
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর কৃষি অনুষদের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী রাগীব হাসান। ৪৩ বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হন কর ক্যাডারে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে গেজেটভুক্ত হওয়া থেকে বাদ পড়ে যায় তার নাম।
জানা যায়, ক্যাম্পাসে তুখোড় বিতার্কিক ও বাধনকর্মী হিসেবে পরিচিত রাগীব হাসান ৪৩ তম বিসিএসে হন কর ক্যাডার । ১৫ অক্টোবরে প্রকাশিত ৪৩ তম বিসিএসের গেজেটে গেজেটপ্রাপ্ত হন তিনি। তবে ৩১ ডিসেম্বর পুনরায় গেজেট প্রকাশ করলে গেজেটপ্রাপ্তদের তালিকা হতে তার নাম বাদ পড়ে যায়। ধারণা করা হয় ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কমিটিতে ছাত্রলীগের পদ থাকার কারণে গেজেট থেকে নাম বাদ পড়ে তার।
এ ব্যাপার রাগীব হাসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রথম বর্ষ থেকে রাজনীতি করার জন্য ছাত্রলীগের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তাকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তবে অনিহার কারণে রাজনীতিতে যোগ না দিয়ে সক্রিয় হন বিতর্ক ও বাঁধনের সাথে। একপর্যায়ে তাকে শিবির কর্মী ট্যাগ গেস্টরুমে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
তিনি আরো বলেন, স্কুল থেকে তিনি বিতর্কের সাথে জড়িত। অরাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় রাজনীতিতে কোনো রকম আগ্রহ ছিল না তার। এই কারণে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বারবার শিবির ট্যাগ দিয়ে গেস্ট রুমে নিয়ে যেত৷ এবং ছাত্রলীগের মিছিল মিটিংয়ে না শিবির ট্যাগ দিয়ে হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিত বারবার ৷ পরে ক্যাম্পাসে টিকে থাকা ও হলে সিট বাঁচানোর তাগিদে বাধ্য হয়ে মিটিং মিছিলে যেতে হয়েছে।
নিজের কোটা থাকা সত্ত্বেও ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনে নিজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের সাথে সখ্যতার কারণে আরেক দফা ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হন রাগীব।
রাগীব আরো জানান, নির্যাতনের পর কোনোরকমে হলে ছিলাম, এরপর ভালো বক্তৃতা দেওয়া ও ক্যাম্পাস এ পজিটিভ ইমেজ থাকার কারণে বলা হয় হল কমিটিতে পোস্ট নিতে, আমি রাজনীতি করতে আবার অস্বীকৃতি জানালে আবারো আমাকে গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্ধুদের সহযোগিতায় সেদিন আমি বেঁচে যাই। সিনিয়র লেভেল থেকে এবং হলের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ থেকে শিবির কর্মী বলে হল থেকে বের করে দেওয়ার ক্রমাগত হুমকির মাঝেই হল কমিটিতে আমার নাম রাখা হয়। হলে থাকতে দেখতাম শিবির কর্মী বা শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত কারো সরকারি চাকরির ভেরিফিকেশন আসলে নেগেটিভ রিপোর্ট দিতো যার কারণে তাদের চাকরিতে আর যোগদান করা হতো না, এই ভয় আর নির্যাতনের ভয়েই কাউকে কিছু বলতে পারিনি। আমি ফটোগ্রাফি করতাম ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম হলেই ক্যামেরা নিয়ে সেই প্রোগ্রাম এ যাওয়া লাগতো আর নেতাদের ছবি তোলা লাগতো, না গেলে গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে চার্জ করা হতো। কমিটিতে পোস্ট পাওয়ার পরেও এমন ঘটনা প্রায়ই হতো। পরে ২০২২ এ কমিটিও বিলুপ্ত হয়। এরপর আরও কমিটি হয়েছে কিন্তু আমি ছাত্রলীগের সকল প্রকার কার্যক্রম থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি।
এছাড়াও তিনি বলেন, ৪৩ বিসিএস এর প্রথম ভেরিফিকেশন হয়েছিলো আওয়ামী লীগের সময়, আমি চাইলেই সুবিধা নেওয়ার জন্য আমার পদের কথা উল্লেখ করতে পারতাম কিন্তু আমি করিনি উল্লেখ, আমার পুলিশ ভেরিফিকেশন ফাইল এ কোনও রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ নেই । আমার বাবা একজন সরকারি চাকুরিজীবী তার ও কোনও প্রকারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই।
আমার রুম ছিল ৩১০/ক, ফজলুল হক হল, এই রুমটা অরাজনৈতিক, আমি ক্যাম্পাস এর পুরো সময় এই রুম এ ছিলাম, জোর না করলে কখনও কোনও প্রোগ্রাম এ যাইনি। ফেসবুকেও কখনও রাজনৈতিক কোনও পোস্ট দিই নাই।
আমি ডিবেটিং ক্লাব এর সিনিয়র সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলাম, পর পর দুইবার আমি আন্ত:অনুষদীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার ডিবেটর অব দ্য টুর্নামেন্ট ছিলাম, দেশের বাইরেও বিতর্ক করতে গিয়েছি। আমি এখনও আমার হলের বাঁধন এর উপদেষ্টা। ক্যাম্পাসে আমার রাজনৈতিক পরিচয়ে কেউ আমাকে চিনে না আমাকে একজন বিতার্কিক হিসেবেই সবাই চিনে।
আমি ৫ আগস্ট এর সরকার পতনের পরেও অনেকদিন হলে অবস্থান করেছি৷ আমার হলে থাকা নিয়ে কেউ কোনো ধরনের অভিযোগ করেনি।
জুলাই আন্দোলনে আমি সহ আমার পুরো পরিবারের পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। আমার নিজের ভাই রাস্তায় নেমে আন্দোলনে করেছিল। এছাড়াও আমার নিকট আত্মীয় আন্দোলনের সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। আমি নিজে ২০১৮ এর কোটা আন্দোলনে ছিলাম, পিঠ বাঁচানোর জন্য যে কাজ করেছিলাম আজ আমি তার জন্য অপরাধী, এত কষ্ট করে পাওয়া চাকরিতে যোগদান করতে পারছি না।
আমার এই ঘটনা ভেরিফিকেশন এর সময় অনেক স্যার কেও জানিয়েছি কিন্তু কোনও লাভ হয়নি, আমার মতো অনেকেই আছে যারা এই নোংরা রাজনীতির স্বীকার হয়ে জীবনের কঠিন সময় পার করছে, আমার নামে কোনো নিপীড়ন বা অত্যাচারের অভিযোগ কেউই দিতে পারবে না। এ বিষয়ে আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি যাতে আমাদের প্রতি কোনো ধরনের বৈষম্য করা না হয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ও বাঁধন বাকৃবি জোনের সভাপতি মোর্শেদুল ইসলাম বলেন, রাগীব কোটা আন্দোলনে শুরু থেকেই ছিল, সামনে থেকে যতটা না হেল্প করেছে তার থেকে অনেক বেশি হেল্প করেছে পর্দার আড়ালে থেকে।
ক্যাম্পাস এর রেল লাইন অবরোধ করার পরিকল্পনা করি আমরা প্রথম থেকে এই পরিকল্পনা ছাত্রলীগ ভেস্তে দিতে চেয়েছিলো, ছাত্রলীগের পরিকল্পনা আমাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো রাগীব। আন্দোলনকারীদের জন্য পানি সরবরাহ থেকে শুরু করে পরবর্তী দিনের আন্দোলনের পরিকল্পনাতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। এজন্য তাকে নির্যাতনের শিকারও হতে হয়েছে। পরিষ্কার রাজনৈতিক চিন্তার একজনের গেজেট থেকে বাদ পড়াটা কষ্টকর। এছাড়াও সে বাঁধন ও বিতর্কের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ ছিল।
এছাড়াও কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক নেতা ও বাকৃবি বিতর্ক সংঘের সাবেক সহ সাধারণ-সম্পাদক কৃষিবিদ মাহাদী হাসান রাতুল বলেন, রাগীব কে আমার সাথে ঘোরার জন্য হলে শিবির বলা হয়েছিলো। ২০১৭ সালের দিকে নিয়মিত তাকে চাপ দেওয়া হতো রাজনীতিতে আসার জন্য। হলের এসব কথা আমাদের বললেও আসলেও আমাদের কিছুই করার ছিলো না। ছেলেটা পরিস্থিতির শিকার পুরোটাই। ২০১৮ এর কোটা আন্দোলনের পুরোটাই সে আমাদের সাথে ছিল, আন্দোলন শেষ হওয়ার পরে আমাদের সাথে ওকেও হলে অনেক বাজে পরিস্থিতির শিকার হতে হয়।