ইংরেজ লেখক চার্লস ডিকেন্সের ‘আ টেল অব টু সিটিজ’-এর আদলে এই গল্পের নাম দেওয়া যায় ‘আ টেল অব টু ওয়াইভস’। স্বামী যখন বড় পদ নামক আলাদিনের চেরাগের ছালবাকলা ঘষে ঘষে তুলে ফেলছিলেন, স্ত্রী তখন অসুখী। স্বামীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যখন লাখ লাখ টাকা জমা হচ্ছিল; তখন দুদক নয়, পুলিশ নয়, গোয়েন্দা সংস্থা নয়, বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে যান স্ত্রী। ভালো জিন, মন্দ জিনের মতো স্ত্রীদের মধ্যেও ভালো-মন্দ আছে।
এমন স্ত্রীকে কী বলা যায়? ঘরের শত্রু বিভীষণ? এই নারী বিভীষণকে ক্ষমা করেননি স্বামী। সোজাসাপটা তালাক দিয়ে দিয়েছেন। দুর্নীতির আদর্শে অবিচল কালাপাহাড় এই স্বামী মহোদয়। গণপূর্ত বিভাগের নীলফামারীর উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান এখন দুর্নীতিবাজদের ‘হিরো’। তাঁর মটো বা প্রেরণা হলো: যায় যাবে স্ত্রীধন, দুর্নীতিই মানিকরতন।
আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী রেজওয়ানা হাসনাত খুশবু অভিযোগ করেছেন, ঘুষকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় তিনি নির্যাতিত হন। এর জেরেই তালাক দেওয়া হয় তাঁকে। যেনতেন ঘুষ নয়, মসজিদ নির্মাণের ঠিকাদারদের থেকে বিপুল ঘুষ নিয়ে আলোচিত আশরাফুজ্জামান (সমকাল, ৪ জুলাই, ২০২৪)।
আবার এমন স্ত্রীও আছেন- স্বামী যখন অবৈধ আয়ের পাহাড়ের তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছেন, পুলিশ যখন তাঁকে খুঁজছে, তখন রওশন এরশাদের মতো লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুতির পরে এরশাদ যখন দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন, রওশনই তখন স্বামীর ভাবমূর্তি ও দলের হাল উদ্ধারে নেমেছিলেন। এমন ভাগ্য ক’জনার হয়? যেমন ভাগ্যবান আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান। দিব্যি করে-কর্মে খাচ্ছিলেন। বিপত্তি বাধালো এক অপয়া ছাগল। পুত্র ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কিনতে গিয়ে সছাগল ভাইরাল হলো। ছাগলের কান টানতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল মতিউরের বিত্তশালী মাথা। জানা গেল, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীরের মতো তাঁরও অবৈধ সম্পদের ছড়াছড়ি। পুলিশও ‘তারে ধরি ধরি ধরতে গেলেম আর পেলেম না’ গাইতে বসে গেল। সংবাদমাধ্যম দুর্নীতির তুলো দক্ষ ধুনকরের মতো ধুনে যেতে লাগল।
এ রকম সময়ে মতিউর রহমানের ত্রাতা হিসেবে হাজির প্রথম স্ত্রী ও নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকী। কয়েকদিন লুকিয়ে থেকে তিনি ‘বড় সাংবাদিকদের কিনে’ দৃশ্যপটে ফেরার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে যাই হোক না কেন, নজর ছাগল থেকে স্ত্রীর ওপর সরে গেল। এই না হলে স্ত্রী!
পুরুষদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, কোন ধরনের স্ত্রী তারা চান? ৯৭ ভাগই বলবেন, রেজওয়ানা হাসনাত খুশবু নয়, তারা লায়লা কানিজের মতো স্ত্রীই চান। স্বামী গর্তে পড়লে যিনি টেনে তুলবেন, স্বামীর বদনাম নিজের গায়ে নেবেন, দুর্নীতির একটা টাকাও বিফলে যেতে দেবেন না। কেন দেবেন? মতিউরের মতো সম্পদোৎপাদনশীল স্বামী ছিলেন বলেই না তিনি, লায়লা কানিজ, কলেজ শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নরসিংদী উপজেলা চেয়ারম্যান হতে পেরেছেন। ২০২২ সালে রাজনীতিতে এসেই তিনি নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদকের পদও বাগিয়েছেন।
প্রশ্ন ফাঁসের দালাল আবেদ আলী কি দানবীর আবেদ আলী হতে পারতেন যদি স্ত্রী বলতেন, দেশের প্রশাসনের ভবিষ্যৎ বিক্রির টাকা আমি খাব না! পারতেন না। তাই নীলফামারীর গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান কোটিপতি হওয়ার মুখেই থমকে গেলেন, মতিউরদের মতো শতকোটির মালিক হতে পারলেন না। ভবিষ্যতের আবেদ আলীরা এখন বিয়ের সময় হবু স্ত্রীকে খত পড়িয়ে নিতে পারেন যে, স্বামীর অবৈধ ইনকাম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না; তুললেই ‘বিবিতালাক’। হুহ!
ঘুষ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ‘আলোকিত’ ঘটনা। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মসনদহারা করানোর জন্য সেনাপতি মীর জাফরকে ঘুষ দিয়েছিলেন লর্ড ক্লাইভ। শুধু ঘুষ নয়, সিরাজের সিংহাসনও তাঁকে দেওয়া হবে বলে চুক্তি করা হয়। তার ফল শুধু বাংলা কেন ভারতবাসীও ভোগ করেছে। মীর জাফর ও ক্লাইভও ভোগ করেছেন। মীর জাফর গদিহারা-ইজ্জতহারা হয়ে মরেছেন। আর রবার্ট ক্লাইভকে করতে হয়েছে আত্মহত্যা। কিন্তু ব্যক্তির দুর্নীতির খেসারত ব্যক্তির শাস্তিতে শেষ হয় না, তার দায় ভোগ করে দেশ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এমনকি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বও চলে যেতে পারে।
ব্যক্তির দুর্নীতি তাই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলে। রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে, অর্থনীতির ভিত ধসে যেতে পারে, সমাজ অন্যায়-অনিয়মকেই মুরুব্বির পদে বসিয়ে দিতে পারে। পাঁচ আঙুলের একটি দুর্নীতির টাকায় ফুলে কলাগাছ হয়ে গেলে বাকি আঙুলগুলির কী দাম? চোরের মায়ের গলা তখন জিরাফের মতো বড় দেখায়। চোরের পুত্ররা মেধাবী ও পরিশ্রমী ছেলেমেয়েদের টা টা বলে আরও ওপরে উঠে যায়। নীতি নয়, দুর্নীতিই যেহেতু সংক্রামক, সেহেতু দুর্নীতিবাজরা পুরো সমাজকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে। ঝুড়ির একটা পচা আম বাকি আমগুলি পচিয়ে দিতে যথেষ্ট। এ জন্যই দুর্নীতিবাজদের পরিবারে, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুমহলে খুব কম লোককেই পাওয়া যায়, যারা বলতে পারে– তুমি ভালো না, তুমি দুর্নীতিবাজ। দুই-দশ ডজন দুর্নীতিবাজ দমন করা খুবই সম্ভব। কিন্তু দুর্নীতিবান্ধব এই সংস্কৃতি এই সমাজকে পাল্টানো যাবে কীভাবে?
