ত্রিপুরার নির্বাচন ও সিপিএমের দেউলিয়া রাজনীতি
11 March 2018, Sunday
ত্রিপুরা ভারতের একটা ছোট রাজ্য। কিন্তু সেখানে কয়েকদিন আগের নির্বাচনে সিপিএমের পরাজয় ও বিজেপির বিজয় নিয়ে এখন ভারতজুড়ে তোলপাড় হচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এর বড় রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ত্রিপুরায় সদ্য সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেছেন, এ পরাজয় তাদের কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত, সব হিসাবের বাইরে। এর অর্থ দাঁড়ায়, তাদের হিসাবে ভুল ছিল।
এই ভুলের পর্যালোচনা তারা করবেন। কিন্তু পর্যালোচনার আগেই যে ভুলটি চোখে পড়ার মতো তা হল, ত্রিপুরার আদিবাসী এলাকার দিকে ঠিকমতো নজর না দেয়া। সেখানে আরএসএস ও বিজেপির প্রচারকরা যে লেগেপড়ে থেকে নির্বাচন সামনে রেখে তাদের কাজ একটানাভাবে করে এসেছে, তার কোনো হিসাব না রাখা।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, কংগ্রেসকে হটিয়ে সিপিএমকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মানিক সরকারের পূর্ববর্তী বিখ্যাত মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী আদিবাসী এলাকায় পড়ে থেকে তাদের মধ্যে সাংগঠনিক কাজ ও মতাদর্শগত সংগ্রাম করেছিলেন। আদিবাসী ও সমতলের বাঙালিদের মধ্যে দ্বন্দ্বের একটা মীমাংসা এভাবে সম্ভব হয়েছিল।
মানিক সরকারও ২০ বছর ধরে নৃপেন চক্রবর্তীর এই কাজ ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু এই নির্বাচনে এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল অনেকটা হাতল ছেড়ে দেয়ার মতো। এই ভুলের উপলব্ধি এখন তাদের হয়েছে। কিন্তু ভুলের খেসারত তো তাদের দিতেই হবে। এই ভুল সংশোধন করে পরে তারা তাদের অবস্থান ফিরিয়ে আনতে পারবেন কিনা এটা ভবিষ্যতের ব্যাপার। তবে এটা শুধু ত্রিপুরার সিপিএমের ওপরই নির্ভর করে না। তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির নীতি ও লাইনও এদিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
রাশিয়া ও চীনে বিপ্লব দীর্ঘদিন আগে হওয়া সত্ত্বেও ভারতে বিপ্লব না হওয়ার সর্বপ্রধান কারণ, প্রথম থেকেই তারা ভারতে সংসদীয় রাজনীতির ফাঁদে পড়ে। সেই ফাঁদে পড়া বগার ক্রন্দনধ্বনিই এখন সিপিএমের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মুখে শোনা যাচ্ছে।
একদিকে ভারতের শোষিত-নির্যাতিত কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ এবং অন্যদিকে সংসদীয় পথে ক্ষমতায় বসে শাসক শ্রেণীর অংশ হিসেবে গা ভাসিয়ে দেয়ার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব আছে সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে এখন সিপিএম ও তাদের বাম জোটের অবস্থা শোচনীয়।
একদিকে সংসদীয় রাজনীতি ভারতের কমিউনিস্টদের মধ্যে যে মধুচক্র রচনা করেছিল তার মোহ এবং অন্যদিকে এই অবস্থা তাদের যেভাবে ভোট জয় সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে জনবিচ্ছিন্ন করেছে- এ সমস্যা এখন সিপিএমকে প্রকৃতপক্ষে এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। তাদের অবস্থা এখন ‘শ্যাম রাখি, না কুল রাখি’র মতো!
সিপিএম নেতৃত্বে অনেকদিন ধরে বুড়োদের ভিড়। নেতৃত্বে বুড়ো লোক থাকা এমনিতে খারাপ কিছু নয়। কারণ বুড়ো হলেই যে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায় এমন নয়। কাজেই কিছু বুড়ো নেতৃত্বে থাকার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু নেতৃত্বে বুড়োদের ভিড়ের অর্থ দলে নতুন লোক আসা বন্ধ হওয়া।
এটা একেবারে ভালো নয়। কিন্তু এটা মনে করাও আবার ঠিক নয় যে, অল্প বয়স্করাই পরিত্রাতা। কারণ বয়স কম থাকলেই যে কারও বুদ্ধি, রাজনৈতিক প্রত্যয়, অঙ্গীকার, এমনকি কর্মক্ষমতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা বেশি থাকবে এমন নয়। কাজেই দলে অল্প বয়স্ক লোক আনলেই যে তার ফলে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দিক দিয়ে অবস্থা পাল্টে যাবে, এই আশা করা ঠিক নয়। আসল কথা হল, দেশের পরিস্থিতির সঙ্গে যথাযথ পরিচয় থাকা, নিজেদের ঘোষিত আদর্শ অনুযায়ী দেশের পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ করা এবং তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক লাইন সঠিকভাবে নির্ধারণ করা।
দেখা গেল, সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের ওপরতলার রাজ্য নেতৃত্বে নতুন রক্ত যোগ করার উদ্দেশ্যে বর্ধমানের এককালীন সভাপতি মদন ঘোষের মতো ব্যক্তিকে ‘অল্প বয়স্ক’ হিসেবে প্রমোশন দিয়েছে! কিন্তু এর থেকে কি কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে? প্রথমত, মদন ঘোষ অল্প বয়স্ক নন।
দ্বিতীয়ত, তাকে এই প্রমোশন দেয়ার মতো এমন কী কৃতিত্ব তিনি অর্জন করেছেন? বর্ধমানের জনগণের মধ্যে সিপিএমের আগে যে বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল, তাদের মধ্যে সিপিএমের যে জনসংযোগ ছিল, তা রক্ষা করার ক্ষেত্রে মদন ঘোষের কাজের হিসাব কী? মদন ঘোষ এদিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম নন, একটি উদাহরণ মাত্র। নতুনভাবে নেতৃত্বের তালিকাভুক্ত অন্য অল্প বয়স্কদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
সিপিএম নেতৃত্বের বর্তমান দুরবস্থার মূল কারণ যে সংসদীয় রাজনীতির বৃত্তের মধ্যে আটকা থাকা, এ উপলব্ধি এখনও কোনো সিপিএম নেতা ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। সংসদীয় রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় বসে থাকা যে বুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থের খেদমত করা এ উপলব্ধি তাদের নেই।
একদিকে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর অংশ হিসেবে ক্ষমতায় থাকা এবং অন্যদিকে জনগণের জীবনে মৌলিক ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার চিন্তা যে এক বড় ভ্রান্তি এবং অসম্ভব ব্যাপার এটা চারু মজুমদার উপলব্ধি করেছিলেন, তাদের পার্টি সিপিএমএল উপলব্ধি করেছিল।
এদিক দিয়ে চারু মজুমদার ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু তার সমস্যা ছিল সংসদীয় পথ বর্জন করে বিপ্লবী রাজনীতির নীতি ও কৌশল বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনার ভ্রান্তি। এ কারণেই অগণিত তরুণ ও যুবকের অশেষ ত্যাগ ও সংযম সত্ত্বেও নকশালবাড়ী আন্দোলন নামে পরিচিত তাদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।
ভারতের বিপ্লবী রাজনীতির একটা বড় ট্রাজেডি হল এখানে মাওবাদী নামে পরিচিত বিপ্লবীদের, অসংখ্য তরুণদের ত্যাগ ও আত্মবলিদান সত্ত্বেও তারাও চারু মজুমদারের ভ্রান্ত লাইনের বিশ্লেষণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তারা মূলত সেই ভ্রান্তির ওপর দাঁড়িয়েই এখন ভারতের বিশাল শ্রমিক এলাকা এবং বিশালতর গ্রামীণ জনগণ ও কৃষকদের মধ্যে কাজ করার পরিবর্তে পাহাড়ে-জঙ্গলে থেকে তাদের সংগ্রাম করছেন।
ভারত যে কিউবা নয়, এ বিষয়ে তাদের ধারণা নেই। তারা মাওয়ের লাইনের অনুসারী বলে নিজেদের মনে করলেও মাও কৃষকদের মধ্যে যে ব্যাপক সাংগঠনিক কাজ করেছিলেন তার মতো কোনো কাজ ভারতের মাওবাদীদের নেই। এদিক দিয়ে বলা চলে, ভারতের কমিউনিস্টরা একদিকে সংসদীয় রাজনীতির বৃত্তে বন্দি থাকা এবং অন্যদিকে সংসদীয় রাজনীতি বর্জন করে বিপ্লবী রাজনীতিতে নিযুক্ত থাকা পার্টিগুলো নিজেদের সংগ্রাম ব্যাপক জনগণের মধ্যে না করা ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এক সংকটজনক অবস্থায় ফেলে রেখেছে।
সিপিএমের কথায় ফিরে এসে দেখা যায়, আগামী সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা নিয়ে সীতারাম ইয়েচুরি ও প্রকাশ কারাতের মধ্যে মতানৈক্য চলছে। এই মতানৈক্যের মধ্যে সংসদীয় নির্বাচনের বাইরে থেকে জনগণের মধ্যে আন্দোলন-সংগ্রামের কোনো কথা নেই। নির্বাচনে কংগ্রেস বা অন্য কারও সঙ্গে জোট না বেঁধেও জনগণের মধ্যে বিজেপি কর্তৃক ভারতের বড় পুঁজির খেদমতকারী ও স্বার্থপুষ্ট করা, দলিতদের বিরুদ্ধে, সংখ্যালঘু মুসলমান, খ্রিস্টান ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিজেপির বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে বিজেপিকে নির্বাচনে পরাজিত করার ক্ষেত্রে যে অবদান রাখা যায়, এ চিন্তা দু’পক্ষের কারও মাথায় নেই। কাজেই তারা উভয়েই কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করা না করা নিয়ে বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন।
লক্ষ করার বিষয় যে, এ কাজ করতে গিয়ে ইয়েচুরি তো ননই, এমনকি প্রকাশ কারাত পর্যন্ত কংগ্রেসকে একটা সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে চিহ্নিত করছেন না। বিজেপি যে আকাশ থেকে পড়েনি এবং ১৯৪৭ সাল থেকে কংগ্রেস তাদের সাম্প্রদায়িক নীতি ভারতে কার্যকর করে যাওয়ার পরিণতিতেই যে বিজেপি তাদের উত্তরসূরি হিসেবে ক্ষমতায় এসেছে এ কথা তারা বলছেন না। কারণ এর কোনো উপলব্ধিই তাদের নেই। গান্ধী, নেহেরু,প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, কৃপালিনি প্রমুখ কংগ্রেস নেতা যে সাম্প্রদায়িক ছিলেন এ চিন্তা তাদের মাথায় নেই। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও যে আরএসএস ও বিজেপির সাম্প্রদায়িক ক্রিমিনালদের সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন, এ কাজের দ্বারা বিজেপির শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিলেন, তা নিয়ে করও সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু এ নিয়েও তাদের কথা নেই।
এমনকি ত্রিপুরার এই নির্বাচনের সময় কংগ্রেসের ভদ্রলোকরা যে সিপিএমকে হারিয়ে দেয়া এবং বিজেপিকে জিতিয়ে দেয়ার জন্য বিজেপিকে দল বেঁধে ভোট দিয়েছেন এ কথাও তাদের কারও মুখে নেই। জওহরলাল নেহেরুর ‘অসাম্প্রদায়িক’ চরিত্র নিয়ে তারা এখনও মোহগ্রস্ত। এসবই তাদের চরম দেউলিয়াপনারই উদাহরণ। এই পরিস্থিতিতে সিপিএম নেতৃত্বের মধ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধা ও জোট না বাঁধা নিয়ে যে বিতর্ক ও মতবিরোধ হচ্ছে, এটা শুধু তাদের দেউলিয়াপনার পরিচায়কই নয়, হাস্যকরও বটে।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন