শস্য বহুমুখীকরণের সাথে খাদ্য বহুমুখীকরণ ও খাদ্যনিরাপত্তা নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। প্রথমোক্তটির সাফল্য শেষোক্ত দু’টির সাফল্যে সহায়ক। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ। জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের দেশের আয়তন ক্ষুদ্র হওয়ায় এবং এর পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় প্রতি বছর বাড়তি জনসংখ্যার মাথাগোঁজার ঠাঁই গৃহ নির্মাণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আবাদযোগ্য জমি চাষের আওতাবহির্ভূত হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া শহরাঞ্চলের বিস্তৃতি, চাষযোগ্য জমিতে আবাসন প্রকল্প ও কলকারখানা স্থাপন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো সংশ্লেষে স্থাপনার ব্যাপকতায় আবাদি জমির পরিধি দ্রুত কমছে। এ বাস্তবতায় শস্য বহুমুখীকরণ আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত-উত্তর আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সে সময় যে পরিমাণ ভূমিতে আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধান এক কোটি টন উৎপাদন হতো; বর্তমানে ধানের আবাদে ব্যবহৃত ভূমির পরিমাণ কমলেও উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে তিন কোটি টন ছাড়িয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, যান্ত্রিক চাষ, একফসলি জমিকে দুই বা তিনফসলি ভূমিতে রূপান্তর, উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন, বপন অথবা রোপণ থেকে পরিপক্ব হওয়ার সময়ের হ্রাসে সাফল্য, ক্ষেত্রমতো পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি সমন্বিতভাবে কার্যকরের উদ্যোগ নেয়ার ফলে।
কৃষিকাজের মাধ্যমে উৎপাদিত খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্য শস্যের অন্তর্ভুক্ত। পাট, ফল, ফুল, মাছ, ফলদ ও বনজ বৃক্ষ প্রভৃতি কৃষিপণ্য হিসেবে শস্য। এমনকি রান্নার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ, হলুদ, জিরা, ধনে, এলাচ, গোলমরিচ, দারুচিনি প্রভৃতিও শস্য।
শস্য বহুমুখীকরণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আমাদের জীবনধারণে প্রয়োজনীয় সব কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং বাড়তি উৎপাদিত পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন।
আমরা ধান, সবজি ও আলু উৎপাদনে দুর্যোগের সম্মুখীন না হলে চাহিদা মিটিয়ে রফতানির জন্য কিছু অবশিষ্ট পাচ্ছি। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় সাফল্য। সাফল্যের এই ধারাবাহিকতায় আমরা যদি উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে পারি; তা এক দিকে আমাদানিনির্ভরতা কমাবে, অন্য দিকে কৃষকের জীবনে সমৃদ্ধি আনবে। আমাদের অর্থনীতি এখনো অনেকটা কৃষিনির্ভর। দেশে উল্লেখযোগ্য শিল্পায়ন হওয়া সত্ত্বেও গড় জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অবদান বর্তমানে প্রায় ১৮ শতাংশ। কৃষকের উন্নয়ন মানে তার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কৃষক হওয়ায় এ ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি অর্থনীতিতে যে গতির সঞ্চার করবে তা সার্বিকভাবে অর্থনীতিকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবে।
বর্তমানে দেশের অনেক স্থানে কৃষকরা ধানের সাথে মাছ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। এ সফলতা কৃষকের আমিষের চাহিদা পূরণ ছাড়াও বাড়তি অর্থের জোগান দিচ্ছে। তবে চাষের পদ্ধতিটি নিচু জমিতে সীমিত রয়েছে। অনেক স্থানে ধানের সাথে খেসারি, কলাই ও মুগ ডালের চাষ হচ্ছে। আবার অনেক স্থানে ধানের এক বা দু’টি ফসল করার পর সবজি-মসলা, আলু প্রভৃতির আবাদ হচ্ছে।
একই কৃষিপণ্য সবসময় উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। এটি মূলত নির্ভর করে একটি পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। আমাদের কৃষকদের উৎপাদন ও চাহিদা এ দু’টি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় সাধারণত দেখা যায়, যেকোনো বছর একটি কৃষিপণ্যের উচ্চমূল্য পাওয়া গেলে পরবর্তী বছর কৃষকরা পণ্যটি অধিক হারে উৎপাদন করে। কিন্তু বেশি উৎপাদনে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় যে পণ্যের মূল্য নিম্নমুখী হয়; সে বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে প্রায়ই তাদের লাভের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
এমন অনেক উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য রয়েছে যেগুলোর চাহিদার কিয়দংশ দেশে উৎপাদন হয় যেমন- এলাচ, দারুচিনি, জিরা, গোলমরিচ প্রভৃতি। এসব কৃষিপণ্য ফসলের মাঠের পরিবর্তে বাড়ির আঙিনায় চাষ বেশি লাভজনক ও সুবিধাজনক। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক এখনো এসব কৃষিপণ্যের চাষ ও উৎপাদন পদ্ধতি বিষয়ে অবহিত নয়। এসব পণ্য চাষ বিষয়ে কৃষককে উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে উপকরণ সরবরাহ করে সফলতা প্রত্যাশা করা যায়। তা ছাড়া এসব পণ্য বাড়ির আঙিনায় চাষ করে শতভাগ চাহিদা পূরণ সম্ভব বিধায় আবাদযোগ্য জমি অন্য প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য উৎপাদনে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়।
আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে যেসব ফল উৎপন্ন হয় তার মধ্যে আম, লিচু, বেল, কমলা, তরমুজ, পেয়ারা প্রভৃতি উচ্চমূল্যের ফল হিসেবে বিবেচিত। এসব ফল বছরে একবার উৎপন্ন হয়। উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহারে এসব ফলের উৎপাদন বাড়ানো গেলে কৃষক লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ভোক্তারা সাশ্রয়ী মূল্যে ক্রয়ের সুযোগ পাবে।
আনারস, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, লটকন, বিভিন্ন ধরনের লেবু, কুল, জাম প্রভৃতি আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হয়। এর মধ্যে কলা ও পেঁপে সারা বছর উৎপাদন হয় এবং অন্যগুলো মৌসুমি ফল। এসব ফলের চাহিদা ও জোগানের সমন্বয় থাকায় সব শ্রেণিপেশার মানুষ কমবেশি স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ পায়।
প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর এক অঞ্চলে যে ফল উৎপাদন হয় অতীতে অন্য অঞ্চলে সে ফলের উৎপাদন হতো না। কিন্তু বর্তমানে মাটির গুণাগুণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এক অঞ্চলের ফল অন্য অঞ্চলে উৎপাদন সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় স্ট্রবেরি, আঙ্গুর, মাল্টা, আপেল, কফি প্রভৃতি। স্ট্রবেরি ফলটি দেশে উৎপাদন পূর্ববর্তী সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে ছিল। বর্তমানে এটির ব্যাপক উৎপাদনে মূল্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। বলা যায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে। দেশের কিছু অঞ্চলে আঙ্গুর চাষে সফলতা পাওয়া গেছে তবে তা এখনো চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মাল্টা, আপেল, কফি তিনটি পণ্য রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপন্ন হয়। এ তিন পণ্যের উৎপাদন সম্ভাবনা ব্যাপক হলেও এখন পর্যন্ত তা কাজে লাগানো যায়নি। তা ছাড়া সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ি অঞ্চল এবং ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, ঢাকা ও গাজীপুরের গড় অঞ্চলে পণ্য তিনটি উৎপাদনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
নদীবিধৌত চরাঞ্চলের ভূমি এবং নদী তীরবর্তী ভূমি বালুতে আচ্ছাদিত থাকায় এসব ভূমি পতিত হিসেবে গণ্য হতো। অধুনা এসব ভূমিতে ব্যাপকভাবে ভুট্টার চাষ হয়। ভুট্টা দিয়ে প্রস্তুত খাবার হাঁস-মুরগির খামারের প্রধান খাদ্য হওয়ায় ভুট্টার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। নিকট অতীতেও আমদানি করে ভুট্টার চাহিদা মেটানো হতো। বিগত দু-এক বছরে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন চাহিদা মেটানোর পরও একটি অংশ রফতানির জন্য উদ্বৃত্ত থাকছে।
এক বিঘা জমিতে ফুল চাষ করে যে লাভ পাওয়া যায় তা অন্য যেকোনো খাদ্যজাতীয় কৃষিপণ্য থেকে বেশি হওয়ায় চাষিদের একটি অংশ আবাদি জমিতে ফুল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফুলের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন এখনো সন্তোষজনক না হওয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। পাহাড় ও গড় অঞ্চলে এবং পাহাড়ের পাদদেশে ফুল চাষ বিস্তৃত করে অভাব পূরণ ছাড়াও রফতানির অবকাশ রয়েছে।
এমন কিছু উচ্চমূল্যের বনজ বৃক্ষ রয়েছে যা অল্প পরিসরে ঊর্ধ্বপানে দ্রুত বেড়ে ওঠে যেমন- সেগুন ও মেহগনি। যেকোনো কৃষক বাড়ির আঙিনায় এ ধরনের পাঁচ-ছয়টি গাছ লাগিয়ে ৩০-৪০ বছর লালন করতে পারলে তার পেছনে ফিরে তাকানোর খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না।
মসুর ও মুগডাল এবং যেকোনো তেলবীজ উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য। আমাদের ডাল ও ভোজ্যতেলের বিপুল ঘাটতি রয়েছে। আমন ধান কাটার পর একই জমিতে ডাল ও তেলবীজের আবাদ করে কৃষক লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ঘাটতি পূরণে এগিয়ে আসতে পারে।
ইদানীং ধানের কুঁড়ার তেল ভোক্তাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ তেলটির মূল্য সয়াবিন বা পাম অয়েলের চেয়ে বেশি হলেও এটির শোষণ ক্ষমতা কম হওয়ায় ব্যবহার সাশ্রয়ী। চিকিৎসকদের মতে, অন্য যেকোনো ভোজ্যতেলের চেয়ে এটি বেশি স্বাস্থ্য উপযোগী। ধানের কুঁড়ার তেল উৎপাদন ও ব্যবহারে কৃষকের জন্য দু’টি বাড়তি পয়সা উপার্জনের পথ করে দিয়েছে।
আমাদের পাহাড় অঞ্চলের বিশাল ভূমি বৃক্ষশূন্য ও অনাবৃত। তা ছাড়া আবাদযোগ্য অনেক ভূমি এখনো আনাবাদি রয়েছে। সড়ক, রেলপথ, বেড়িবাঁধের দু’পাশ ও বিশাল সীমান্ত এলাকায় বৃক্ষরোপণের সুযোগ রয়েছে। এসব ভূমিতে চাহিদা ও উপযোগিতার কথা বিবেচনায় রেখে বৃক্ষরোপণ ও ক্ষেত্রমতো চাষের উদ্যোগ নেয়া হলে শস্য বহুমুখীকরণের পথ অনেকটা প্রশস্ত হবে।
কথাটি সত্য যে, আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় ভূ-ভাগ সীমিত হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনযোগ্য সব কৃষিপণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ভূমিস্বল্পতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের অল্প সময়ের মধ্যে একই ভূমি থেকে সর্বোচ্চ উপযোগিতা লাভের প্রয়াস নিতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পাশাপাশি যার যার অবস্থান থেকে দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষের একনিষ্ঠ হয়ে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। এর মধ্যে নিহিত আছে শস্য বহুমুখীকরণের সাফল্যের সুপ্ত বীজ।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন