সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
সভ্যতার এক কুৎসিত উপহার দারিদ্র
20 Apr, 2013
অত প্রাচীন যুগে কি দারিদ্র ছিল? মনে হয় না...কারন তখন তো “পাইভেট প্রোপার্টি” এর ধারনাই ছিল না। মানুষ নিজে কিছু উতপাদন করত না, অবারিত প্রকৃতি তার অফুরন্ত ডালা নিয়ে হাজির ছিল, সব কিছুতেই সবার ছিল সমান অধিকার। শুধু সংগ্রহ করে নিতে পারলেই হলো, তাই হয়ত সবাই ছিল সমান।
সেই অবস্থা থেকে মানুষ ধীরে ধীরে সভ্য হয়ে উঠল। যখন দেখল খাবারের জন্য ঘুরে না বেরিয়ে কিছু জায়গা দখল করে স্থির হয়ে ফসল উতপাদন করলেই হয়, একটু নদীর ধারে হলে তো কথাই নেই। পানি নিশ্চিত, মাছ বোনাস। শুরু হলো লোহা-তামার-আগুনের ব্যবহার। উপকরন বাড়ল, জীবনের মান বাড়তে থাকল, মানুষ সভ্য হতে থাকল। লোভও নিশ্চয় তখন থেকেই শুরু। আরেকটু বেশি হলে আমি আরো ভাল খেতে পারব, আমার সন্তান দের জন্য আরো বেশি সম্পদ রেখে যেতে পারব! সম্পদ বাড়াতে হবে, যতটা দখল করে নেয়া যায়। অন্যকে তার দখল কৃত সম্পদ থেকে বিতাড়িত করতে পারলেই হয়, আমার সম্পদ আরো বেড়ে গেল, সহজেই! দল বাধা হলো, যুদ্ধ শুরু হলো।একদল মানুষের সম্পদ বাড়াতে লাগলো, প্রয়োজনে আরেক জনেরটা কেড়ে, আরেকজন কে মেরে। তার মানেই অন্যের সম্পদ কমতে থাকলো। আর দারিদ্রের শুরুও নিশ্চিয় তখনি। যে জাতি-গোত্র বা ব্যক্তি সম্পদ যোগাড় করতে পারল তারা বড়লোক হলো, আর যারা সম্পদ যোগাড় করতে পারল না তারা গরীব হতে থাকল।
অর্থনীতির জনক এডাম স্মিথ দারিদ্র সম্মন্ধে বলেছেন “poverty is a lack of those necessities that the custom of the country renders it indecent for creditable people, even of the lowest order, to be without”.
যার সহজ অর্থ হলো একটা সমাজে ন্যুনতম সম্মানজনক ভাবে চলার মত প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাব থাকলে তাকে দরিদ্য বলা হবে।
ইঊরোপের শিল্প বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব আর আমেরিকার স্বাধীনতা ঘটনা গুলো মানুষের জীবন ও চিন্তায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে লাগল। সমাজবিজ্ঞানীরা এই সময় থেকে আধুনিক যুগ শুরু হিসাবে বিবেচনা করেন। এরপর থেকে উতপাদন শুধু বেড়েই চলেছে। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ম্যালথাস থিওরি দিয়েছিলেন জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমানো না গেলে জাতিসমুহ দারিদ্রের ফাদে আটকা পড়বে। শুধু মাত্র কোন রকম খেয়ে বেচে থাকবার চেয়ে বেশি উন্নতি করতে পারবে না। কিন্তু শিল্প বিপ্লব আর খাদ্য উতপাদন বৃদ্ধিতে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সেরকম কোন বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে নি।
উতপাদনের আধুনিকায়নের ফলে পুরো পৃথিবীর উতপাদন কতগুন বেড়েছে? মাথাপিছু আয় কত গুন বেড়েছে? চোখ ধাধানো দালান-কোঠা, বড় বড় শহর, রাতের অন্ধকারকে পরাজিত করা আলোকজ্জ্বল শহরের রাস্তা কিম্বা নাচে-গানে-পানে মুখর নাইট ক্লাব, বিশ্বকাপ ফুটবল-ক্রিকেট বা অলিম্পিক ইভেন্ট দেখে আমরা গর্ব বোধ করি, উন্নতির চরম শিখরে পৌছে গেছি ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করি। সমাজ বিজ্ঞানীরা এই যুগকে আধুনিকোত্তর যুগ (post-modern)যুগ বলে অভিহিত করছেন।
যখন এক পার্টিতে খাবার অপচয় হয়, আরেক দিকে না খেয়ে ঘুমাতে যায় বিলিওন মানুষ! সভ্যতার চাকচিক্যের আড়ালে থেকে যায় বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হতদরিদ্র মানুষ গুলি। রাস্তায় বিএমডাব্লিও হাঁকিয়ে যাবার সময় ফুটপাথে অর্ধ ঊলংগ মানুষটি যখন পেটের দায়ে হাত পাতে তখন আমাদের মনে মমতা জন্মে না, জন্মে বিরক্তি!
এই সভ্যতা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে ভোগ করবার অসংখ্য উপাদান, আমাদের নামিয়ে দিয়েছে ভোগ প্রতিযোগিতায়। আমি শুধু নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে ক্ষান্ত হচ্ছি না বরং বিভিন্ন ভাবে বিলাসিতা করছি, সম্পদের অপচয় করছি আর আরেক দিকে অসংখ্য মানুষ ন্যুনতম পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু ইঊরোপে সিগারেটের খরচ বছরে ৫০ বিলিওন ডলার আর ৪০ বিলিওন ডলার হলে আমরা পৃথিবীর তাবদ গরীব মানুষের প্রাথমিক শিক্ষা, বেসিক চিকিতসা এবং সকল নারীর প্রজনন স্বাস্থ সেবা নিশিত করা যায়, কিন্তু সেই টাকা জোটে না।
আমরা যারা সভ্য মানুষ আজ তাদের ভাবতে হবে এই দারিদ্র কে জিইয়ে রেখে আমরা আসলে কি নিজদের সভ্য বলতে পারি?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন