তিন যুগ পার হয়ে গেল, দেশের বাইরে আছি। ইদানীং বেশ ক’বছর ধরে গ্রীষ্মকালে ছুটির অভাবে বাংলাদেশে যাওয়া হয় খুব কম। যখন যাই তখন কয়েকটি বিষয় আমাকে খুব টানে, ভীষণ আকৃষ্ট করে, আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়, মনকে আন্দোলিত করে। প্রথমত, প্রিয়জন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সংস্পর্শ ও সান্নিধ্য এবং ছুটির দিনে তাদের সাথে মন খুলে আড্ডা মারা, গল্প করা আমার জন্য একটা দারুণ মজার ব্যাপার! এ সব আড্ডার আসরে যেন একধরনের মাদকতার গন্ধ পাই, রীতিমতো নেশা ধরে, কথায় কথায় কোন দিকে সময় চলে যায়, টেরই পাই না। স্বজনদের নিখাদ আতিথেয়তা এবং এর সাথে উদার ও সহৃদয় আপ্যায়নে মুগ্ধ হই, সীমাহীন তৃপ্তি পাই। এ সব কিছুকেই খুব স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত মনে হয়। হবে না কেন, তারা যে আমার অতি কাছের মানুষ, আপনজন, তাদের সাথে যে আমার রক্তের সম্পর্ক, হৃদয়ের বন্ধন। কোনো কিছুই এ বাঁধন টুটাতে পারে না, ছিঁড়তেও পারে না। বাঙালি সংস্কৃতির এ এক অপূর্ব বৈশিষ্ট্য বৈকি।
দ্বিতীয়ত, অনেক দিন পর বাংলাদেশের মজাদার খাওয়াদাওয়া আমার খুব ভালো লাগে, উপভোগ করি। প্রিয় খাবারের তালিকায় আছে পাবদা মাছ, ইলিশ মাছ ও ইলিশের ডিম; ছোট চিংড়ি দিয়ে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, অথবা কচুরলতি; পেঁপে কিংবা কাঁচকলা দিয়ে দেশী মাগুর মাছের ঝোল; বড় কৈ-এর দোপেয়াজা; ভাজা বাচা মাছ, কেচ্কি মাছের চচ্চড়ি, তাজা তরিতরকারি, লালশাক এবং নানা জাতীয় সবুজ শাক ইত্যাদি। বাংলাদেশের কাচ্চি বিরিয়ানি আর শামী কাবাব এবং দৈ-মিষ্টিও কোনো অংশে কম লোভনীয় নয়, তবে আজকাল সেগুলো একটু রয়েসয়ে খাই। আগের মতো গোগ্রাসে গিলি না। যে ক’দিন থাকি, এক দিন এক দিন করে দিন গুনি, আর ক’দিন আছি, আমার দেশে, প্রিয় দেশে, বাংলাদেশে!
নাড়ির টানে যখন যাই, বেশির ভাগ সময় ঢাকাতেই কাটে। বাইরে খুব একটা বের হই না। চার দেয়ালের ভেতর প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কারো বাড়িতে দাওয়াত অথবা দরকারি কাজে অফিস আদালতে যেতে রাস্তার খানাখন্দক, কাদাপানি, ধুলোবালি এবং সর্বোপরি ট্রাফিক জ্যাম ভীষণ বিরক্তিকর বলে মনে হয়! প্রতিবারই ভাবি, আগামীবার এলে অবস্থার উন্নতি দেখব। কিন্তু উন্নতির বদলে মনে হচ্ছে রাস্তার অনিয়ম, অব্যবস্থা যেন খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকেই যাচ্ছে! সব সময় হয় না, মাঝে মধ্যে শরীরও খারাপ করে ফেলে। দু’একবার আমাশয়, উদরাময়ে আক্রান্ত হয়েছি, একবার হয়েছে টাইফয়েড। বুঝতে পারি, বিদেশে থাকতে থাকতে শরীরের রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
একই রেস্তোরাঁর একই পাতিল থেকে একসাথে ইলিশ মাছ খেলাম আমি ও আমার বন্ধু। তার কিছুই হলো না, আমার দেহে টাইফয়েড বাসা বাঁধল। আরেকবার দেশ থেকে ফিরে আসার দিন এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে গেলাম। আমার তিন ছেলেমেয়ে প্রায় দু’মাস বিছানাবন্দী ছিল। এ জাতীয় অভিজ্ঞতা ভীতিকর ব্যাপার! বেপরোয়া মিনিবাসের চালক চোখের সামনে এভাবে ধাক্কা মেরে চলে গেল, তাকে আইন-আদালতের আওতায় আনতেই পারলাম না! চেষ্টা করা বৃথা বলে এ নিয়ে চিন্তাও করিনি। এটাই স্বাভাবিক; এভাবেই চলছে দেশ, চলবে বহু দিন, কত দিন, কে জানে? তার পরও যেতে চাই, দেশে যাই। কারণ এ যে আমার দেশ, আমার জন্মভূমি, মাতৃভূমি, জননীর মতো আপন!
