
ব্রিটেন কানাডা অস্ট্রেলিয়া পর্তুগালের পর ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আরো অনেক রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর বিরোধিতা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণায় বলেছেন, আর অপেক্ষা করা যাবে না; ফ্রান্স ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং সেখানে দূতাবাস খুলবে।
দুই রাষ্ট্র সমাধানের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের বৈধ অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া ইসরাইলের অধিকার কেড়ে নেয় না, দুই রাষ্ট্র সমাধানই শান্তির একমাত্র কার্যকর পথ। তিনি ইসরাইলে সংঘটিত ভয়াবহ হামলা ও গাজার মানবিক বিপর্যয়ের নিন্দা করে বলেন, জীবন বাঁচাতে যুদ্ধবিরতি এখনই জরুরি।
ম্যাক্রোঁ গাজায় মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি ও ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে এ অঞ্চলে বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব করেন। ৪৮ জন জিম্মির মুক্তির ওপর জোর দেন। তিনি ইসরাইলকে ফিলিস্তিনের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন ও মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনি শান্তির জন্য নতুন নিরাপত্তা কাঠামো তৈরির আহ্বান জানান। তবে আব্রাহাম চুক্তি সম্মান না করলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আসবে না বলে সতর্কও করেন।
শান্তির বার্তায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেন, ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলিদের বিচ্ছিন্নভাবে বেঁচে থাকা অবসানের সময় এসেছে। আইজাক রবিনের শান্তির জন্য প্রাণ বিসর্জনের উদাহরণ টেনে বলেন, শেষ পর্যন্ত শান্তি আসবে। সংক্ষেপে, ম্যাক্রোঁর বক্তব্যের মূল বার্তা ছিল- ফ্রান্স এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে; যুদ্ধবিরতি, মানবিক সহায়তা, নিরাপত্তা কাঠামো ও দুই রাষ্ট্র সমাধান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি সম্ভব নয়।
জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে (সোমবার) লুক্সেমবার্গ, মাল্টা ও মোনাকোর প্রধানমন্ত্রীরাও আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। লুক্সেমবার্গের প্রধানমন্ত্রী লুক ফ্রিডেন বলেন, এই স্বীকৃতি ‘শান্তি, ক‚টনীতি, সহাবস্থান ও দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি নতুন প্রতিশ্রুতির সূচনা’। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এটি ইসরাইল বা তার জনগণের বিরুদ্ধে নয়, বরং ন্যায়ভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। ফ্রিডেন জানান, নেতানিয়াহুর সরকার ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চায় না, আর হামাসও ‘গণতান্ত্রিক ফিলিস্তিন’ রাষ্ট্র চায় না, তাই এখনই দুই রাষ্ট্র সমাধানকে নতুনভাবে সুযোগ দেয়ার সময়।
স্বীকৃতির সাথে নির্বাচন আয়োজনের মতো শর্ত থাকতে পারে, তবে হামাসের জিম্মিদের মুক্তি দেয়া স্বীকৃতির পূর্বশর্ত নয়। গাজায় চলমান যুদ্ধ ও মানবিক পরিস্থিতিকে ফ্রিডেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন বলেছেন এবং ইসরাইলের নীতি পরিবর্তন না হলে ইউরোপীয় স্তরে নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ পশ্চিমা দেশগুলোর এই পদক্ষেপকে ‘ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তির পথে বড় অগ্রগতি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, এখন গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করা ও দুই রাষ্ট্র সমাধানকে নষ্ট করে এমন সব পদক্ষেপ থামানো জরুরি।
ইউরোপের কয়েকটি দেশ প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে- যা দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি নতুন আন্তর্জাতিক চাপ ও সমর্থনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া কেবল প্রতীকী নয়, এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ফিলিস্তিনকে একটি বৈধ রাজনৈতিক ও আইনি মর্যাদা দেয় এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পুনরুজ্জীবনের সঙ্কেত দেয়।
হামাসের প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
হামাস এই স্বীকৃতিকে বড় কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখবে, যা তাদের দীর্ঘ আন্দোলনের স্বীকৃতি। এতে হামাসের ইতিবাচক প্রচার ও বৈধতা বাড়বে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে হামাসের দাবি, উপস্থিতি ও প্রভাব শক্তিশালী হতে পারে। হামাস সতর্ক হবে, বাস্তব ফল চাইবে। তারা বলবে, কেবল কাগুজে স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়। হামাস অবরোধ শিথিল, যুদ্ধবিরতি, বন্দিমুক্তি ও মানবিক প্রবেশাধিকারের মতো বাস্তবতামূলক পরিবর্তন আশা করবে। তারা আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর এবং ইসরাইলের নীতির বিরুদ্ধে আইনি/কূটনৈতিক ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করবে।
পশ্চিমা দেশগুলো মূলত হামাসের প্রতিরোধের কারণেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু হামাসকে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত না করলে, তারা স্থানীয় সমর্থন শক্তিশালী করতে এবং রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চাইবে। শর্তাদি ও ক্ষমতা বণ্টন নিয়ে অনমনীয়তার কারণে যদি পশ্চিমা দেশগুলো স্বীকৃতিতে হামাসকে রাজনৈতিকভাবে বাইরে রাখার শর্ত আরোপ করে (পিএ-কেন্দ্রিক সমাধান বা হামাসের ক্ষমতা হ্রাস), তা হামাস মেনে নাও নিতে পারে। স্বীকৃতি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা স্থানীয় সমর্থন শক্তিশালী করতে এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক মজবুতির জন্য তা ব্যবহার করবে। হামাসের পূর্ণ সরকারি বক্তব্য এবং পশ্চিমা শর্তগুলোর বাস্তব প্রয়োগ না দেখা পর্যন্ত কতটা কার্যকর পরিবর্তন হবে তা অনিশ্চিতই থেকে যাবে।
স্বীকৃতির প্রভাব
ব্রিটেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি ফ্রান্স পর্তুগালের মতো বড় পশ্চিমা দেশের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়া সরাসরি ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থান বদলে দিতে পারে, যদিও সাথে সাথে তাদের দৈনন্দিন জীবনে বড় পরিবর্তন নাও আসতে পারে। মূল কয়েকটি লাভ বা প্রভাব হলো-
কূটনৈতিক ও আইনি মর্যাদা বৃদ্ধি : এই দেশগুলো দীর্ঘদিন ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত। তাই তাদের স্বীকৃতি ফিলিস্তিনের দাবিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে বেশি বৈধতা দেবে। জাতিসঙ্ঘে পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় (আইসিসি, আইসিজে ইত্যাদি) আরো শক্তভাবে অংশ নেয়ার সুযোগ বাড়বে।
দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে চাপ বৃদ্ধি : পশ্চিমা মিত্ররা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ফিলিস্তিন’কে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, ইসরাইলের ওপর দুই রাষ্ট্র সমাধান নিয়ে আলোচনায় বসার চাপ বাড়বে। ভবিষ্যতের শান্তি আলোচনা বা মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে সমান পক্ষ হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতা বাড়তে পারে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতায় সুযোগ : এই দেশগুলোর স্বীকৃতি সরকারি উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) বা দ্বিপক্ষীয় অনুদান/ঋণের পথ সহজ হতে পারে, কারণ তারা ফিলিস্তিনকে ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবেচনা করবে। ফিলিস্তিনি পাসপোর্ট ও ভ্রমণ নথি নিয়ে স্বীকৃতির ফলে কিছু দেশে চলাচল ও বাণিজ্য সুবিধা বাড়তে পারে।
প্রতীকী শক্তি ও মনোবল : গাজা ও পশ্চিম তীরে চলমান সঙ্ঘাতের মধ্যে এমন স্বীকৃতি ফিলিস্তিনিদের জন্য নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থনের বার্তা দেয়। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বৈধতা নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়, যা জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে।
তবে এ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, স্বীকৃতি দেয়া মানেই ইসরাইল অবিলম্বে দখলনীতি বা অবরোধ শেষ করবে না। নিরাপত্তা, বসতি উচ্ছেদ, সীমানা নির্ধারণ বা জেরুসালেমের মর্যাদা- এসব প্রশ্ন অমীমাংসিত থাকবে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ বিভাজন (হামাস-ফাতাহ) সমাধান না হলে বাস্তব সুবিধা সীমিত থাকতে পারে।
ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
ইসরাইল এই পদক্ষেপকে একপাক্ষিক ও ‘সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কার দেয়া’ হিসেবে দেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি বা বিরোধিতা স্বীকৃতির ফলাফল সীমিত করতে পারে, বিশেষ করে নিরাপত্তা, মধ্যস্থতা ও অর্থনৈতিক ব্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে। এ ছাড়া পশ্চিম তীরে সামরিক অভিযান বা নিরাপত্তা অভিযানের সম্ভাবনা মাঝারি; তবে বড় আন্তর্জাতিক হামলার সম্ভাবনা নিম্ন। এটি স্থানীয় উত্তেজনা বৃদ্ধির সাথে সীমাবদ্ধ থাকবে।
পশ্চিমের স্বীকৃতি ফিলিস্তিনিদের আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করতে, ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক/উন্নয়ন সহযোগিতার পথ খুলে দিতে পারে এবং ইসরাইলের ওপর দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের চাপ বাড়াবে। তবে এখনই ভূমি, নিরাপত্তা বা অবরোধের বাস্তব পরিবর্তন ঘটবে না- এটা হবে ধীর, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ।
মূল তাৎপর্য ও প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্র্র ছাড়া পশ্চিমের স্বীকৃতি
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পশ্চিমের স্বীকৃতি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যা ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক মর্যাদা, আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনা বাড়ায়। তবে এর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে : যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি, অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং বাস্তব নিয়ন্ত্রণ সীমিত। এতে সাফল্য নির্ভর করবে : স্বীকৃতি কার্যকর করা, প্রশাসনিক ও নিরাপত্তাগত সংস্কার, আন্তর্জাতিক সমন্বয় এবং বাস্তব পদক্ষেপের বাস্তবায়নের ওপর।
পশ্চিমের স্বীকৃতিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র: বিশ্লেষণ
মোট কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পশ্চিমের স্বীকৃতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য সম্ভব এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তা গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি পূর্ণ রাষ্ট্রগঠনের জন্য পর্যাপ্ত নয়; কার্যকর বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া শুধুই প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে থাকবে এটি। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতি ফিলিস্তিনের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও ক‚টনৈতিক ক্ষমতা বাড়াবে। এর সীমাবদ্ধতা হলো- যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না থাকা, স্থানীয় বিভাজন, নিরাপত্তা সমস্যা, ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া।
পূর্ণ রাষ্ট্রগঠন বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমন্বয়, মানবিক সহায়তা, প্রশাসনিক সংস্কার এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া পশ্চিমা স্বীকৃতি কূটনৈতিক ও নৈতিকভাবে শক্তিশালী, তবে তা অবিলম্বে বাস্তব পরিবর্তন আনবে না। সফল ও টেকসই রাষ্ট্র-নির্মাণের জন্য দরকার সম্মিলিত আন্তর্জাতিক কৌশল, প্রশাসনিক সংস্কার, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, মানবিক সহায়তা ও স্থানীয় রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। তবে যেসব রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে এখন স্বীকৃতি দিলো তারা প্রায় সবাই যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো মিত্র। তাদের স্বীকৃতির পুরোটাই আমেরিকান গভীর ক্ষমতা বলয়ের বাইরে নেয়া বলে মনে হয় না। এ বিষয়টির তাৎপর্যও রয়েছে। আর এই পদক্ষেপ ফিলিস্তিনকে আন্তর্জাতিকভাবে শক্ত মর্যাদা দিচ্ছে, দুই-রাষ্ট্র সমাধানকে পুনরুজ্জীবিত করছে, কিন্তু শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ধীর, বাস্তবমুখী পদক্ষেপ অপরিহার্য। সবার আগে দরকার গাজায় গণহত্যা বন্ধ করা এবং মানবিক সাহায্য প্রবেশ করতে দেয়া।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত