
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। কোটা সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্র ও জনতার আন্দোলনের মুখে অবশেষে পদত্যাগ করে সরকার। রাজপথ জুড়ে তখন বিজয়ের উল্লাস। কিন্তু থামেনি পুলিশের গুলি।
ঢাকার মিরপুর-২ নম্বর মডেল থানার সামনে বিকেলবেলা পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার শালচুড়া, রাংটিয়া গ্রামের শহীদ শাহাদাত হোসেন (২৮)।
তিন ভাইবোনের মধ্যে শাহাদাত ছিলেন দ্বিতীয়। পিতা মৃত ইদ্রিস আলী ও মাতা সুরুতা বেগমের সন্তান শাহাদাত ছিলেন এক কন্যাশিশুর জনক। রাজধানীতে একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন তিনি। ছোট পরিবারকে সচ্ছলতার পথে নিতে ছিলেন দৃঢ়সংকল্প। কিন্তু এক বিকেলে গুলির শব্দে থেমে যায় সেই স্বপ্ন।
মায়ের ভাষায়, ‘আমার ছেলে বিয়ের পর এক্সিডেন্ট করে। নিজের সামান্য যা ছিল তা আর মানুষের কাছে চেয়ে চিকিৎসা করাইছি। তখনই তার বউ ছাইড়া চলে যায়। আমি নিজে হাতে তাকে সুস্থ করছি।’
ভাঙা কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘যেদিন আমার পোলাডা মারা গেল, সেদিন লাশ দেখতে আসছিল সেই বউ। পরে সরকারি-বেসরকারি যত অনুদান আসছে, সব সেই বউ নিয়ে যায়। আমি কিছুই পাই নাই। পোলাডা বাঁচা থাকতে আমাকে টাকা পাঠাইতো, সেই টাকায় চলতাম। এখন তো পথের ফকিরের মতো হইয়া গেছি। আরেকবারও যদি ছেলে ফিরে আসত... এখনো তার হত্যার বিচার পাই নাই। যারা ওরে মাইরা ফেলছে তারা তো খোলাখুলি ঘুরে বেড়ায়। আমি বিচার চাই। মরার আগে ন্যায়বিচার দেখে মরতে চাই।’
শাহাদাতের ছোট বোন রিমাও জানালেন সেই দিনের ঘটনা—‘ভাই ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করতো। বাসা দূরে থাকায় যোগাযোগ হতো কম। ৫ আগস্ট বিকেলে শুনি ভাইকে গুলি করছে পুলিশ। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি ভাই নাই। ভাইয়ের হত্যার আজও কোনো বিচার হয়নি।’
পরিবারটির এখন একটাই দাবি—এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত হোক, দোষীরা শাস্তি পাক। শাহাদাতের মতো আর কোনো তরুণ যেন গুলিতে প্রাণ না হারায়, আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।