দুর্নীতিই এখানে নীতি, সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি এর ম্যানেজার, অর্থনীতি দুর্নীতির কারখানা। বিরাট ধাক্কা এবং আমূল পরিবর্তন ছাড়া এই চোরাবালি থেকে আমাদের উদ্ধার নাই।
এক্ষণে তাই প্রশ্ন, এ রকম দুর্নীতির মেলায় কী করে প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামানের স্ত্রী ঘুষের টাকায় আপত্তি জানালেন। হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত নৈতিকতার জোর। দেশজুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যখন ধিক্কার জাগছে, রাজপথে যখন তরুণেরা প্রশ্ন ফাঁস ও কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন; তখন বোধহয় তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তাঁর হয়ে আমরা আন্দোলনকারী তরুণদের কাছে জিজ্ঞাসা রাখতে পারি, আপনারা যদি কখনও প্রশাসনিক পদে বসেন, প্রকৌশলী বা পরিচালক হন, তখন কি মতিউর-আশরাফ-বেনজীরের মতো হবেন? আপনাদের স্ত্রী বা স্বামী দুর্নীতি করলে তা অনিবার্য ভেবে মজা উপভোগ করবেন? বৈষম্যের বিরুদ্ধের আন্দোলন কি দুর্নীতি বিষয়ে নীরব থাকতে পারে?
আজকে গুটিকয়েক চুনোপুঁটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, এদের নাটকীয় আবির্ভাবে মানুষ ভুলে গেছে আজিজ-বেনজীরদের কথা। এরা তো দুর্নীতির সিস্টেমের খুঁটিনাটি বা নাটবোল্ট মাত্র। জনগণের মনের আশ মেটাতে এদের কয়েকজনকে ফেলে দিলে সিস্টেমের বরং লাভ। সাফসুতরো চেহারা নিয়ে নিজেদের নবায়ন করে নিতে পারে। মতিউর-বেনজীর-আবেদ আলীদের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে নতুন লোকেদের নিয়োগ দিতে পারে। দুদকের হাত কর্তাদের শাদ্দাদের বেহেশত ছুঁতেই পারবে না।
অ্যাপেনডিক্স ফেলে দিলে শরীর আরও সবল হয়। খুচরা দুর্নীতিবাজদের দৌড়ানি দিলে দুর্নীতি আরও পাকাপোক্ত হয়। দুর্নীতির বিরোধিতা তখন হয়ে দাঁড়ায় গুলিস্তানের মলম বিক্রেতার গলাবাজির মতো। গলাবাজিতে মুগ্ধ জনতা খেয়ালই করবে না যে, এসব কেরামতির আড়ালে পকেট মারা যাচ্ছে। হুঁশ ফিরলে তারা দেখবে, তাদের অবস্থা হয়েছে একসময়ের লাভজনক জনতা ব্যাংকের মতো। বারো ভূতে খেয়ে প্রায় দেউলিয়া।
কিংবা জনতার হতে পারে সেই দশা, যা এ মাসেই হয়েছিল কুমিল্লায়। তিতাস গ্যাসের পিয়ন জহিরুল ইসলাম জহিরের স্ত্রী তিনজন। স্ত্রীরা বিলাস-ব্যসনে দিন গুজরান করেন। কিন্তু দুদকের মামলায় স্বামী খালাস, সাজা হয়েছে তিন স্ত্রীর (দুর্নীতির সম্পদের সঙ্গে বহুবিবাহ, অনৈতিক সম্পর্ক, পি কে হালদারের মতো অজস্র বান্ধবী পোষার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা হতে পারে); জহিরুল সব মামলার আসামি থাকলেও তাঁর কোনো অপরাধই প্রমাণ করতে পারেনি দুদক।
ফলে যে দেশের জনগণ দুর্নীতির দই খেতে ইচ্ছুক, তাদের অবস্থা হতে পারে ওই জহিরুলের তিন স্ত্রীর মতো। জগতে দুর্নীতিবাজের স্ত্রী হওয়া ভালো কথা না। শুনতে পাই, কোনো কোনো দেশ নাকি অপর কোনো দেশের ‘স্ত্রী’। কোন ধরনের স্ত্রী? প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামানের সৎ স্ত্রী রেজওয়ানা হাসনাতের মতো, নাকি রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের ধুরন্ধর স্ত্রী লায়লা কানিজের মতো?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন