Image description

মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকায় আইফোন আর সাড়ে ৩ হাজার টাকায় মিলছে স্যামসাং গ্যালাক্সি। নকিয়া এনএক্স প্রো-এর দাম মাত্র ৩ হাজার টাকা। শুধু কী তাই? ৬৫ থেকে ৭৫ শতাংশ ডিসকাউন্টের পাশাপাশি থাকছে কিস্তির সুবিধা। সেই সঙ্গে একটি স্মার্ট ওয়াচ ফ্রি। এ ছাড়াও থাকছে ফোনের ১ বছরের ওয়ারেন্টি, ৩ মাসের মানিব্যাক গ্যারান্টি, হোম ডেলিভারিসহ আকর্ষণীয় সব অফার। তবে শর্ত প্রযোজ্য। এত সুবিধা পেতে হলে আগে বিকাশের মাধ্যমে গ্রাহককে টাকা পাঠাতে হবে। তবে এখানেও থাকছে ১৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট সুবিধা। শুনতে অবাক লাগলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন সব চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র।

ফেসবুকে চোখ রাখলেই দেখা যায়, বিভিন্ন পেজ থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, ক্যামেরাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিকস পণ্যের লোভনীয় বিজ্ঞাপন। এসব বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। 

এমনই একজন গাজীপুরের সুমাইয় (ছদ্মনাম)। অনলাইনে ‘মোবাইল সেল বাজার বিডি ডট কম’ নামের একটি পেজে মোবাইলের বিজ্ঞাপন দেখেন। সেখানে ৭৫ শতাংশ ডিসকাউন্টে ‘নকিয়া এনএক্স প্রো’ মোবাইলের দাম দেওয়া রয়েছে ৩ হাজার টাকা। বিকাশ পেমেন্টে আরও ১৫ শতাংশ ছাড়। ফোনটির র‌্যাম ৮ জিবি, রোম ১২৮ জিবি, ক্যামেরা ৪২/৪৬ মে, ডিসপ্লে ৬.৪ ইঞ্চি এবং ব্যাটারি ৬০০০ এমপিয়ার। সবকিছু দেখে তিনি ফোনটি অর্ডার করেন। 

সময়ের আলোকে তিনি বলেন, অর্ডার করার পর অ্যাডভান্স তাকে উল্লিখিত বিকাশ (০১৮৪০০৭৬৩১৯) নম্বরে ৩৫০ টাকা পাঠাতে বলে। টাকা পাঠানোর পরের দিন ডেলিভারিম্যান পরিচয়ে একজন ফোন করে বলেন, ফোন গাড়ি থেকে নামাতে একটা কোড নম্বর লাগবে। কোড নম্বরের জন্য যেখানে অর্ডার করেছিলাম সেখানে ফোন করি। সে বলে বাকি টাকা বিকাশে দিলে এক ঘণ্টার মধ্যে ফোন পেয়ে যাবেন। পরে একই নম্বরে ২ হাজার ৬৫০ টাকা বিকাশে পাঠিয়েছি। টাকা পাঠানোর পর তারা একটি কোড নম্বর দিয়েছে। সেটি ডেলিভারিম্যানকে দেওয়ার পর সে বলে এক ঘণ্টা পরে ফোন পাবেন। দেড় ঘণ্টা পরে ফোন দিলে সে আর ফোন ধরেনি। এরপর যেখানে অর্ডার করেছি সেখানে ফোন দিলে বলে একটু ঝামেলা হয়েছে আগামী কাল পাবেন। ডেলিভারিম্যানকে ফোন দিলে সে বলে আরও ২ হাজার ২০০ টাকা দিতে হবে। তাহলে ফোন হাতে দিয়ে আবার ২ হাজার ২০০ টাকাও ফেরত দেবে। এরপর ফোন দিলে বলে আরও টাকা দিতে হবে। এটা কি ৩ হাজার টাকার ফোন? এরপর সব নম্বর ব্লক করে দেয় চক্রটি। এরপর ভাইয়ের নম্বর থেকে ফোন দিলে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে। 

প্রতারণার শিকার মাদারীপুরের লিজা আক্তার (ছদ্মনাম) নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, একটা পেজে ৩ হাজার ৭০০ টাকায় আইফোন ফোরটিন প্রো ম্যাক্স দেখে আমি অর্ডার করেছিলাম। তারা বলছে ডেলিভারি চার্জ ৪৫০ টাকা অ্যাডভান্স দেওয়া লাগবে। আমি তাকে ৪৫০ টাকা বিকাশ করি। পরের দিন ডেলিভারিম্যান পরিচয়ে একজন ফোন করে। তারা বলে পুরো পেমেন্ট না করলে ডেলিভারিম্যান ফোন দিতে পারবে না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে টাকা না পাঠালে ফোন অন্য কোথাও চলে যাবে। এরপর আমি ৩ হাজার ৭৫০ টাকা পাঠিয়ে দিই। পাঠানোর পর বলে এটা অফিসিয়াল করতে আরও ৮ হাজার ৩০০ টাকা দিতে হবে। তবে ৮ হাজার লাগবে না। অফিসিয়াল হওয়ার পর ১ হাজার রেখে বাকি ৭ হাজার ফেরত দিয়ে দেবে। এরপর ৬ হাজার ৩০০ টাকা বিকাশে পাঠাই। কিন্তু টাকা পাঠানোর পর আমার নম্বর ব্লক করে দেয়। পরিবারের কেউ জানে না। ধার করে টাকা দিয়েছি। এখন কি করব বুঝতেছি না।

শুধু মোবাইল ফোনই নয়, বর্ডার ক্রস ইন্ডিয়ান মোটরসাইকেলের কথা বলে এক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। ইয়াসিন বিন আবদুল কাইয়ুম নামের এক ভুক্তভোগী সময়ের আলোকে বলেন, আমি অনলাইনে বাইক ওয়াসের একটি পাম্পের অর্ডার করেছিলাম। ৩ হাজার ৯০০ টাকার পাম্প ১ হাজার ৯০০ টাকা বলা হয়েছিল। আমি ১ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম। বারবার ফোন দেওয়ার পর বলে আপনার প্রোডাক্ট দুপুর ১২টার মধ্যে পৌঁছে যাবে। এরপর ফোন দিলে তারা আমাকে ব্লক করে দেয়।

এদিকে ফেসবুকে দেখা যায়, ‘সেল বাজার.কম’ নামে একটি পেজ থেকে বিশাল ছাড় দিয়ে মোবাইল বিক্রি বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছে, নিশ্চিত ৬৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট ও একটি আকর্ষণীয় স্মার্ট ওয়াচ ফ্রি। ১ বছরের ওয়ারেন্টি। ৩ মাসের মানিব্যাক গ্যারান্টি, হোম ডেলিভারি, তবে অ্যাডভ্যান্স প্রযোজ্য। অর্ডার করতে ও বিস্তারিত জানতে ০১৮৩৪৯৯৬৫৫৬ নম্বরে ফোন করতে বলা হয়েছে।

‘দারাজ মোবাইল কালেকশন’ নামে আর একটি পেজ থেকে বলা হয়েছে, দারাজে অফার চলছে। মোবাইলের ৬৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট। পছন্দের মোবাইলটা কিনতে পারবেন সাশ্রয়ী মূল্যে। তাই দেরি না করে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে অর্ডার করুন। আমাদের অনলাইন পেজ থেকে ২৪ ঘণ্টার ভেতরে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে (৬৪ জেলায়) হোম ডেলিভারি করে থাকি। যেকোনো কারণে প্রোডাক্ট পছন্দ না হলে ফেরত নেওয়া হয়। এ আইটেম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ টিপস পেতে কল করুন আমাদের অফিসের এই নম্বরে (০১৯৬২৪৪৩৬৪৪)। তবে হোম ডেলিভারি নিতে হলে প্রোডাক্টের টাকা থেকে ৫৫০ টাকা অগ্রিম পেমেন্ট করতে হবে অর্ডারটা কনফার্ম করার জন্য। অফারের সঙ্গে থাকছে ৬ মাসের মানিব্যাক গ্যারান্টি, ১ বছরের ওয়ারেন্টি। ফুল বিকাশে পেমেন্ট করলে ১০ শতাংশ ডিসকাউন্ট। আমাদের ফোন যদি কেউ কপি প্রমাণ করতে পারে ১ হাজার টাকা জরিমানা আমরাই দেব। বাংলাদেশের সব কাস্টমারের কাছে এটা আমাদের চ্যালেঞ্জ, পারলে প্রমাণ করে দেখাবেন।

‘মোবাইল মার্কেট বিডি’ ও ‘মোবাইল গ্যালারি’ নামের দুটি পেজ থেকে বলা হয়েছে ধামাকা অফার! স্যামস্যাং গ্যালাক্সি এস ২২ আল্ট্রা হাই সুপার মাস্টার কপি দাম মাত্র ৩ হাজার ৫০০ টাকা। নিশ্চিত ৬৫ শতাংশ ডিসকাউন্টের সঙ্গে পাচ্ছেন একটি আকর্ষণীয় স্মার্ট ওয়াচ ফ্রি! ফোন নিতে কল করুন (০১৬১৯৯০৩৪৬১) নম্বরে। ফোনের সঙ্গে থাকছে ১ বছরের ওয়ারেন্টি! ৬ মাসের মানিব্যাক গ্যারান্টি! হোম ডেলিভারি চার্জ ৫২০ টাকা।

এদিকে ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টসহ মাসিক কিস্তিতে ফোন বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ‘স্ট্রিট কালেকশন বিডি’ নামের একটি পেজে। এখানে আইফোন এক্সএস (৬৪ জিবি) দাম বলা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। আর আইফোন এক্সএস (২৫ জিবি) ২৩ হাজার ১০০ টাকা, ইএমআই সার্ভিসসহ। অর্ডার করতে উল্লিখিত নম্বরে (০১৩২...২৬১) ফোন করতে বলা হয়েছে। বিজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, যেকোনো ডিভাইস কিনলে ২ হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করতে হবে, প্রোডাক্ট হাতে পেয়ে ৩ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। পরবর্তী মাসে বাকি টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। অফারের সঙ্গে থাকছে ১ মাসের রিপ্লেসমেন্ট গ্যারান্টি, ২ বছরের সার্ভিস ওয়ারেন্টি ফ্রি, ৬/১২ মাসের কিস্তির সুবিধা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হয়। ঠিকানা দেওয়া হয়েছে শপ নং-১৫, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন (সিসিটি) বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার আরিফুল হোসেইন তুহিন সময়ের আলোকে বলেন, ফেসবুকে যখন মার্কেট প্লেস আসে তখন থেকেই প্রতারণা শুরু হয়েছে। ফেসবুকে ৩ দিনের জন্য একটা অ্যাড দিয়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেটি আবার বন্ধ করে দেয়। আবার নতুন আইডি ক্রিয়েট করে প্রতারণা শুরু করে। এ রকম ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। এগুলো আমাদের নজরে এলে আমাদের ইন্টারনাল মেকানিজমের মাধ্যমে রিপোর্ট করে দিই। আর এই কাজটা বিটিআরসির। আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে আমরা আইডেন্টিফাই করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। এ ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স। সুতরাং ফেসবুক মার্কেট ক্রয়-বিক্রয় করার ক্ষেত্রে সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিআরসির এক কর্মকর্তা সময়ের আলোকে বলেন, এটি ই-কমার্স টাইপের প্রতারণা। এটি দেখার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আছে। মনিটরিং করার দায়িত্ব আমাদের না। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে তারা যদি আমাদেরকে কোনো বিষয়ে নজরে আনে তাহলে আমরা রিপোর্ট করি। ব্যক্তি মানুষ অভিযোগ করলে আমরা সেটি দেখি না, আইন আমাদের সাপোর্ট করে না। যদি কোনো সরকারি সংস্থা আমাদের রিপোর্ট করে তাহলে ডিজিটাল সিকিউরিটি সেলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কন্ট্রাক করি।
আইআইটি অনুবিভাগ (কেন্দ্রীয় ই-কমার্স সেল) এর উপসচিব মুহাম্মদ সাঈদ আলী সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের কাছেও এ রকম প্রতারণার অনেক অভিযোগ আসছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিটিআরসির সঙ্গে কথাও বলেছি। আমাদের নজরে যেগুলো পড়ে সেগুলো বিটিআরসিকে বলে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিই। আবার অনেক কিছু নজর এড়িয়ে যায়। প্রতারকরা ভুয়া পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণসহ কেউ যদি অভিযোগ করে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।