যখন প্রবাসে থাকি তখন কি দেশকে ভুলে যাই? না, দেশের কথা, প্রিয়জনদের কথা সবসময় মনে পড়ে। দেশের কথা ও তাদের কথা ভাবি, সবার মঙ্গল কামনা করি। হাজার হাজার মাইল দূরে থাকলেও প্রতিদিন দেশী খবরের কাগজের পাতায় চোখ বুলাই, বারবার। যখন কোনো ভালো খবর দেখি, তখন খুশি হই, মন আনন্দে নেচে ওঠে। যখন দুঃসংবাদ পড়ি তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। ভাবি, প্রবাসে অনিরাপদ হয়ে পড়লে ঠাঁই পাবো কোথায়? এ ছাড়া বাংলাদেশ আমাকে কেবল আলোহাওয়া দিয়ে লালন করেনি, বড় করেনি, অনেক কিছু দিয়েছেও। বিনিময়ে দেশের প্রতি আমার ঋণ শোধ করতে পারলাম কই? এ যন্ত্রণা আমাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। মনে হয়, যুগ যুগ ধরে দেশ থেকে পালিয়ে এসে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে চলেছি। নিজের ভাগ্য কতটা গড়তে পেরেছি, জানি না। তবে দেশের ভাগ্য গড়ার মহৎ কাজে প্রিয় দেশবাসীর সঙ্গে শামিল হতে পারিনি। আফসোস হয়, বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে গঠনমূলক কোনো কাজ করার সুযোগ বুঝি জীবনে আর আসবে না, পাবো না!
তবু দেশকে ভুলতে পারি না। সকালে ঘুম ভাঙে দেশের খবর দেখে, দিনে একাধিকবার দেখি, ঘুমাতে যাওয়ার আগেও আরেকবার। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলেও বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেলফোনের পর্দায় দেখি দেশে কী হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, খারাপ খবরই চোখে পড়ে বেশি। বিভিন্ন জাতের খবরের মাঝে প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় অসংখ্য ছবি ছাপা হয়। খবর পড়ার সাথে সাথে ছবিগুলো বরং অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখি, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, বোঝার চেষ্টা করি। কোনোটা বুঝি, কোনোটা বুঝি না। প্রতিটি ছবি যেন একেকটি জীবন্ত গল্প, একেকটি সরস কাহিনী। কোনোটি সুখের, কোনোটি দুঃখের। আপনাদের কাছে আজ যে ছবির গল্প পাড়ব, তাতে সুখ-দুঃখ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
ইদানীং আমার ইউএসবি ফ্ল্যাশ ড্রাইভে আমি একটি নতুন ফোল্ডার খুলেছি। নাম দিয়েছি My Photo Gallery। যখন যেখানে মনোরম ছবি পাই, আলাদা আলাদা ফাইলে জমিয়ে রাখি ওই Photo Gallery-র ফোল্ডারে।
ওপরের ছবিটি মাত্র ক’দিন আগে তোলা হয়েছে খুলনার কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আজই ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। কী নির্মল, কী অপরূপ, কী পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর এই ছবিখানি! পত্রিকার পাতা থেকে ছবিটি মাত্র যোগ করেছি আমার ইলেকট্রনিক ছবির সংগ্রহশালায়। প্রথমে ভেবেছিলাম, লেখাটার শিরোনাম দেব, ‘একটি গাছ, একটি ফুল ও একটি পাখি’, কিন্তু ভালো করে চেয়ে দেখি, পাখিটি কোনো গাছে বসেনি, গাছের ডালেও না, সে বসেছে একটি বেড়ে ওঠা বাঁকানো সবুজ লতার ডগায়। আর তাই নামটাও বদলে দিলাম এবং সংক্ষেপে রাখলাম, ‘একটি ফুল ও একটি পাখি’।
