
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায়) হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। গত শনিবার আগারগাঁও আইসিটি টাওয়ারে তিনি দেশের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাহিতুল ইসলাম।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলেন। আপনার প্রথম কাজ কী হবে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: আমি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির (আইসিটি) কাজ শুরু করেছি নভেম্বর মাসে। তখন থেকে আইসিটির যে প্রকল্পগুলো (২১টি প্রকল্প ছিল), আমরা শুরুতে কিছু তদন্ত কমিটি করেছি এবং যেগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, সেগুলো বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ২০০০ থেকে ২১০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনেক জালিয়াতি ছিল। অনেকগুলো প্রকল্প ছিল দলীয় পরামর্শকদের ডাম্পিং স্টেশন। সেখান থেকে আমরা কিছু আলাদা উদ্যোগ নিয়েছি। কিছু পরামর্শককে বাদ দিয়েছি। পাশাপাশি প্রতিটি প্রকল্পের পিডি ও ডিপিডির পারফরম্যান্সকে রিভিউ করে সেখানেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
প্রতিটি দপ্তর সংস্থাকে ‘স্পেসিফিক টাস্ক (সুনির্দিষ্ট কাজ)’ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে আমি মনে করছি, আইসিটি একটা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে আসছে। একই সঙ্গে আমরা আইসিটির যে মাস্টারপ্ল্যান, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন মাস্টারপ্ল্যানের জন্য একটি সমস্যার তালিকা (প্রবলেম স্টেটমেন্ট) তৈরি করেছি, আন্তর্জাতিক পারসপেকটিভ থেকে। এরপর আমরা আইসিটির জন্য রূপান্তরের একটা বাস্তব প্রতিবেদন তৈরি করেছি—ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন মাস্টারপ্ল্যান ও আইসিটি রিফর্ম রোডম্যাপ। সেটা খসড়া পর্যায়ে আছে। মার্চের শেষ দিকে একটা হালনাগাদ সংস্করণ করব। আমার কাছে মনে হয় প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর ছিল, পদ্ধতিগুলো দুর্বৃত্তায়িত ছিল। আমরা সেগুলোকে কিছুটা হলেও পরিবর্তন করতে পেরেছি।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম বেশি এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরে গতির ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে। এটার সমাধান কীভাবে করবেন?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: ইন্টারনেটের দাম বেশি—এটা পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণিত নয়। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম পৃথিবীর মধ্যে অন্যতমভাবে কম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেটের মানও পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন। এটাই মূল সমস্যা। আমি এত দিন তো অফিশিয়ালভাবে বিটিআরসির (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) কোনো দায়িত্বে ছিলাম না। গত এক সপ্তাহ থেকে এখানে কাজ করছি। এখন চাইছি, বিটিআরসির দিক থেকে যে কোয়ালিটি সার্ভিসের কথা বলা হচ্ছে, এমনকি যে বেঞ্চমার্কিং পদ্ধতি চালু আছে, সেখানে একটা আন্তর্জাতিক মানের বেঞ্চমার্কিং চালু করা। যাতে কাভারেজ ও মানের দিক থেকে মোবিলিটি অর্থাৎ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের ক্ষেত্রে—রেল মোবিলিটি, হাইওয়ে মোবিলিটি, নেভাল মোবিলিটি—এই মোবিলিটিগুলোর ক্ষেত্রে যদি আমরা বিশেষ কেপিআই বা পারফরম্যান্স সূচকের সূচনা করতে পারি, তাহলে কিছুটা প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারব। এটা মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে আমরা বলছি, ৫ এমবি, ১০ এমবি—এগুলোকে আমরা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বলতে অনীহা প্রকাশ করছি। আমরা