি জেল থেকে বের হয়ে শুনছি। তারপর তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। ইউনেস্কোর সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে।
জাগো নিউজ: এই বদলে যাওয়াটা কেমন?
র্যাপার হান্নান: দিন বদল হইসে, খাইয়া-লইয়া আছি আলহামদুলিল্লাহ। বাংলা র্যাপের ফিউচার অনেক ভালো, আমার কাছে মনে হচ্ছে। এখন বাংলা র্যাপ মানুষ শোনে। সব বয়সের মানুষ শোনে। আগে এক রকমের অডিয়েন্স ছিল, এখন সেইটা বাড়সে।
জাগো নিউজ: র্যাপ গানের গালাগাল শোনা যায় কেন?
র্যাপার হান্নান: কারণ মাঝেমধ্যে কি হয় ... আমরা ভায়োলেন্স প্রমোট করি না। সত্য কথা বলতে, সবারই তো একটু খারাপ লাগে। আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে যেমনে বলা যায়, সেইভাবে কথা-বার্তা বলার ট্রাই করি। এমন হইতাছে ... (গান গাইতে শুরু করেন)
জাগো নিউজ: র্যাপার না হলে কী হতেন?
র্যাপার হান্নান: মায়ের ইচ্ছে ছিল পাইলট ছেলে হবে। আমি ছোটকাল থেকে, মানে যখন মানুষ জিজ্ঞাসা করে কী হবে, বলতাম আমি পাইলট হবো। আকাশে প্লেন উড়াবো।
জাগো নিউজ: র্যাপারদের গলায় মোটা চেইন দেখা যায় কেন?
র্যাপার হান্নান: একটু ভালো করে শুনলে দেখবেন, আমরা একটু লোকাল শব্দ ব্যবহার করি। এলাকায় কী চলছে, আশপাশে কী চলছে, আপনার পরিস্থিতি কী, আশপাশের পরিস্থিতি কী এসবের টাচ থাকে গানে। আমি নারায়ণগঞ্জ যে জায়গায় থাকি, আমরা খুব লোকাল টাউন থেকে আসছি। যাদের টাকা পয়সা আছে, তারা দেখায়, দেখো আমার গলায় মোটা চেইন। আমাদের একটা পার্সোনালিটি আছে, কিউ ইন শার্টের সঙ্গে আমরা এইটা পড়ি। আমরা একটু ঢোলাঢালা শার্ট পরতে পছন্দ করি। এতে আমি অনেক কমফোর্টেবল থাকি।
জাগো নিউজ: বর্তমান বাংলাদেশের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
র্যাপার হান্নান: আমার প্রত্যাশা বলতে তেমন কিছুই নেই। আমার কথা হচ্ছে, ৫ আগস্টের আগে-পরে আমরা যা-ই করছি, আমাদের ভিতরে যেন সেই স্পিডটা থাকে, হারায়ে না যায়। যখন দেশের দরকার পড়বে, সবাই যাতে আবারও একসঙ্গে কাজ করতে পারি। আমাদের ভিতরে প্রতিবাদ করার মনটা যেন থাকে। আমাদের দেশটা খুব ভালো দিকে যাচ্ছে। কিছুদিন রাস্তায় মারামারি, কাটাকাটি বাড়সে। সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। টোকাই পোলাপান ছুরি নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে, ধর্ষণ বেড়েছে। একটু নজর দিলে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। দুই নারীর ধর্ষণের বিচার করুক, ২০০ জন ঠিক হয়ে যাবে। ভালো একটা বাংলাদেশে চাই, এইটা আমাদের স্বপ্ন।