Image description

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সূচনালগ্ন থেকেই এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হওয়া  জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু বইটি তাঁর সেই আন্দোলনকালের স্মৃতিকথা। বইটির কিছু চুম্বক অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য দুই পর্বে প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব

১৯ জুলাই রাতে গুলশান থেকে অন্য এলাকায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বন্ধুকে কর্মসূচিটা দিয়ে আমার ভাতিজা মহিউদ্দিন রিয়াজকে ফোন করলাম। তাঁদের বাসা মিরপুরের কাজীপাড়া মেট্রোস্টেশনের পাশে। নতুন কেনা সিমটা ব্যবহার করে তাকে কল দিয়ে বলি, আমি আসছি। 

রাত সাড়ে ১০টা–১১টার দিকে নিকেতন-হাতিরঝিল এলাকায় হেঁটে হেঁটে আমি সিএনজি খুঁজছিলাম। এলাকাটায় বেশি আলো নেই। কিছুটা আলো-আঁধারি। হঠাৎ কোত্থেকে একটা হাই–এস গাড়ি আমার খুব কাছাকাছি চলে এল। আমি ঘোরারও সুযোগ পেলাম না। তার আগেই সাদাপোশাকে সাত–আটজন লোক হুট করে নেমে এসে মোটা কালো কাপড় দিয়ে আমার পুরো মুখ ঢেকে ফেলল। আমাকে গাড়িতে তুলে নিল। বলল, তারা ডিবি। আমি চিৎকার করতে গেলে তারা আমাকে চুপচাপ থাকতে বলল, নইলে ক্ষতি হবে। আমি বুঝতে পারলাম, এদের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার আর উপায় নেই। গাড়িতে চুপ করে বসে থাকলাম। 

নিজেদের ওরা ডিবি পরিচয় দিলেও তাদের কথা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ৩০ মিনিটের মতো গাড়ি চালিয়ে তারা আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে গেল। আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দিয়ে একটা ভিডিও বার্তা প্রচারের জন্য সেখানে তারা আমাকে অনবরত চাপ দিয়ে গেল। আমি বললাম, এখন তো ইন্টারনেট নেই, কীভাবে ভিডিও বার্তা দেব। তারা বলল, টেলিভিশন থেকে প্রচার করা হবে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো মূলত তাদের নির্দেশ মেনেই চলছিল। 

তারা বলল, ‘তোদের লোকদের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। তুই যদি না দিস, অন্য কারও কাছ থেকে আমরা ঠিকই পেয়ে যাব।’ ঘণ্টাখানেক ধরে তারা আমাকে নানাভাবে রাজি করানোর চেষ্টা করল। বলল, ‘তোদের কারণে এত এত মানুষ মারা যাচ্ছে। ভিডিও বার্তা না দিলে সব হত্যার দায় তোদের নিতে হবে।’ আমার পক্ষে ভিডিও বার্তা দেওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। আন্দোলন স্থগিত করার সীমা ততক্ষণে পার হয়ে গেছে। বারবার নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম, যদি আমার জীবনও চলে যায়, তবু শহীদদের সঙ্গে বেইমানি করব না। 

একপর্যায়ে মুঠোফোনের লক খুলে দেওয়ার জন্য তারা আমার মুখের বাঁধন খুলে দেয়। আমি বললাম, আপনারাই তো এটা খুলতে পারেন। আমি নিচে বসা ছিলাম। একজন এসে আমার পায়ে দুই-তিনটা লাথি মেরে ফোন কেড়ে নেয়। এরপর লক খুলতে না বললেও ভিডিও বার্তা দেওয়ার জন্য তারা আমাকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে। এভাবে প্রায় ঘণ্টা তিনেক চাপাচাপি চলে। 

ভিডিও বার্তা না দিলেও এরপর তারা আমাকে আর মারধর না করে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে। জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা আমাকে বলেন, সারজিস আলম আর হাসনাত আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা হচ্ছে। তাঁরা ভিডিও বার্তা দেবেন। আমিও যদি ঘোষণা দিই, তাহলে কাল থেকে খুনখারাবি বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার কোটা সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার কোটা সংস্কার রিটের শুনানির তারিখ এগিয়ে ২১ জুলাইয়ে নিয়ে এসেছিল। 

২০ জুলাই রাতের তখন প্রথম প্রহর। আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া কর্মকর্তারা বারবার জানতে চাইছিলেন, কার কার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। আমি কিছুই বলিনি। বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা কেমন হতাশ হয়ে পড়লেন। একপর্যায়ে একজন বললেন, একে দিয়ে হবে না। কিছুক্ষণ পরে আরেকজন এসে আমার শরীরে একটা ইনজেকশন দিল। কীসের ইনজেকশন প্রশ্ন করায় সে বলল, ‘ঘুমের ইনজেকশন। কিছু হবে না।’ এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। 

■ মা–বাবার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা চার-পাঁচ দিন ধরে আমাকে খুঁজছিলেন। এমনকি এ–ও ভেবেছিলেন যে আমি শহীদ হয়ে গেছি। ■ জামায়াতে ইসলামী কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কি না, আমার জানা নেই। তবে ছাত্রশিবির সব সময়ই সরকার পতনের আন্দোলনে ছিল। 

আমাকে রাখা হয়েছিল ছোট একটা কক্ষে। একটাই দরজা। কোনো জানালা নেই। শুধু একটা ভেন্টিলেটর আর তিনটি এগজস্ট ফ্যান ছিল। আর ছিল একটা ফ্যান আর একটা লাইট। আমি ভাবছিলাম, এটা কি আয়নাঘর? আয়নাঘর নিয়ে এর আগে অনেক আন্দোলন করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আয়নাঘরের যে বর্ণনা শুনেছিলাম, তার সঙ্গে এর কোনো মিল পাচ্ছিলাম না। অতিরিক্ত এগজস্ট ফ্যান দেখে আয়নাঘর বলেই মনে হচ্ছিল। পরে আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে নিশ্চিত হই, সেটি আয়নাঘরই ছিল। নাহিদ ইসলামকে তুলে নিয়ে যেখানে রাখা হয়েছিল, পরে তাঁর মুখে সেই কক্ষের বর্ণনা শুনে মনে হয়েছে, আয়নাঘরের সঙ্গে সেটির মিল আছে। 

জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারছিলাম না তখন দিন না রাত। ওয়াশরুম থেকে আসার পরে তারা কলা আর রুটি খেতে দিল। কিছুক্ষণ পর একজন এসে বলল, ‘তোকে ছাড়াই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। তুই–ই এটা করতে পারতি।’ কী সমাধান হয়েছে, জিজ্ঞেস করলে সে কোনো উত্তর দিল না। আমার শরীরে আবার ইনজেকশন দেওয়া হলো। বাধা দিয়ে কোনো লাভ নেই বলে আমি কোনো বাধা দেওয়ার চেষ্টা করিনি। 

আবার জ্ঞান ফিরলে তারা বলল, ‘তোমাদের তিনজনের সঙ্গে সরকারের আলোচনা হয়েছে। সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।’ আমি বুঝতে পারছিলাম না, কারা সেই তিনজন। আমার মাথায় ছিল, সারজিস আর হাসনাত যেতে পারেন। তৃতীয়জন কে, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে খাবার দিয়ে আবারও ইনজেকশন দেওয়া হলো। 

২৩ জুলাই রাতে আমাকে মুঠোফোন ফিরিয়ে দেওয়া হলো। যার হাতে আমাকে সোপর্দ করা যাবে, সে রকম কাউকে ওরা কল দিতে বলল। আমার বাবা, নাহিদ ভাই, হাসিব, এ রকম কয়েকজনকে আমি কল দিলাম। কাউকেই পাওয়া গেল না। ইন্টারনেট তখনো বন্ধ। ফোনে কাউকে না পাওয়ায় তারা আমাকে ছাড়ল না। পরদিন ২৪ জুলাই আমাকে যেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, তারা আমাকে সেখানে নিয়ে যায়। নিকেতনের পাশে হাতিরঝিলের যে অংশ, সেখানে একটা ছোট ফটক আছে, যেটা দিয়ে ঢুকলে মহাখালী দক্ষিণ এলাকা পড়ে, তার কাছে তারা আমাকে ফেলে যায়। 

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক।

সেখান থেকে রিকশা নিয়ে আমি সাতরাস্তায় এলাম। ফোনে মোয়াজ্জেম আর হাসিবের সঙ্গে আমার কথা হলো। তারা আমাকে চানখাঁরপুলে যেতে বলল। চানখাঁরপুলে মোয়াজ্জেমের সঙ্গে দেখা হলো। মোয়াজ্জেমের সঙ্গে আমার মা–বাবা। চানখাঁরপুলের মোমিন সুইটসে বসে মা–বাবার সঙ্গে কথা বললাম। মা কান্নাকাটি করছিলেন। মায়ের কান্না কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছিল না। তারা আমাকে বারবার রাজনীতি বাদ দিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে বলল; কিন্তু আমি যখনই ভাবতাম, এবার সব ছেড়ে দেব, তখনই কোনো না কোনো সংকট মাথার মধ্যে এসে জমা হতো। নিজেকে তখন সামাল দেওয়া সম্ভব হতো না। ছুটে যেতাম রাজপথে, মিছিলে-স্লোগানে। 

মা–বাবার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা চার-পাঁচ দিন ধরে আমাকে খুঁজছিলেন। এমনকি এ–ও ভেবেছিলেন যে আমি শহীদ হয়ে গেছি। ঢাকার সব হাসপাতালের মর্গে আমার মরদেহের খোঁজ করেছেন। নিরাপত্তার জন্য বাবা আমাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। আমি রাজি হলাম না। সবাইকে ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। সবাইকে ছেড়ে কীভাবে আমি পালিয়ে যেতে পারি? পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বাকি জীবন আমি কীভাবে চলব?

আমি আর মোয়াজ্জেম মা–বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে বাড়িতে ঝুঁকি আরও বেশি। বাড়িতে যাওয়া আমার ঠিক হবে না। মা–বাবাকে ওখান থেকে পাঠিয়ে দিয়ে নাহিদ ভাইয়ের খবর নিলাম। খবর পেলাম, তিনি ধানমন্ডিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসাপাতালে ভর্তি আছেন। 

ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। দেখলাম, ২৩ জুলাই হাসপাতাল থেকে গিয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) একটা সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম অংশ নিয়েছেন। সেখানে সারজিস আলম আর হাসনাত আবদুল্লাহসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। নাহিদ ভাই সেখানে বলেছেন, কর্মসূচি স্থগিত; কিন্তু আন্দোলন চলমান থাকবে। তিনি ইন্টারনেট খুলে দেওয়া, কারফিউ তুলে নেওয়াসহ চারটি জরুরি দাবির কথা বলেন। 

মোয়াজ্জেমের মুখে শুনলাম, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহর পাশাপাশি হাসিব আল ইসলামও দেখা করেছেন। শুনে খুব কষ্ট হলো। হাসিব প্রথম বর্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিল। তার থেকে এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। পরে তাঁদের কাছে জানতে পেরেছি, তাঁদের চাপ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কথা ছিল, তাঁরা পদ্মায় গিয়ে আট দফা দাবি দিয়ে আসবেন। কোনো আলোচনা হবে না; কিন্তু পদ্মায় নিয়ে তাঁদের ফাঁদে ফেলে বসানো হয়েছে এবং বিষয়টাকে সংলাপ বলে প্রচার করা হয়েছে। তাঁদের ভাষ্যমতে, চাপ প্রয়োগ করে আলোচনায় বসানোর পর তাঁদের বক্তব্যকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হয়েছে। 

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে গিয়ে আমি নাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। সারজিস ও হাসনাতের সঙ্গে কেন তিনি সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তা জানতে চাইলাম। নাহিদ ইসলাম বললেন, নিজেদের মধ্যে এখন ঐক্য দরকার। আমার শরীর তখনো বেশ দুর্বল ছিল। আমার সঙ্গে যা যা হয়েছে, সে ঘটনা তাঁকে বিস্তারিত জানালাম। গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল আমাকে ভর্তি করে নিল। পরীক্ষা করে জানা গেল, আমাকে প্যাথেডিন দেওয়া হয়েছিল।

হাসপাতালে বসেই ইন্টারনেটে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। ৮ দফা আর আবদুল কাদেরের ৯ দফা ইত্যাদি দেখলাম। পরে জানতে পেরেছি, নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে দাবিগুলো নিয়ে কাদেরের আলোচনা হয়েছিল। ১৬ জুলাই থেকে আমাদের মধ্যে যেসব আলোচনা হয়েছে, সেগুলো গুছিয়েই কাদের ৯ দফা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকেই নাহিদ ইসলাম আবার জরুরি চার দফা দাবি পূরণে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন। 

গণস্বাস্থ্য হাসপাতালেই নাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম, শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করাটা ছিল ২৩ জুলাই ডিআরইউতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের প্লট। ডিজিএফআইয়ের কর্নেল সারোয়ারেরাই সেই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে দিয়েছিলেন। তাঁর প্লট ছিল, নাহিদ ইসলাম শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিয়ে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করবেন।

পদ্মায় মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করার পর অন্য নেতারা সারজিস আলম আর হাসনাত আবদুল্লাহর প্রতি অসম্ভব ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের ওপর কোনো আস্থা অবশিষ্ট ছিল না। তাই নাহিদ ইসলামকে দিয়ে গোয়েন্দারা কথাগুলো বলানোর চেষ্টা করেছে। নাহিদ ভাই সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে একেবারে উল্টো কথা বলে আসেন। সংবাদ সম্মেলনের পর গোয়েন্দারা নাহিদ ভাইকে বলেছিলেন, ‘তোমার ওপর থেকে সব নিরাপত্তা তুলে নেওয়া হচ্ছে। তোমার রাস্তা এখন থেকে তোমার।’ 

গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে আরও ভর্তি ছিল আবু বাকের। আমরা ছিলাম হাসপাতালের চারতলার একটা কেবিনে। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী (বর্তমানে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক) কেবিনে এসেছিলেন। নাহিদ ভাই ভর্তি ছিলেন সপ্তম তলায়। তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ছিলেন। আমাকে স্যালাইনের সঙ্গে অ্যান্টি-প্যাথেডিন দেওয়া হয়। হাসপাতালে একত্র হওয়ার পর আমরা প্রথমে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করি। সরকারের বয়ান ছিল, শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিল, বিএনপি-জামায়াত সেখানে ঢুকে আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে নিয়ে গেছে। 

রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা একে একে গ্রেপ্তার হচ্ছিলেন। বলা হচ্ছিল, শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হবে না। আসলে সবাইকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল। শিক্ষার্থী পরিচয় পেলেই মারধর ও গ্রেপ্তার চলছিল। সরকার বলছিল, ডেটা সেন্টার পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে ১৮ জুলাই ইন্টারনেট বন্ধ হতে পারে শোনার পর ফেসবুকে লিখেছিলাম, সবাই ইন্টারনেট স্টেশনগুলো রক্ষা করুন। স্টেশনগুলো ঘেরাও করুন, যাতে সেখানে ঢুকে কেউ ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে। 

২৪ বা ২৫ জুলাইয়ের দিকে ডিজিএফআইয়ের কর্নেল সারোয়ার আমাকে ফোন করে বলেন, আমার পোস্টের কারণেই নাকি মানুষ গিয়ে সেখানে আগুন লাগিয়েছে। তাই এ ঘটনায় আমার নামে মামলা হবে। নাহিদ ভাইয়ের মুঠোফোন না থাকায় তখন তিনি ফেসবুকে ঢুকতে পারছিলেন না। ১৯ জুলাই গভীর রাতে খিলগাঁও থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ফোনটি ফেলে দেন। ফোন না থাকায় ২৫ জুলাই তিনি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটা বড় লেখা পোস্ট করেন। 

২৪ জুলাই গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে আমি যখন নাহিদ ইসলামের কেবিনে যাই, তখন আরিফুল ইসলাম আদীব (তখন প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকার সাংবাদিক এবং বর্তমানে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক) সেখানে এসেছিলেন। বলেছিলেন, একটা কর্মসূচিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। আরিফুল মির্জা ফখরুলদের বলেছিলেন, এই ছেলেমেয়েরা শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনের দিকে যাবে।

মির্জা ফখরুল উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমাদের তো বড় দল। সরকার পতনের বিষয়ে কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত এখনো আমাদের হয়নি।’ শুনে আশাহত হয়েছিলাম এ কারণে যে আমাদের সঙ্গে কেউ নেই। তবে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ফিরে যাওয়ার আগে আরিফুল ইসলাম আমার গুম হওয়ার একটা বর্ণনা ভিডিও আকারে নিয়ে গেলেন। 

ছাত্রদল আর ছাত্রশিবিরের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ চলছিল। ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম বলেছিলেন, তাঁরাও আন্দোলনে আছেন। ছাত্রদলের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে শুরু থেকেই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ঠিক দলীয় নির্দেশনায় নয়, ব্যক্তিগত অবস্থান থেকেই সব ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শের লোক আন্দোলনে ছিল। জামায়াতে ইসলামী কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কি না, আমার জানা নেই। তবে ছাত্রশিবির সব সময়ই সরকার পতনের আন্দোলনে ছিল। (চলবে)

আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া  উপদেষ্টাযুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়