চাচ্ছি ২০ এমবিপিএসকে ব্রডব্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। এর নিচের কোনো প্যাকেজ যাতে বাজারজাত করা না হয়, সে জন্য আমরা প্রাথমিকভাবে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি। তবে এই যোগাযোগটা একটা পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ ধাপ হিসেবে যাবে। বিটিআরসির তরফ থেকে একটা বেঞ্চমার্ক রিভিউ কমিটি আছে, তাদের মাধ্যমে আমরা এই কাজটা করব। আলোচনাগুলো শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে স্টারলিংক আসছে—এ নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এটা থেকে কি লাভ হতে পারে? কবে আসতে পারে স্টারলিংক?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: আমরা বলেছি, ৯০ দিনের মধ্যে আমরা স্টারলিংককে দেশে নিয়ে আসার চেষ্টা করব। আর্থ স্টেশন তৈরি করতে হবে। তবু আশা করি, এই ৯০ দিনের মধ্যেই আমরা সবাই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করব। স্টারলিংক এলে যে সেবাগুলো তারা দেবে, তার মধ্যে একটা প্রাথমিক সেবা হচ্ছে ইন্টারনেট। নিঃসন্দেহে স্টারলিংকের সুবিধা হচ্ছে, সেখানে লোডশেডিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাবে না, যেটা আইএসপির ক্ষেত্রে হয়। অনেক ক্ষেত্রে যদি লম্বা সময় ধরে লোডশেডিং থাকে, মোবাইল টাওয়ারের ব্যাটারির ব্যাকআপ ফুরিয়ে গেলে মোবাইল ইন্টারনেটেও বিঘ্ন ঘটে। স্টারলিংকের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা হবে না। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশের যে ফাইবার নেটওয়ার্ক, এর ‘ক্যারেক্টারিস্টিক’টা হচ্ছে ব্যাকবোনে মাটির নিচে টেলকো গ্রেডের ফাইবার আছে। কিন্তু শেষ প্রান্তে অর্থাৎ গ্রাহকপ্রান্তে যে ওভারহেড ফাইবার আছে, যেগুলো আসলে টেলকো গ্রেডের নয়। এ কারণে এরা ভালো সেবা দিতে পারে না। বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ শতাংশ টেলিযোগাযোগ এখনো ফাইবারাইজেশনের বাইরে। সেখানে মাইক্রোওয়েভ দিয়ে সেবা দেওয়া হয়, খুবই সীমিত ধারণক্ষমতা। আবার আমাদের মোবাইল নেটওয়ার্কের যে কাভারেজ আছে, তাতেও সমস্যা আছে। হাইওয়ে মোবিলিটি কাভারেজের সমস্যা আছে। স্টারলিংক এসব সমস্যার সমাধান করবে।
স্টারলিংক বাংলাদেশে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা করবে, এটা তো অনেক বড় অংশ নয়। সীমিত বা সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এটা করবে। তাতে স্থানীয় যে ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা থাকবেন, তাঁদের কি ব্যবসা হারানোর কোনো শঙ্কা রয়েছে? বিদেশি কোম্পানির হাতে ইন্টারনেট চলে যাবে কি না?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: এখন স্থানীয় যাঁরা আছেন, তাঁরা যদি বছরের পর বছর ধরে নিম্নমানের ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকেন, সেখানে তাঁরা কীভাবে তাঁদের নিজেদের বাজার ধরে রাখবে? সেটা নিয়ে তাঁদের চিন্তা করা উচিত। আমি তাঁদের প্রথমেই বলে দিয়েছি, স্টারলিংক এলে প্রিমিয়াম কাস্টমারদের মাইগ্রেশনের একটা পথ দিতে হবে। কারণ, এখানে দামের চেয়ে মান গুরুত্বপূর্ণ। এনজিওকর্মী, ফ্রিল্যান্সার, উদ্যোক্তা কিংবা করপোরেট, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, আমাদের যে ছাত্ররা কনটেন্ট তৈরি করেন, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে আমরা একটা মাইগ্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা দেখি। এখনো যেহেতু ৯০ দিন সময় আছে, আইএসপি (ইন্টারনেট সংযোগদাতা) কোম্পানিগুলো চাইলেই সমস্যাটা কাটিয়ে উঠতে পারে। অবশ্যই তাদের মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে হবে। দামের ক্ষেত্রে আসলে স্টারলিংকের দাম বেশি হবে। কিন্তু স্টারলিংকের সঙ্গে যখন আইএসপির প্রতিযোগিতা হবে বা মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের প্রতিযোগিতা হবে, তখন কিন্তু দামের বিষয়টা আসবে না। আসবে মানের বিষয়। সে ক্ষেত্রে তারা যদি এই ৯০ দিনের মধ্যে মান নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে দেশীয় বিনিয়োগের বিষয়গুলো নিরাপত্তা পাবে। তবে মোবাইল ইন্টারনেট তো পুরোটা দেশীয় বিনিয়োগ নয়। আইএসপির ক্ষেত্রে কিছুটা দেশীয় বিনিয়োগ, তবে সেই পরিমাণটা খুবই ছোট। এনটিটিএনের (ন্যাশনওয়াইড ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক) ক্ষেত্রে যাঁরা একচেটিয়া ব্যবসা করতে চান, তাঁরা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জে পড়বেন। কারণ, আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করব, স্টারলিংকের যে ডেটাফিডটা হবে, সেটা সাবমেরিন কেব্ল থেকে হবে। তবে স্টারলিংক যেহেতু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বড় প্রতিষ্ঠান, তাদের স্বাধীনতা থাকবে। তারা স্থানীয় পরিবেশকদের সঙ্গে কাজ করবে। স্বাধীনভাবেই তারা সবকিছু করবে।
এটার ওপর কি আপনাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে? মানে বিটিআরসির কোনো নিয়ন্ত্রণ কি থাকবে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: আমার মনে হয় না।
এনটিটিএনের কথা বলছিলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আইসিটি মন্ত্রণালয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করেছে। আপনাদের সঙ্গে কি তারা এখনো আছে? থাকবে কি না, এটা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: আমরা তদন্ত করছি। তাদের চুক্তিগুলো কীভাবে রিভিউ করা যায়, বিভিন্নভাবে যে ব্যতিক্রমগুলো, যে ব্যত্যয়গুলো তারা করেছে, তাদের সবাইকে এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমাদের হাইটেক পার্কে তারা জমি নিয়েছে। সেই জমিগুলো যেভাবে উন্নয়ন করার কথা ছিল, সেগুলো তারা উন্নয়ন করেনি ঠিকমতো। সেটার ওপর তদন্ত করেছি। তাদের চিঠি দিয়েছি। এখন যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে একটা পর্যায়ে তাদের ব্যত্যয়ের জায়গাগুলোতে তাদের অ্যাকসেস সীমিত করে দেওয়ার চেষ্টা করব। অর্থাৎ যতটুকু পর্যন্ত জমি তারা উন্নয়ন করেছে, ততটুকু জমি তাদের জন্য রাখা হবে। ধরা যাক, চার একর জমি যদি তারা উন্নয়ন করে থাকে এবং ৯ থেকে ১৩ একর জমি নিয়ে থাকে, তাহলে বাকিটা আমরা তাদের কাছ থেকে অবমুক্ত করে নতুন বিনিয়োগকারীদের দেওয়ার চেষ্টা করব। আর ফাইবারের ক্ষেত্রে যেটা রেভিনিউ শেয়ারিং, সেই মডেলটা টেকসই না। ৯০: ১০ ভিত্তিতে আগের সরকার যে চুক্তিটা করেছে, সেটাকে আমরা দেশের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করি। চুক্তিটা কীভাবে রিভিউ করা যায়, তা তাদের জানানো হয়েছে। তারা যদি সাড়া দেয় ভালো, না দিলে আমরা অংশীজনদের সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।
এটা কি কোনোভাবে মোবাইল অপারেটরদের কাছে যাওয়ার কোনো ব্যাপার আছে? যেমন ধরুন, তারা দীর্ঘদিন ধরে বলছিল যে আমাদের এনটিটিএন সেবা দেওয়ার সুযোগ দিন।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: না, এটা দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা নীতিগতভাবে এখনো মোবাইল অপারেটরগুলোকে এনটিটিএন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিইনি। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশে দিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এনটিটিএন ও মোবাইল সেবা যদি এক কোম্পানি পেয়ে যায়, তাহলে সেখানে মনোপলি (একচেটিয়া) হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে আমরা মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি না।
তবে যেহেতু বিটিআরসির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরকে প্রভাবিত করে সেখানকার সাবেক ব্যবস্থাপনা এবং এনটিটিএন কোম্পানিগুলো অনেক কালাকানুন করেছে। আমরা চাইব সেই কালাকানুনগুলো, সেই পরিপত্রগুলো যাতে পুনরায় দেখা হয়। অর্থাৎ এমএনওগুলো যদি ফাইবার পায়, তাহলে সেই ফাইবারের ভিজিবিলিটি দেখার অধিকার তাদের আছে। কারণ তাদের সেবার মান। সামিট ও ফাইবার অ্যাট হোমের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে যে বিটিআরসির কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে সেগুলো ও যথাযথ প্রক্রিয়াগুলো বন্ধ করে দিতে চেয়েছে। আমরা সেখানে তাদের যৌক্তিক যে সুবিধা দেওয়া দরকার, সেটা দেব।
এটুআই, আইডিয়া প্রকল্প, স্টার্টআপ বাংলাদেশ ইত্যাদি প্রকল্প নিয়ে অনেক আলোচনা, বিতর্ক আছে। বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখছেন? কীভাবে সামলাচ্ছেন?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: প্রকল্পগুলো নিয়ে তদন্ত করা হয়েছে। বেশ কিছু অনিয়ম উঠে এসেছে তদন্তে। যে যে প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে এবং যেসব পরামর্শকদের নিয়োগে দুর্নীতি করা হয়েছে, তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে যা যা আছে, তা গণমাধ্যমেও এসেছে। বাজে যে প্রকল্পগুলো আছে, অপখরচের যে প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মূলত আইডিয়াতে আমরা একটা তদন্ত করে দেখেছি, হাজারের বেশি মানুষকে এসএমই ঋণ দেওয়া হয়েছে। সেখানে হাজারখানেক মানুষকে দলীয় পরিচয়ে ঋণ দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৪০ জন এমপি-মন্ত্রীর পরিচয়ে ১০ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। সেখানে অনেক নামীদামি লোকজনকেও এমন ঋণ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন উদ্যোক্তার নাম করে দুর্নীতি হয়েছে এবং দুর্নীতিগুলো ডকুমেন্টেড। সব প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। সে জন্য আমরা চিন্তাভাবনা করছি, উদ্যোক্তাদের যেভাবে ঋণ দেওয়া হয়, সেই প্রক্রিয়াটির পরিবর্তন করব। শুধু নির্বাচক কমিটি নয়, ঋণের পদ্ধতিগত পরিবর্তন করতে হবে, যাতে এভাবে নয়ছয় করে, স্বজনপ্রীতি করে অথবা দলীয় কর্মীদের টাকা দেওয়ার যে একটা অপচেষ্টা ছিল, সেটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যায়।
প্রথম আলো: আমাদের হাইটেক পার্কগুলোতে একের পর এক দালান দাঁড় করানো হয়েছে। সব কটির কি প্রয়োজন আছে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: প্রতিটি জেলায় যদি গড়ে ৪০ থেকে ৫০ লাখ লোক থাকে, তাহলে আমরা বলব, এতগুলো মানুষের জন্য এতগুলো হাইটেক পার্কের প্রয়োজন আছে। একটা জেলায় যে পরিমাণ লোক বসবাস করে, পৃথিবীর বহু দেশে এত মানুষ নেই। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়নের দিক থেকে হাইটেক পার্কগুলোর প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। কিন্তু আগের সরকার বিভিন্ন জেলায় যে হাইটেক পার্কগুলো করেছে, সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শহর থেকে অনেক দূরে দূরে। কোনো কোনো মন্ত্রী বা এমপি তাঁদের আত্মীয়স্বজনের জায়গায় হাইটেক পার্ক করেছে। এ কারণে ভূমি অধিগ্রহণেও অনেক দুর্নীতি ছিল। সে জন্যই দেখতে পাচ্ছি, অধিকাংশ হাইটেক পার্ক শহর থেকে অনেক দূরে। এ জন্য এখন আমরা সেখানে দালান দেখতে পাই, কিন্তু সেই দালানে ভেতরে সফট স্কিল ডেভেলপমেন্টের কোনো প্রক্রিয়া নেই, প্রশিক্ষণ নেই। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক জায়গায় সাইট ভিজিটে গিয়েছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করেছি, চেষ্টা করেছি তাদেরকে সেখানে নেওয়ার। কিন্তু যেহেতু আসলে স্থানগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং দূরত্ব অনেক বেশি, তাই কেউ সেখানে যেতে চায় না।
এটা লাভজনক করবেন কী করে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: এটা লাভজনক করা তো পরের কথা, এটা আসলে পরিচালনা করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের নামীদামি যারা এনজিও, তাদের আমরা ডেকেছি। কারও কারও কাছ থেকে প্রপোজালও পেয়েছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ রকম একটি কোম্পানির অনুকূলে সবকিছু দেওয়ার অনুরোধ আছে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া। এখন সব একটা কোম্পানিকে দিয়ে দিলেই পুরো বিষয়টা ব্যাহত হবে। সে জন্য কিছু জায়গায় আমরা রাজি হতে পারছি না। এসব কারণে আসলেই সেখানে আইটি–বিষয়ক দক্ষতা গড়ে তোলাটা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। এরপরও আমরা এই চ্যালেঞ্জটা নিতে চাই। আমরা চেষ্টা করছি, হাইটেক পার্কগুলোতে কীভাবে সফট স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফ্যাসিলিটিতে রূপান্তর করা যায়।
সেটা কি আদৌ হবে? কারণ, আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখন পর্যন্ত যে হাইটেক পার্কগুলো চালু আছে, যেমন যশোর বা গাজীপুর—এগুলো তো আসলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্যই যে তা–ও তো না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ওখানে হোটেল ব্যবসা আছে, বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। তবু কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষজন আসছে না।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: আসলে এখানে একটু ভিন্ন মতও রয়েছে। সেখানে রেস্টুরেন্ট আছে, বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু হাইটেক পার্কের আসলে কয়েক শ কোম্পানি আছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে মূল সমস্যাটা হচ্ছে সেখানে হয়তো ২০টা ভালো কোম্পানি আছে। এই ২০টার বাইরে আরও ১০০টা আছে নামসর্বস্ব কোম্পানি। সেখানে তারা দলীয় অফিস বানিয়েছে। এমন অনেক অপখাতে অর্থ ব্যয় হয়েছে। আবার দেখুন, যেহেতু দলীয় অফিস দিয়েছে, তাই তাদের কাছ থেকে টাকা তোলা যায়নি। ভাড়া বা ইউটিলিটির টাকাও তুলতে পারে না। সে জন্য আমরা প্রায় কয়েক ডজন কোম্পানির কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা পাই। এমন অনেক সমস্যা আছে। তবে সেখানে কিছু ভালো কোম্পানিও কিন্তু আছে।

প্রতিটা জেলায় হাজার হাজার ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন। তাদের বলা হয়েছে যে পেপ্যাল আসবে, কিন্তু কবে আসবে, সেটা তারা জানে না। এখন পেপ্যাল কি আনা সম্ভব?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: আগের সরকার পেপ্যাল বিষয়ে নাগরিকদের মিথ্যা কথা বলেছে। আসলে পেপ্যাল আসবে—এ কথা বলে বিশাল বিশাল দল বেশ কয়েকবার আমেরিকায় ঘুরতে গেছে। আরও বহু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে, অর্থের অপচয় করেছে। পেপ্যাল না আসার বেশ কিছু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ আছে। একটা প্রত্যক্ষ কারণ হচ্ছে আমাদের এখানে ফাইন্যানশিয়াল সেটেলমেন্টের ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ অনলাইনে স্ক্যাম হলে বিএফআইও ২৪/৭ সাপোর্ট দিতে পারে না। এমন কোনো দল বা ইউনিটই নেই আমাদের। অর্থাৎ আর্থিক নিরাপত্তার জন্য ফাইন্যান্সিয়াল স্ক্যামের ২৪ ঘণ্টার কোনো কল সেন্টার বা এ ধরনের কোনো সুবিধা নেই। এটা একটা কারিগরি সমস্যা।
