
কাউকে বিরক্ত না করে একা একা গান বা পডকাস্ট শোনার জন্য হেডফোন বা ইয়ারবাড ব্যবহার করেন অনেকেই। তবে মাঝে মাঝে এগুলো পরতে অস্বস্তি হতে পারে। সেই সঙ্গে এমন পরিস্থিতিও থাকতে পারে, যেখানে আপনি চান না তৃতীয় কোনো পক্ষ আপনার কথোপকথন শুনুক। এখন নতুন এক গবেষণায় এমন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা শব্দকে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ, প্রযুক্তিটি এমন একটি শব্দ তৈরি করতে পারে, যা শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় শোনা যাবে এবং আশপাশে কেউ শুনতে পাবে না। এর জন্য প্রয়োজনে শব্দের গতিপথও পরিবর্তন করা সম্ভব।
এই প্রযুক্তি বিনোদন, যোগাযোগ ও স্প্যাশিয়াল অডিও অভিজ্ঞতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শব্দ কী
শব্দ হলো একটি কম্পন যা বায়ু বা অন্য কোনো মাধ্যম দিয়ে তরঙ্গ আকারে স্থানান্তরিত হয়। বায়ু বা অন্য কোনো মাধ্যমের অণুগুলো সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে শব্দ তরঙ্গ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এই গতিপথটি সরলরৈখিক।
শব্দ কম্পনের তরঙ্গই পিচ নির্ধারণ করে। নিম্ন কম্পাঙ্কের শব্দ, যেমন: বেস ড্রাম, গভীর শোনা যায়। আর উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ, যেমন: শিস বা বাঁশি তীক্ষ্ণ শোনায়।
শব্দকে শুধু একটি নির্দিষ্ট জায়গায় শ্রবণযোগ্য করে তোলাটা কঠিন। কারণ শব্দতরঙ্গ উৎপত্তিস্থল থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনাকে ডিফ্যাকশন বলে। এই প্রভাবটি সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য হয় নিম্ন কম্পাঙ্কের শব্দের ক্ষেত্রে। কারণ এ ধরনের শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড় হয়। এর ফলে, শব্দকে নির্দিষ্ট অঞ্চলে আটকে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সামান্য কিছু অডিও প্রযুক্তি, যেমন: প্যারামেট্রিক অ্যারে লাউডস্পিকার নির্দিষ্ট দিকে লক্ষ্য করে শব্দ তরঙ্গ পাঠাতে পারে। তবে, এই প্রযুক্তিগুলো এমন শব্দ তৈরি করে যা তরঙ্গের পুরো গতিপথে শোনা যায়।
২০ হার্টজের কম বা ২০ কিলোহার্টজের বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ মানুষ শুনতে পারে না। ২০ হার্টজের কম কম্পাঙ্কের শব্দকে বলে শ্রবণেতর শব্দ, আর ২০ কিলোহার্টজের বেশি কম্পাঙ্কের শব্দকে বলি শ্রবণোত্তর শব্দ।
নতুন প্রযুক্তি এবং ‘অডিও এনক্লেভস’
গবেষকেরা এমন একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছেন, যা শব্দকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যেন তা নির্দিষ্ট স্থানেই শুধু বাজে। উৎপত্তিস্থল থেকে গতিপথে এই শব্দ থাকে একেবারে নীরব। এটি সম্ভব হয়েছে ‘সেল্ফ-বেন্ডিং আলট্রাসাউন্ড বিমস’ এবং ‘ননলিনিয়ার অ্যাকুস্টিকস’ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে।
আলট্রাসাউন্ড হলো—সেই ধরনের শব্দ তরঙ্গ যেগুলো মানুষের শ্রবণ পরিসরের ওপরে (২০ কিলোহার্টজের বেশি) হয়। এই শব্দ তরঙ্গগুলো বায়ুর মধ্য দিয়ে চলতে পারে, তবে মানুষ সেগুলো শুনতে পারে না। এই আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গ অনেক বস্তুকে ভেদ করতে পারে এবং বস্তুর সঙ্গে অনন্য উপায়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। তাই এটি মেডিকেল ইমেজিং এবং বহু শিল্প ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
এই আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানে শব্দকে পৌঁছাতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এই কৌশলে শব্দকে নীরবে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যায় এবং প্রয়োজন মতো শ্রবণযোগ্য করে তোলা যায়।
সাধারণত, একাধিক শব্দ তরঙ্গ সরল রৈখিকভাবে মিলিত হতে পারে, তখন বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের একক তরঙ্গে পরিণত হয়। এটিকে বলে সুপারপজিশন বা উপরিপাতন। তবে, যখন শব্দ তরঙ্গগুলো যথেষ্ট তীব্র হয়, অর্থাৎ এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হয় এবং কম্পাঙ্ক বেশি হয়, তখন এরা ‘অরৈখিক’ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। এর ফলে নতুন কম্পাঙ্কের শব্দতরঙ্গ তৈরি হয়।
এই কাজটি করতে গবেষকেরা দুটি আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গ ব্যবহার করেছেন, যেগুলোর কম্পাঙ্ক আলাদা এবং মানুষ শুনতে পারে না। কিন্তু যখন এই দুটি তরঙ্গ বায়ুতে পরস্পরকে ছেদ করে, তখন অরৈখিক প্রভাবের কারণে এরা একটি নতুন শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে, যা শ্রবণযোগ্য কম্পাঙ্কে পরিণত হয় এবং শুধু ছেদ বিন্দুর ওই স্থানেই শোনা যায়। গবেষণায় এমন আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গ ডিজাইন করা হয় যা নিজে থেকেই বেঁকে যেতে পারে।
সাধারণভাবে, যতক্ষণ না কিছু বাধাগ্রস্ত বা প্রতিফলিত করে ততক্ষণ শব্দ তরঙ্গ সরল পথে চলে। তবে, ‘অ্যাকুস্টিক মেটাসারফেস’ (বিশেষ ধরনের উপকরণ যা শব্দ তরঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করে) ব্যবহার করে আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গগুলোকে এমনভাবে আকৃতি দেওয়া হয়, যাতে সেগুলো চলার পথে বেঁকে যায়।
যেমন: একটি অপটিক্যাল লেন্স আলোকে বাঁকিয়ে দেয়, যাকে আলোর প্রতিসরণ বলে, ঠিক তেমনি ‘অ্যাকুস্টিক মেটাসারফেস’ শব্দ তরঙ্গের পথ পরিবর্তন করে। আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গগুলোর ফেজ (ধ্বনি তরঙ্গের দশা) সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এমনভাবে গতিপথ বাঁকিয়ে দেওয়া হয় যে, উৎস ও শ্রোতার মধ্যবর্তী বাধা পেরিয়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে পারে।
এর পেছনে মূল ঘটনা হলো—ডিফারেন্স ফ্রিকোয়েন্সি জেনারেশন। যখন দুটি আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গ, যেমন: ৪০ কিলোহার্টজ এবং ৩৯ দশমিক ৫ কিলোহার্টজ, একে অপরকে ছেদ করে, তখন এরা তাদের কম্পাঙ্কের মধ্যে পার্থক্যের সমান কম্পাঙ্কের একটি নতুন শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে। এই শব্দতরঙ্গ দশমিক ৫ কিলোহার্টজ বা ৫০০ হার্টজ, যা মানুষের শ্রবণ পরিসরের মধ্যে পড়ে। তবে শব্দটি শুধু সেই জায়গায় শোনা যায় যেখানে দুটি তরঙ্গ একে অপরকে ছেদ করে। সেই ছেদ অঞ্চলের বাইরে, আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গগুলো মানুষের শ্রবণযোগ্য থাকে না।
অর্থাৎ এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বা ব্যক্তির কাছে অডিও পাঠানো যাবে। মধ্যবর্তী স্থানের কেউ শুনতে পাবে না। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যেও দুজন ব্যক্তি একান্তে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারবেন।
অডিও এনক্লেভস তৈরি করার সক্ষমতা অনেক সম্ভাবনাময় প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, জাদুঘরগুলো দর্শকদের জন্য আলাদা অডিও গাইড সরবরাহ করতে পারবে, আবার পাঠাগারে অন্যদের বিরক্ত না করে অডিও বুক শোনা যাবে।
এ ছাড়া গাড়িতে লাউডস্পিকার বাজিয়ে গান শোনার দরকার হবে না। ফলে সঠিকভাবে নির্দেশনা শুনতে চালককে সমস্যায় পড়তে হবে না। অফিস এবং সামরিক ক্ষেত্রে গোপন কথোপকথনের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা তৈরি করা যাবে।
এ ছাড়া, অডিও এনক্লেভস এমনভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে, যা নির্দিষ্ট অঞ্চলে শব্দদূষণ দূর করবে এবং কর্মক্ষেত্রে বা শহরের নির্দিষ্ট অঞ্চলে শান্ত পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে কর্মী বা নাগরিকেরা আরও মনোনিবেশ করে কাজ করতে পারবে।
তবে এই প্রযুক্তি খুব শিগগিরই জনসাধারণের জন্য ব্যবহারের উপযোগী হবে না। ননলিনিয়ার ডিস্টরশন শব্দের গুণগত মানকে প্রভাবিত করতে পারে। এ ছাড়া খরচও একটি বড় সমস্যা। কারণ আলট্রাসাউন্ডকে শ্রবণযোগ্য শব্দে রূপান্তর করতে উচ্চক্ষমতার ডিভাইস লাগবে, এতে প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হতে পারে।
এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাকুস্টিক বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক জিয়াক্সিন ঝং পেন এবং অ্যাকুস্টিক বিভাগের অধ্যাপক ইউন ঝিং।
তথ্যসূত্র: জাপান টুডে