ক্রিকেটের মতো দেশে গলফও দেশের সম্ভাবনায় খেলা হয়ে উঠতে পারতো। সিদ্দিকুরের মতো আরও দুয়েকজন গলফার সব সময় পাইপলাইনে থাকতে পারতো। কিন্তু গোড়ায় গণ্ডগোলের কারণে সেটা হয়ে উঠছে না। গলফার তৈরির আঁতুড়ঘর হওয়ার কথা দেশের গলফ ক্লাব ও ফেডারেশনের। কিন্তু পেশাদারিত্বের অভাব, স্বজনপ্রীতি, অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক চিন্তা, আর্থিক লাভ, স্বেচ্ছাচারিতা এবং নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করায় দেশের ক্লাবগুলো হয়ে উঠছে ব্যক্তিগত বিনোদনের জায়গা। আর ফেডারেশন নিজস্ব স্টাইলে চলতে গিয়ে রয়ে গেছে অস্পৃশ্য। এসবের গ্যাড়াকলে পড়ে গত ১৫ বছরে দেশে নতুন কোনো গলফার তৈরি হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গলফ ব্যক্তিগত খেলা হওয়ায় খুব সহজে সঠিক পরিকল্পনা থাকলে সিদ্দিকুরের মতো দুয়েকজন গলফার তৈরি সম্ভব ছিল। কিন্তু গলফ ফেডারেশনের তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। যেমন—জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন, ১৯৭৪/২০১৮ এর ১০ ধারায় প্রতিটি ক্রীড়া ফেডারেশনের লিখিত সংবিধান/কার্যপদ্ধতি থাকা বাঞ্চনীয়। তাছাড়া প্রত্যেকটি ফেডারেশনের প্রতি বছর অডিট রিপোর্ট ও কর্ম পরিকল্পনা জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত গলফ ফেডারেশনের অনুমোদিত ‘গঠনতন্ত্র বা সাংগঠনিক কাঠামো’ নেই। আবার ক্রীড়া পরিষদে কোনো বার্ষিক অডিট রিপোর্টও জমা দেয়া হয়নি। আর এসবের ‘শাস্তি’ হিসেবে সম্প্রতি ক্রীড়া মন্ত্রণালয় গলফ ফেডারেশনে সকল প্রকার আর্থিক অনুদান স্থগিত করেছে।
জানা গেছে, সামরিক বাহিনীর জায়গায় অবস্থিত এই অজুহাতে ফেডারেশনের কোনো সংস্থা/ক্লাবের সরকারি রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি। অথচ সশস্ত্র বাহিনীর জায়গায় গড়ে ওঠা অনেক লাভজনক ও অলাভজনক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যেমন—সেনা কল্যাণ, আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, রেডিসন ইত্যাদি সরকারি রেজিস্ট্রেশন ভুক্ত হয়েছে।
উল্লেখ্য, শুধুমাত্র বাংলদেশ প্রফেশনাল গলফার অ্যাসোসিয়েশন ২০১২ সালে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের (আরজেএসসি) অধীনে রেজিস্ট্রেশনকৃত একটি প্রতিষ্ঠান। যদিও এখন পর্যন্ত এটিরও মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন (এমওএ) এবং আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন (এওএ) সংশোধন বা পরিমার্জন করা হয়নি। ফলে এটিও মূলত অকার্যকর হয়ে আছে।
অন্যদিকে, ক্লাব ভিত্তিক খেলা হলো গলফ। অভিযোগ রয়েছে গলফ ক্লাবগুলো যতটা না প্রাইভেট বিনোদন ক্লাব হিসেবে কাজ করছে। ততটা স্পোর্টস ক্লাব হিসেবে কাজ করছে না। যদিও সবগুলো ক্লাবকে ১৯৯৮ সালে ফেডারেশনের অধীন আনা হয়েছে । তবে কোনো গলফ ক্লাবের সরকারি রেজিস্ট্রেশন হয়নি বা অনুমোদিত ‘সংবিধান নেই’। গত ১৫ বছরে কোনো এজিএম বা অডিট রিপোর্টও ফেডারেশনে জমা পড়েনি। ফলে ওই সমস্ত ক্লাবের সদস্যরা জানতে পারে না তাদের বিশাল সদস্য ফি কিংবা মাসিক চাঁদা বা তাদের স্পসনশিপের টাকা কিভাবে খরচ হয়।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদরা বড় অংকের টাকা সদস্য ফি দিয়ে ক্লাবের সদস্য হন। তারা মূলত সামাজিক ও ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক লাভ ক্ষতির উদ্দেশে বেশি বেশি বিনোদনমূলক গলফ, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে স্পন্সর করতে উৎসাহী। এতে ক্লাবগুলোও প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট আয়োজনের দিকে না গিয়ে বরং ক্লাব পর্যায়ে বয়স্কদের বিনোদনমূলক টুর্নামেন্ট, আনন্দ, বিনোদন ইত্যাদি আয়োজনে বেশি মনোযোগ দেয়। যেমন বসুন্ধরা, জেমকন, সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, ওয়ালটনের মতো বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ক্লাব পর্যায়ের গলফ টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে শীর্ষস্থানীয় আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের সন্তুষ্ট করতে রাজি বেশি। কিন্তু পেশাদার গলফার তৈরিতের তেমন মনোযোগী নয়। তাই এসব আয়োজন দেশের গলফের উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
ক্লাবগুলো যেন দুর্নীতির আঁতুড়ঘর
গলফের সার্বিক উন্নয়নের জন্য গুণগত উন্নয়ন জরুরি। সেটা কাঠামোগত উন্নয়ন নয়। কিন্তু গত ১৫ বছর খেলার উন্নয়নের চেয়ে ক্লাবের সুযোগ-সুবিধাকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। আর এই উন্নয়নের বদৌলতে ক্লাবগুলো হয়ে উঠেছিল দুর্নীতির আখড়া। এসব দুর্নীতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ‘জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিকী এবং তার অনুসারীরা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব হাউস নির্মাণের জন্য জেনারেল মইনের পথ ধরে জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া খরচ করেছেন ১১০ কোটি টাকা। আর জেনারেল তারেককে সঙ্গে নিয়ে জেনারেল আজিজ ‘আর্মি গলফ ক্লাব’ তৈরিতে খরচ করেছেন ৯০ কোটি টাকায়। গলফ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কুর্মিটোলার মতো এতো বড় গলফ ক্লাব পৃথিবীর কোথাও নেই।
আরও জানা যায়, গলফ ক্লাব সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিতে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন। সম্প্রতি ‘জলসিঁড়ি গলফ ক্লাব’ তৈরি করেছে তিনি। ‘প্রাণ ডেভেলপমেন্ট প্রোপারটিস’ নামে এক কোম্পানিকে দিয়ে ১৭৫ কোটি টাকা খরচে ক্লাবটি নির্মাণের মাধ্যমে নিজের পকেট ভারী করেছেন তিনি। কারণ এতো ব্যয়বহুল ক্লাবটিতে গলফ খেলার মূল উপাদান ‘কোর্স’ নির্মাণের জন্য খরচ হয়েছে মাত্র ৮ কোটি টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, জেনারেল শফি ‘নান্দনিক’ নামে একটি আর্কিটেক কোম্পানি দিয়ে জলসিঁড়ি এবং বিভিন্ন গলফ ক্লাবে কোটি কোটি টাকার কাজ করিয়েছেন। আর এই নান্দনিকের পরিচালক একজন নারী। ওই নারীর সঙ্গে জেনারেল শফির অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বলেও গুঞ্জন আছে। এছাড়া কেবল শেখ হাসিনার নজরে পড়তে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে ২০১৯ সালে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার আর্মি গলফ ক্লাবে শেখ মুজিবের প্রথম ভাস্কর্য বানান জেনারেল শফি। জানা গেছে, শেখ মুজিবের সেই মোরাল এখনো আর্মি গলফ ক্লাবে শোভা পাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব প্রকল্পের উন্নয়নে যত টাকা খরচ করা হয়েছে তা গলফ ফেডারেশনের ৪০ বছরের বার্ষিক বাজেটের চেয়েও বেশি। শুধু তাই নয়, উন্নয়নে ব্যয়কৃত অর্থের অর্ধেকের চেয়েও কমে ২০টি এশিয়ান টুর আয়োজন করা যেত।
এদিকে, গলফ ক্লাবগুলোর পরিচলনায় স্বজনপ্রীতিরও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যেমন অতীতে ফেডারেশনের সকল প্রেসিডেন্টরা তাদের সহপাঠীদের ফেডারেশন এবং ক্লাবগুলোর প্রধান প্রধান পদে বসিয়েছেন। যেমন স্বৈরাচারের প্রধান দোসর জেনারেল তারেক সিদ্দিকীর কোর্সমেট হওয়ায় কর্নেল শহিদুল হককে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের সিইও বানানো হয়। প্রায় ৩ বছর ধরে তিনি সিইও হিসেবে আছেন এবং এখনো তিনি প্রচণ্ড প্রতাপে গলফকে শাসন করে যাচ্ছেন। নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত এমন একজন লোক নতুন বাংলাদেশে কি করে এই পদে এখনো বহাল আছেন তা সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে বিস্ময়কর।
এছাড়া প্রফেশনাল গলফার অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন যথাক্রমে মেজর জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কামরুল। এই দুই জনই বিগত দিনে কর্নেল হাসিন (বীরপ্রতীক), মেজর জিয়া, মেজর জেনারেল কামরুজ্জামানসহ অনেক সেনা অফিসারকে গুম ও জঙ্গি বানানোর মূল কারিগর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তারাই এখনো এই নতুন বাংলাদেশে গলফের হর্তা কর্তা হিসেবে বহাল তবিয়তে আছেন।
সম্প্রতি মেজর জেনারেল জিয়ার কোর্সমেট লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফাকে আনা হয়ছে জিএম হিসেবে। যিনি অতীতে জিয়ার বট বহিনির সিইও হিসেবেও কাজ করেছেন এবং এখনো জলসিঁড়ির বাসাসহ তার (জিয়া) ব্যক্তিগত সকল সম্পত্তি দেখাশুনা করেন ।
গলফ ক্লাবগুলো মূলত বেতনভুক্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই পরিচাললিত হয়। এখানে যারা মালিক অর্থাৎ চাঁদা পরিশোধ করা সদস্য—তাদের কোনো মতামত নেওয়া হয় না। ফলে ক্লাবগুলিতে সবসময় বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় থাকে। সব মিলিয়ে ক্লাবগুলো হয়ে উঠেছে কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার দুর্নীতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশের গলফকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। ফেডারেশনের অধীনে থাকা ক্লাবগুলোকে সত্যিকারের স্পোর্টস ক্লাবে রূপান্তর করতে হবে। ফেডারেশন এবং এর অধীনস্ত ক্লাব ও সংস্থার নিজস্ব গঠনতন্ত্র, কার্যপদ্ধতি ও অর্গানোগ্রাম দ্রুত প্রণয়ন করতে হবে এবং অতি অবশ্যই তা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে অনুমোদিত হতে হবে। ক্লাবগুলোতে প্রতি বছর এজিএম আয়োজনের আওতায় আনতে হবে, যেন সদস্যরা জানতে পারেন তাদের চাঁদা কোথায় খরচ হচ্ছে। ক্লাবগুলোতে টুর্নামেন্টের সংখ্যা কমিয়ে বেশি বেশি জুনিয়র ও প্রফেশনাল টুর্নামেন্ট আয়োজনে মনোযোগ দেওয়া এবং প্রতিবছর অন্তত ৩/৪টি আন্তর্জাতিক পেশাদার ও জুনিয়র টুর্নামেন্ট আয়োজনের চেষ্টা করা।
এ ছাড়া গলফ ইনফ্রাস্ট্রাকচার অর্থ্যাৎ কোর্সের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ হতে পারে। সরকার থেকে প্রণোদনা দেওয়া এবং ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ফেডারেশন ও ক্লাবের অর্গানোগ্রাম অনুমোদনের পর পেশাদার কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া। ফেডারেশনের অধীনস্ত সব সংস্থাকে সশস্ত্রবাহিনীর অন্য মালিকানাধীন বেসামরিক প্রতিষ্ঠান যেমন—আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, সেনা কল্যাণ, ট্রাস্ট ব্যাংক, সেনা ইন্সুরেন্স, সেনা ফার্মেসি ইত্যাদির মতো সরকারি রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের পর্যটন ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে গলফ। আবার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সফল হওয়ার মাধ্যমে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করা যায়। ফেডারেশনের সামান্য সহযোগিতায় গলফার সিদ্দিকুর এককভাবে দুটি এশিয়ান পর্যায়ের শিরোপা অর্জন করেছে এবং অলিম্পিকে সরাসরি খেলার সুযোগ পেয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। তাই একটু যত্ন এবং নজর দিলে গলফের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আরও অনেক সম্মান সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।
সামগ্রিক বিষয়ে ফেডারেশন কর্তৃপক্ষ ও ক্লাব কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে বাংলা আউটলুক। তবে তারা বক্তব্য না দেওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।