ছোট্ট পাখিটি কুচকুচে কালো। তার ঘন অন্ধকার অবয়বে উজ্জ্বল নীল রঙের ছোঁয়া চমৎকার লাগছে! যেন কোনো শিল্পী তুলি দিয়ে আঁচড় মেরেছে কালো পাখির ঘাড়ে পিঠে। কী সুখে পাখিটি কোত্থেকে উড়ে এসেছে, কে জানে? কোনো গাছের গায়ে পেঁচিয়ে ওঠা জংলি লতায় বসে একাগ্র মনে তাজা ফুলের নির্যাস শুষে নিচ্ছে। ইদানীং বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর অবিরাম অত্যাচার ও নির্যাতন চলছে তার পরও খুলনার কোনো বনে কিংবা লোকালয়ে এমন সুন্দর টগবগে লতা গজিয়েছে, সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে তাতে ফুল ফুটেছে, ফুলের বুকে মিষ্টিমধুর রসও জমেছে, এ তো সব সুখের কথা, আনন্দের কথা! এমন সুন্দর ঝলমলে পাখি বাংলাদেশের বাতাসে উড়ে বেড়ায়, গাছে গাছে বসে, ডালে ডালে লাফায়, গান গায়, ফুলের রস খায়, সেও তো সুখেরই গল্প, সুখেরই কাহিনী। ছবিটি যখন দেখেছি, বারবার চেয়ে থেকেছি, আনন্দ পেয়েছি, উপভোগ করেছি। ছবি দেখে চোখ জুড়িয়েছে, হৃদয়-মন ভরেছে। এই ছবি গ্রামবাংলার কথা বলে, বাংলাদেশের কথা বলে, কী অপরূপ আমার দেশ, কী সুন্দর আমার বাংলাদেশ। সংক্ষেপে এই হলো ছবিটির সুখের দিক, সুখের কাহিনী।
আপনারা বলবেন, তা হলে দুঃখটা কোথায়? আছে বৈকি, তবে সেটা ছবিটির ভেতরে নয়, আমার দুর্বলচিত্তে। বাইরে থেকে দৃষ্টিনন্দন ওই ছবিটির কপালে বেদনার তিলক আমিই এঁকে দিয়েছি। জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় বাংলাদেশে পার করে এসেছি। শহর-বন্দর, গ্রামগঞ্জে অনেক ঘুরেছি। গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথে খালি পায়ে লক্ষ্যহীনভাবে মাইলের পর মাইল হেঁটেছি, পাখির বাসা খুঁজেছি। ধানক্ষেতের সরু আল ধরে কাদাপানি মাড়িয়ে ঘুরেছি ফড়িং ধরব বলে। বেতবনে ঢুকেছি বেতফল খাওয়ার লোভে, কাঁটার খোঁচা খেয়ে রক্তাক্ত দেহে বেরিয়ে এসেছি, বেতফলের থোকায় হাতও দিতে পারিনি। বনবাদাড়ে এত ঘোরাঘুরির পরও এমন সুন্দর কালো পাখি দেখিনি কোথাও বাংলার মাঠেঘাটে, কোনো গাছের মরা ডালে কিংবা ঝোপঝাড়ে।
লতাগুল্মে এমন রঙিন ফোটা ফুলও তো চোখে পড়েনি কোনো কালে। বাঙালি হয়ে, বাংলার আলো-হাওয়ায় বড় হয়ে, আমার দেশের এমন সুন্দর রূপ দেখিনি, যা দেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। হয়তোবা আমার দৃষ্টিতে সেই তীক্ষ্ণতা ছিল না, মনের উদারতায় ঘাটতি ছিল, তাই তো গ্রামীণ প্রকৃতির এত কাছে থেকেও বাংলাদেশের পূর্ণ অবয়ব দেখতে পাইনি, তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য অনুভব করতে পারিনি। এর চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে? এ হলো আমার আজকের দুঃখের কথা, দুঃখের গল্প। তার চেয়ে বড় বেদনার কথা, হতাশার কথা- এমন সুন্দর এই পাখিটির নামও জানি না, এমন চোখ-জুড়ানো মন-ভুলানো ফুলটিও চিনি না। কেউ আমাকে শেখায়নি, চিনিয়ে দেয়নি, আমিও তো চেষ্টা করিনি। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, যে আমি আমার দেশের পাখি চিনি না, ফুলের নাম জানি না, সে আমি কি দেশকে জানি? নিজেকে চিনি?
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন