
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ইস্যুতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। গত রবিবার দুই দল কমিশনের কাছে তাদের মতামত জমা দেওয়ার পর বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবনার বেশ কয়েকটি বিষয়ে বিএনপি দ্বিমত পোষণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না, এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবনা। পরিবর্তে দলটি বলছে, কারও প্রধানমন্ত্রিত্ব পরপর তিন মেয়াদ না হওয়ার পক্ষে তারা। অর্থাৎ টানা দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্বের পক্ষে তারা। জবাবদিহির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও কমিশনের নিয়োগে একটি স্বাধীন সাংবিধানিক পরিষদ গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে তারা। নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করছে বিএনপি। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবও দলটি প্রত্যাখ্যান করেছে। সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে জাতীয় গণভোটের ধারণাও সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে দলটি। সমতা, মানব মর্যাদা, ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো মৌলিক আদর্শ এবং বহুত্ববাদকে বিএনপি এড়িয়ে গেছে। নির্বাচন এলাকার সীমানা নির্ধারণে স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রস্তাবও দলটি প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ছাড়া সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে নির্বাচন কমিশনের জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছে তারা। সেই সঙ্গে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল এনসিসির বিরোধিতা করেছে বিএনপি। তাদের যুক্তি, এটা হলে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা কিছুটা খর্ব হবে। সংবিধান সংস্কারে গণপরিষদ গঠন করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে মনে করে বিএনপি।
বিএনপির পক্ষে প্রস্তাবনা জমা দিয়ে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মৌলিক অধিকার বা মূলনীতির ক্ষেত্রে আমরা প্রস্তাব করেছি যে সংবিধানের যেসব ধারা রয়েছে তার মধ্যে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে হয়তো মূলনীতির ক্ষেত্রে সংশোধনী আনা যায়। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে পূর্বের অবস্থা বহাল রাখার জন্য বলেছি। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থানকে এককাতারে আনা হয়েছে। এটা সমীচীন নয়। সংবিধানের আগের প্রস্তাবনাই থাকা উচিত। ‘২৪ এর গণ অভ্যুত্থানকে সংবিধানের অন্য জায়গায় বা তফসিল অংশে রাখা যেতে পারে। সেটা আলোচনা করে করা যাবে।’ সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা কমানোর কথা বলা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। এদিকে নিজেদের প্রস্তাবনা জমা দিয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার বলেন, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা একই ব্যক্তি হতে পারেন। তবে মন্ত্রিসভার মধ্যে প্রথমজন হলে এ ক্ষেত্রে বাধা থাকবে না। অর্থ বিল ছাড়া দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে মতামত দেওয়া যাবে। পাশাপাশি দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটও যুক্ত করা যেতে পারে। এনসিসি নিয়ে বিএনপির দ্বিমত থাকলেও এনসিপি বিষয়টির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি, ইসি ও এনসিসি থাকলে আলাদা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার দরকার নেই। দায়িত্ব নিতে পারে এনসিসি। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত এনসিসি থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তদন্ত করতে পারবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। এনসিপি বলছে, যেসব সুপারিশ সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ সরকারই করতে পারবে। যেগুলো সংবিধান সম্পর্কিত সেগুলো গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে হবে। আসন্ন নির্বাচনটি গণপরিষদের মধ্য দিয়ে হওয়া দরকার, এটা এনসিপির আগেরই অবস্থান। এ সংবিধানকে বাতিল করা দরকার আমরা আগেই বলেছি। আগে জাতীয় ঐকমত্য হতে হবে এসব বিষয়ে। বর্তমান সংবিধান ‘সরকার পরিচালনায় প্রাধান্য পাচ্ছে না’ মন্তব্য করে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান পুনর্লিখনের কথাও বলেন তুষার। প্রসঙ্গত ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টি প্রস্তাবের বিষয়ে পুরোপুরি একমত হতে পেরেছে এনসিপি। ২৯টি প্রস্তাবে আংশিক একমত হয়েছে, আর ২২টি প্রস্তাবের বিষয়ে একমত হতে পারেনি দলটি।