সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
ভাংচুরের আন্দোলন কি ইসলামী আদর্শের সাথে যায়?
02 Feb, 2013
জামাত-এর নেতারা মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য জেলে দিন কাটাচ্ছেন। এবং বিচারের নামে যা হচ্ছে তা কতটা বিচার আর কতটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সেটা নিয়েও যথেষ্ট যুক্তিসংগত প্রশ্ন উঠেছে। শিবিরের অসংখ্য নেতা কর্মী জেলে এবং তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমন অবস্থায় জামাত-শিবির গণতান্ত্রিক দল/শক্তি হিসাবে রাস্তায় নামবে, তাদের দাবীর পক্ষে জনমত গড়ে তুলবে, সরকারের উপর চাপ তৈরী করবে সেটা খুবই প্রত্যাশিত। আর বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার নিষ্ঠুর দমন নীতি চালিয়ে তা বন্ধ করার চেষ্টা করবে সেটাও স্বাভাবিক। এই সরকার প্রধান বিরোধী দল কে মাঠে নামতে দেয় না, সংসদে কথা বলতে দেয় না সেখানে জামাত তো তাদের বিশেষ টার্গেট। সরকারের কাছে বিএনপি যদি মাছ-ভাত হয় তাহলে জামাত তো কাচ্চি বিরিয়ানী। ফ্যাসীবাদী বাতিল শক্তির কাছে শক্তি ইসলাম নির্মুল সর্বকালের সেরা এজেন্ডা। নমরুদ-ফেরাউন-আবু জেহেল সবাই তাই করেছে। আর জামাত তো শুধু ইসালামী শক্তিই নয়, সাথে কিং মেকারের ভুমিকা রাখার মত ক্ষমতা সম্পন্ন রাজনৈতিক দল। কাজেই সরকারের দমন-নীপিড়ন যে চুড়ান্ত পর্যায়ে হবে তাতে সন্দেহ নাই।
সুতরাং জামাত-শিবির আন্দোলন করবে আর সরকার দমন নীতির মাধ্যমে তা নস্যাত করার চেষ্টা করবে দুটিই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। কিন্তু জামাত-শিবিরের আন্দোলনে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি নষ্ট হবে যা ইসলামের পরিভাষায় “বান্দার হক” নষ্ট করবার সামিল সেটা কিছুটা অপ্রত্যশিত মনে হয়েছে আমার কাছে। একটা বাসে সাধারন জনগন গন্তব্যে যাবার জন্য বসে আছে তারা কিন্তু জামাত-শিবিরের প্রতিপক্ষ নয়। তারা যখন দেখবে একদল মানুষ ইসলামের শ্লোগান দিয়ে লাঠি হাতে সে গাড়ি ভাংতে আসছে, ভয়ে আর আতঙ্কে তাদের মানসপটে ইসলামের এক কদর্যরুপের ছবি অংকিত হবে। একটি আদর্শিক দল হিসাবে জামাত-শিবিরের আন্দোলন অন্য যে কোন রাজনৈতিক দল থেকে ভিন্ন হতে হবে। না হলে মানুষ কি করে বুঝবে এরা আদর্শিক দল? কোথায় খুজে পাবে ইসলামের সৌন্দর্য্য?
জামাত-শিবিরের আন্দোলনে রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর-অগ্নি সংযোগ হচ্ছে। হয়ত শান্তিপুর্ণ কর্মসুচীতে বাধা পেয়ে তারা তা করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে এই সম্ভবনাও ঊড়িয়ে দেয়া যায় না যে হয়ত তারা সিদ্ধান্ত নিয়েই ভাংচুরে যাচ্ছে, হয়ত এই বিবেচনায় যে ভাংচুর-অগ্নি সংযোগের মত কঠোর আন্দোলন না হলে বাংলাদেশ দাবী আদায় হয় না। এই কথাটা ন্যাক্কারজনক ভাবে জামাত নিজেই প্রমাণ করছে যখন তাদের ডাকা হরতালে আমেরিকান দুতাবাসের গাড়ি ভাংচুর কিম্বা অগ্নি-সংযোগের শিকার হয় এবং তারা স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করে এবং ক্ষতি পুরন দিতে চায়। বিগত কয়েকটা ঘটনায় দেখা গেছে জামাত-শিবিরের মিছিলে পুলিশের হামলা আর সাথে গাড়ি ভাংচুর। জামাত-শিবির হয়ত দাবী করতে পারে যে সাদা পোষাকে পুলিশ কিম্বা অনুপ্রবেশকারী বহিরাগত সন্ত্রাসী (সরকার বা সরকারী দল যদি তাদের ঢুকিয়ে থাকে) এই কাজ করতে পারে, কিন্তু সাধারন জনগনের মনে এইসমস্ত কাজ জামাত-শিবিরের আন্দোলন হিসাবেই জায়গা পাবে।
ইসলামী আদর্শ নিয়ে আন্দোলন কারীদের সফলতার মাপকাঠি কি? আওয়ামী লীগের সাথে আন্দোলন করে তত্বাবধায়কের দাবী প্রতিষ্ঠিত করে সংসদের তিনটি আসন লাভ করা? নাকি বিএনপির সাথে জোট বেধে প্রায় এক কুড়ি আসন ও আধা হালি মন্ত্রী নিয়ে খুশীতে মুখে কলুপ এটে হাওয়া ভবনের সব দুর্ণীতিকে নীরবে সমর্থন দেয়া? আজকে যদি জামাতের দশ জন নেতার ফাসি হয় সেটা কি জামাতের সাফল্য না ব্যর্থতা? ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে অনেক নবীকে হত্যা করা হয়েছে, তারা কি ব্যর্থ হয়েছেন? আমরা শুনতাম এবং বিশ্বাস করতাম যারা ইসলামী আন্দোলন করেন তাদের লক্ষ্য হচ্ছে পরকাল, সারা জীবন আন্দোলন করে ক্ষমতায় না গেলেও সেটা ব্যর্থতা নয়, ব্যর্থতা হচ্ছে পরকালে জান্নাতে যেতে না পারা। তাহলে আজকে রাস্তায় মানুষের গাড়ি ভাংচুর করে মানুষের অধিকার নষ্টের মত বেসিক ইসলামী মুল্যবোধের বিপরীত কাজ করে জামাত-শিবির কি অর্জন করতে চায়---বেহেশতের টিকেট নাকি ক্ষমতার স্বাদ? আওয়ামী লীগ যেমন লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ মেরে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী আন্দোলন করে ক্ষমতায় যেতে পেরেছে সেটিই কি এখন জামাত-শিবিরের আদর্শ? নাকি রাসুল (সাঃ)তায়েফের ঘটনা হবে জামাতের আদর্শ, যখন তায়েফের লোকজন রাসুল (সাঃ) কে নির্যাতন করেছিল, ফেরেশতা এসে উনাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে দুই পাশের পাহাড় দিয়ে চেপে তায়েফবাসীকে ধ্বংস করে দিতে, কিন্তু উনি তাতে রাজী হন নি।
জামাত-শিবিরের কি করা উচিত তা বলার আমি কেউ না। তাদের উপর যে অত্যাচার হচ্ছে তার জন্য তারা অবশ্যই প্রতিবাদ করবে, তারা হয়ত আরো শক্ত প্রতিবাদ ও সর্বোচ্চ ত্যাগ করবার মত সাংগঠনিক শক্তি রাখে। কিন্তু আমার ধারণা ছিল তাদের প্রতিটা পদক্ষেপেই ইসলামিই আদর্শের অনুসরন থাকবে। কেউ বলবেন তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, আমি বলব কঠিন সময়েই কিন্তু সবরের আসল মুল্য বুঝা যায়। আজকে যদি দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার অজুহাতে ভাংচুর জায়েজ হয় তবে জামাত ক্ষমতায় গেলে আজকের ছাত্রলীগের রুপ তাদের মাঝে দেখলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামিলীগ–বিএনপি এভাবে আন্দোলন করে বলে আমরাও তাই করব, এটাই যদি হয় জামাত-শিবিরের কৌশল তবে দয়া করে জামাত থেকে ইসলাম শব্দটা বাদ দিয়ে তারপর তা করুন।
জামাত গণতান্ত্রিক দল হিসাবেই নিজদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। সুতরাং তাদের কর্মসুচিতে জনগণের প্রতিক্রিয়া কি হচ্ছে সেটাও হিসাবের মধ্যে আনতে হবে।যখন একজন জামাত পিকেটারের বুকে পুলিশের পা দেয়া ছবি আসে তখন তাদের প্রতি যে জন-সমর্থন বাড়ে সেটা উবে যায় যখন তারা আওয়ামী লীগ স্টাইলে ভাংচুর করে আন্দোলন সফল করতে চায়।
“থিংকিং আউট অফ দ্যা বক্স” কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে খুব চালু একটি শব্দ। আমার মনে হয় জামাত-শিবিরকেও আন্দোলন-প্রতিবাদের জন্য “আউট অফ দ্যা বক্স” চিন্তা –কর্মসুচী নিয়ে আসতে হবে। যেন কঠিন সময়ে তাদের মহত্ব, ধৈর্য ও ত্যাগ দেখে সাধারন মানুষ ইসলামের সৌন্দর্য্য খুজে পায়। আর তা না পারলে হয়ত বিএনপি-আওয়ামিই লীগের লেজুড় হয়ে সন্তোষ্ট থাকতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন