Image description

বিশ্বের অন্যতম ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস (এফএমসিজি) উৎপাদক কোম্পানি প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে ১৯৯৪ সালে। দীর্ঘ তিন দশকের এ ব্যবসায়িক যাত্রায় তারা বাংলাদেশের প্রাণ গ্রুপের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে দেশে কারখানাও স্থাপন করেছে। তবে এবার বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে জিলেট ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। পাশাপাশি বাতিল করা হয়েছে স্থানীয় পরিবেশকের সঙ্গে করা চুক্তি। প্রাণ গ্রুপের কারখানায় চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনও বন্ধ। বৈশ্বিকভাবে ব্যবসা পুনর্গঠন ও কর্মী ছাঁটাই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিটি। তবে এ দেশে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির অভিজ্ঞতাও বহুজাতিক এ কোম্পানির ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশের বাজারে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের বিক্রি করা উল্লেখযোগ্য পণ্যগুলো হচ্ছে জিলেট ব্র্যান্ডের রেজর ও গ্রুমিং পণ্য, ওরাল-বি ব্র্যান্ডের পণ্য, প্যাম্পারস বেবি ডায়াপার, হুইসপার স্যানিটারি ন্যাপকিন, হেড অ্যান্ড শোল্ডার ও প্যান্টিন শ্যাম্পু, ওলে ফেস অ্যান্ড স্কিন কেয়ার পণ্য, এরিয়াল ও টাইড ডিটারজেন্ট, মি. ক্লিন ব্র্যান্ডের ক্লিনার ও ভিক্স ব্র্যান্ডের পণ্য।

বাংলাদেশ থেকে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জিলেট ইন্ডিয়ার সঙ্গে পরিবেশক চুক্তি বাতিলের ঘোষণা আসে। গত ৩১ ডিসেম্বর চুক্তি বাতিলের এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। জিলেট ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি বাতিলের পর বাংলাদেশের স্থানীয় পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়। বাংলাদেশে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের (পিঅ্যান্ডজি) পণ্যের একক পরিবেশক এমজিএইচ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডস লিমিটেড (আইবিএল)। এরই মধ্যে পরিবেশক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশ। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি আইবিএলকে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা আর চুক্তি নবায়ন করবে না। তবে স্থানীয় পরিবেশক প্রতিষ্ঠানটি চাইলে নিজ উদ্যোগে বিদেশ থেকে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করতে পারে।

এ বিষয়ে এমজিএইচ গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কয়েক মাস আগেই প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পরিবেশক চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত আমাদেরকে জানানো হয়েছে।’

এদিকে পরিবেশক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি বাতিলের প্রভাব বাজারে পড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বাজারে কমছে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল পণ্যের মজুদ। যাদের কাছে আগের পণ্য মজুদ ছিল তারা এখনো বিক্রি করতে পারছেন। কিন্তু মজুদ ফুরিয়ে গেলে তারা আর নতুন করে পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানানো হচ্ছে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি সুপারশপ ও বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে দেখা যায় যে তাদের কাছে মজুদ থাকা প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের পণ্যও শেষের পথে। রেজর ও স্যানিটারি প্যাডের মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে আর পণ্যের সরবরাহ আসছে না।

ভারতসহ অন্যান্য দেশে উৎপাদিত পণ্য আমদানি করে বাজারজাত করার পাশাপাশি ২০২১ সালে বাংলাদেশে যৌথ বিনিয়োগে কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের পণ্য উৎপাদন শুরু করে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশ। হবিগঞ্জের অলিপুরে প্রাণ গ্রুপের শিল্প পার্কে এ কারখানা স্থাপন করা হয়। প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান অ্যাডভান্সড পারসোনাল কেয়ার লিমিটেডের (এপিসিএল) সঙ্গে এজন্য যৌথভাবে পণ্য উৎপাদনের চুক্তি করে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশ। এখানে কোম্পানিটির জিলেট ব্র্যান্ডের রেজর উৎপাদন হয়। চুক্তি অনুসারে এ কারখানায় বাংলাদেশের বাজারে বিক্রির জন্য রেজর উৎপাদনের কথা। প্রাণ গ্রুপ ও প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল যৌথভাবে এ কারখানায় ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারখানাটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু কারখানা স্থাপনের চার বছর পরই বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার এ সিদ্ধান্ত এল। এরই মধ্যে প্রাণ গ্রুপকে তাদের কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশ। নতুন করে উৎপাদন শুরুর বিষয়েও এখনো কিছু জানায়নি বহুজাতিক কোম্পানিটি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রাণ গ্রুপ প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের (পিঅ্যান্ডজি) কন্ট্রাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিং করত। চুক্তির আওতায় প্রতিষ্ঠানটির পণ্য প্রাণ উৎপাদন করে দিত। জানুয়ারি থেকে সেই উৎপাদন প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটির পণ্য উৎপাদনের জন্য আমাদের স্থাপিত কারখানা ও কারখানার যন্ত্রপাতি একই অবস্থায় আছে। পিঅ্যান্ডজি যখন আবার অনুমতি দেবে আমরা উৎপাদন শুরু করব।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় বাড়বে বলে প্রক্ষেপণ করেছে। এ অবস্থায় ব্যয় কমাতে দুই বছরের মধ্যে সাত হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বহুজাতিক এ প্রতিষ্ঠান। চলতি বছরের জুনে কোম্পানিটি ব্যয় সংকোচনের এ নীতি ঘোষণা করে। এর এক মাস পরই জুলাইতে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা আসে। যদিও এর প্রস্তুতি চলছিল আরো আগে থেকেই।

চলতি বছরের ২৯ জুলাই কোম্পানিটির আর্থিক ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (আর্নিংস কল) প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) আন্দ্রে শুলটেন বিনিয়োগকারীদের কাছে ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে ব্যবসা কার্যক্রম বন্ধ করতে যাচ্ছি। এসব পোর্টফোলিও পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা সরবরাহ শৃঙ্খলে বিনিয়োগ, উৎপাদনের সঠিক আকার নির্ধারণ ও সঠিক স্থানে স্থানান্তর, দক্ষতা বৃদ্ধি, দ্রুত উদ্ভাবন, খরচ হ্রাস এবং আরো নির্ভরযোগ্য ও স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারব।’

সম্প্রতি প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল আরো বেশ কয়েকটি দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। সর্বশেষ এ মাসের শুরুতে পাকিস্তান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয় প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল। পাকিস্তানে ১৯৯১ সাল থেকে ব্যবসা করে আসছিল বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি। পাকিস্তানের বাজার থেকে সরে আসার অংশ হিসেবে গত বছর প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল তাদের সাবান উৎপাদন কারখানা পাকিস্তানের নিমির ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যালের কাছে বিক্রি করে দেয়। পাকিস্তান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিলেও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে কোম্পানিটি। পাশাপাশি সেখানকার কর্মীদের অন্যান্য দেশে পদায়ন কিংবা ক্ষতিপূরণ প্যাকেজের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে। এর আগে গত বছর আর্জেন্টিনার এবং ২০২৩ সালে নাইজেরিয়ার ব্যবসায়িক কার্যক্রম গুটিয়ে নেয় প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল।

বাংলাদেশে ব্যবসা করা বিদেশী কোম্পানিগুলোর সংগঠন হিসেবে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে কাজ করে দ্য ফরেন ইনভেস্টরস’ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)। সম্প্রতি প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল আবেদন করে সংগঠনটি থেকে নিজেদের সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফিকির প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী হক চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন যে কোম্পানিগুলো এখান থেকে অনেক মুনাফা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন। আমরা একটি ডিস্ট্রেসড (দুর্দশাগ্রস্ত) বাজার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কভিডের পর থেকে আমরা সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের অবস্থান বেশ নড়বড়ে। কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি না থাকার পাশাপাশি বিদেশী কোম্পানিগুলোকে অসম প্রতিযোগিতার মধ্যেও পড়তে হচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের এখানে কাঠামোগত সমস্যা এবং প্রশাসনিক জটিলতাও বিদ্যমান। প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বাংলাদেশ থেকে কেন ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে সেটি তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে হয়তো তারা এখান থেকে প্রত্যাশিত রিটার্ন পাচ্ছে না, তাই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে হয়।’

২০২৪ এর জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল বৈশ্বিকভাবে ৮৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে। এর মধ্যে উত্তর আমেরিকায় ৫২ শতাংশ, ইউরোপে ২২, দক্ষিণ আমেরিকায় ৭, চীনে ৭, এশিয়া প্যাসিফিকে ৭ এবং ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ৫ শতাংশ পণ্য বিক্রি হয়েছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই)। আশির দশকের পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে বড় অবদান রেখেছে এফডিআই। বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে এফডিআই। যদিও বাংলাদেশ বরাবরই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এফডিআই আকর্ষণে পিছিয়ে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে দেশে এফডিআই স্টকের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। এর পরের দুই বছরে স্টকের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এর মধ্যে ২০২২ সালে ১৭ দশমিক ৮৭ ও ২০২৩ সালে এফডিআই স্টক ছিল ১৭ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ ২০২৪ সালে এফডিআই স্টক কিছুটা বেড়ে ১৮ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এফডিআই বৃদ্ধিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে একটি বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার বিষয়টি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নেতিবাচক বার্তা দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।