এরপর আছে ঠিকানা নিশ্চিতকরণ (অ্যাড্রেস ভেরিফিকেশন)। আমাদের নাগরিকদের অ্যাড্রেস ভেরিফিকেশন নেই। পেপ্যাল এখনো অ্যাড্রেস ভেরিফিকেশনের ভিত্তিতে কাজ করে। ফলে এটা একটা বড় সমস্যা। আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে, পেপ্যাল একটা মার্কেটপ্লেস। এটা শুধু একটি পেমেন্ট গেটওয়ে নয়। এখানে ট্রানজেকশনটা দ্বিমুখী হতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কেবল একমুখী ট্রানজেকশন অনুমোদন দেয়, তাহলে পেপ্যাল আসবে না। এর বাইরেও কারণ আছে। যখনই আমরা পেপ্যালকে অনুরোধ করি, দেখা যায় সেই অনুরোধ ভারতে চলে যায়। ভারতীয় কর্মকর্তারা কোনো সাড়া দেন না। আমাদের এ রকম বহু পরোক্ষ সমস্যারও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমাদের সরকারের আমলে অন্তত দুবার আমরা এর মোকাবিলা করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগ্রহ দেখানো হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেও আগ্রহ দেখানো হয়েছিল। সেভাবে আমরা কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি। তবে আমরা এখন চেষ্টা করছি মার্কিন দূতাবাসকে এখানে যুক্ত করতে। একই সঙ্গে পেপ্যাল সিঙ্গাপুরকে আলাদাভাবে রিচ করতে। কিন্তু পেপ্যাল সিঙ্গাপুরের কর্মকর্তাদের অধিকাংশই ভারতীয়, সে ক্ষেত্রে তারা অনেক ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করতে পারে।
আপনি সংস্কার করতে এসেছেন। আপনার জায়গা থেকে আসলে কতখানি সংস্কার হয়েছে? একটা শ্বেতপত্র প্রকাশের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম আমরা। সেটা কত দূর?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: শ্বেতপত্র দল গঠিত হয়েছে। তারা কাজ করছে।
কত দিন লাগতে পারে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: আমরা তাদের তিন মাসের সময় দিয়েছি। প্রথমে দুই মাসের সময় দিয়েছিলাম, কিন্তু কাজের পরিমাণ এত বেশি যে তারা তিন মাস সময় চেয়েছে।
স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি—আপনারা আইসিটি উন্নয়নে কী কী ধরনের কাজ করবেন?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: এই কাজগুলোর তালিকা আইসিটি মাস্টারপ্ল্যানে দেওয়া আছে। আমরা মূলত তিন ভাগে ভাগ করেছি—স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। আইসিটির মাস্টারপ্ল্যানে বিস্তারিত বলেছি আমরা।
প্রথম আলো: এই যে এত চাপ, এত দুর্নীতির খবর, আপনার কেমন লাগছে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: ব্যক্তিগত অনুভূতি হচ্ছে, আমরা আসলে কাজের ভারে বিপর্যস্ত। কিন্তু এগুলোকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে চাই। ইতিবাচকভাবে নিতে চাই। যদি দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারি এই চাপের বিপরীতে। একদিক থেকে নাগরিকদের তো চাপ আছেই। এরপর আছে নিজেদের কাজের চাপ। এই দুটি চাপকে আমরা অতিক্রম করতে চাই। আমরা মনে করি, চাপটা আমরা নিতে পারব দিন শেষে। বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে আমরা আসলে সিগনিফিকেন্ট ডেলিভারিগুলো দেওয়া শুরু করতে পারব। আমরা সাইবার সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্স পাস করার চেষ্টা করব। এখন ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন নিয়ে কাজ করছি। আগামী মাসের শেষ দিকে অর্থাৎ এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিকে আমরা সেটাও করতে পারব। ডেটা সেন্টার করার চেষ্টা করছি। আমরা সমান্তরালভাবে কাজ করছি। আশা করি, এই কাজগুলো দ্রুতই আলোর মুখ দেখবে।
ডেটা সেন্টারগুলো নিয়েও একটা প্রশ্ন করার ছিল। মেঘনা ক্লাউড নিয়ে অনেক কথা উঠেছে...
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: সব ভুল জায়গায় ভুল চুক্তি করে আওয়ামী লীগের লোকজনকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তারা পালিয়ে গেছে। তারা রড–সিমেন্ট কোম্পানিকে তাদের কাজ দিয়ে গেছে, যারা এখন এই কাজ করতে অক্ষম। এখন চিঠি আসছে, তারা বহু মাস ধরে কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা চেয়েছে। কিন্তু আমাদের পক্ষে কোনো সহযোগিতা করা সম্ভব নয়। একটা পর্যায়ে হয়তো এই চুক্তিটা বাতিল করাটাই যৌক্তিক হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: আপনাকেও।