
নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রায় এক মাস পার হলেও এখনো সব পাঠ্যবই হাতে পায়নি শিক্ষার্থীরা। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরুর আগেই, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তবে এখনো যে পরিমাণ বই ছাপানোর বাকি, তাতে ঈদের ছুটিতে যাওয়ার আগে সব শিক্ষার্থীর হাতে তাদের সব পাঠ্যবই তুলে দেওয়া বেশ কঠিন হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের সরকারি ছুটির তালিকা অনুযায়ী প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা ২৬ ফেব্রুয়ারি, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ২৫ ফেব্রুয়ারি ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা ২ মার্চ ঈদুল ফিতরের ছুটিতে যাবে। অর্থাৎ ছুটি শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দিতে চাইলে বই ছাপানোসহ আনুষঙ্গিক কাজগুলোও এ সময়ের আগেই শেষ করে শিক্ষার্থীদের কাছে বই পৌঁছাতে হবে। কেননা, প্রেস থেকে বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছাতেই কয়েকদিন লেগে যায়। এরপর শিক্ষা অফিস কিংবা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে সেই বই পাঠানো হয় স্কুলগুলোয়। তারপর বই হাতে পায় শিক্ষার্থীরা। ফলে প্রেসগুলো ঈদের ছুটির আগে সব বই ছাপানোর কাজ শেষ করতে সক্ষম হলেও তা ছুটি শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর সুযোগ নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে ঈদুল ফিতরের ছুটি শেষেই হয়তো সব বই হাতে পাবে শিক্ষার্থীরা।
বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে না পারার কারণ হিসেবে পাঠ্যবই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্য বছরগুলোর তুলনায় এ বছরের পরিস্থিতি ভিন্ন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল ও পাঠ্যবই ছাপানোর রি-টেন্ডারসহ বেশকিছু পরিবর্তন আসে। এরপর পুরোনো শিক্ষাক্রমের বই পরিমার্জনে অনেক সময় ব্যয় হয়। বই নির্ভুল করতে সম্পাদনায়ও যায় অনেকটা সময়। এসব কারণে বই ছাপানোর কাজ শুরু করতেই দেরি হয়ে যায় এবার। এনসিটিবির তথ্য অনুসারে, এবার প্রাকপ্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৪ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটির বেশি বই। এর মধ্যে প্রাথমিকের বই ৯ কোটি ১৯ লাখ ও মাধ্যমিকের ৩০ কোটি ৯৬ লাখ। এসব বইয়ের মধ্যে প্রায় ১ কোটি বই ছাপার কাজ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রাথমিকের ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৪৯২ কপি বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ৭ কোটি ৫৩ লাখ ৬ হাজার ৯৮৮ কপি বই। এর মধ্যে বই সরবরাহের জন্য প্রস্তুত হয়েছে ৬ কোটি ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫০ কপি। সরবরাহের জন্য ছাড়পত্র (পিডিআই) পেয়েছে ৬ কোটি ৭০ লাখ ৭৬ হাজার ৪১৭ কপি বই, যা মোট বইয়ের প্রায় ৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ এখনো ২৭ শতাংশ বই সরবরাহ করা বাকি। ছাপানোর কাজের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই। এই দুই শ্রেণির প্রায় অর্ধেক বই এখনো ছাড়পত্র পায়নি। অন্যদিকে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মাধ্যমিকের ৩০ কোটি বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ১২ কোটি ৯৭ লাখ কপি। এখনো ১৭ কোটির বেশি বই ছাপানো বাকি। সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শতভাগ বই চলে গেছে। তবে ১৩ উপজেলার মধ্যে প্রাকপ্রাথমিকের বই পৌঁছেছে পাঁচটি উপজেলায়। চতুর্থ শ্রেণির বই চার উপজেলায় গেছে ৫০ শতাংশ, বাকি উপজেলাগুলোয় যায়নি।
পঞ্চম শ্রেণির বইও যায়নি। জানতে চাইলে সিলেট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ কালবেলাকে জানান, ‘চাহিদার ৭০ লাখ বইয়ের মধ্যে এসেছে ২১ লাখ, যা মোট বইয়ের ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। মাধ্যমিক ও দাখিলের কিছু বই এলেও ইবতেদায়ীর কোনো শ্রেণির একটি বইও আসেনি। আমরা আশা করছি ফেব্রুয়ারিতে সব বই পেয়ে যাব। এর আগে এনসিটিবির ওয়েবসাইট থেকে বই প্রিন্ট করে পড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে।’ চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম খীসা জানান, জেলায় মোট বইয়ের চাহিদা ১ কোটি ৭৪ লাখ। এর মধ্যে ৫২ লাখের বেশি বই এসেছে, যা মোট বইয়ের ৩০ শতাংশ। এর মাঝে ষষ্ঠ শ্রেণির বেশিরভাগ বই চলে এসেছে। তবে সপ্তম থেকে নবম পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত বই এবং কিছু ক্ষেত্রে গ্রুপভিত্তিক বইগুলো এলেও শারীরিক শিক্ষা, আইসিটির মতো বইগুলো আসতে দেরি হচ্ছে। এ ছাড়া, দশম শ্রেণির বইও অনেকটাই চলে এসেছে।
একই জেলার সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রবিউল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘মোট চাহিদার ৬৩ থেকে ৬৪ ভাগ বই পেয়েছি, যেগুলো বিতরণ করা হয়েছে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির সব বই মোটামুটি দেওয়া হয়েছে। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই পেয়েছি তিনটি করে। আশা করছি দ্রুতই সব বই পেয়ে যাব।’ এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিকের প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ কপি বই ছাপানো হচ্ছে। আর প্রাথমিকের বই ছাপার কাজও এগিয়েছে। এর আগে এনসিটিবির নির্দেশে মাধ্যমিকের বই ছাপার কাজ এগিয়ে নিতে প্রাথমিকের বই ছাপার কাজে গতি কিছুটা কমিয়ে দিয়েছিলেন ছাপাখানা মালিকরা। এনসিটিবির উৎপাদন শাখার এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা বই ছাপার কাজ তদারকির পাশাপাশি মানের দিকটিও দেখছি। মূলত মাধ্যমিকের বই আগে ছাপানোয় কিছুটা দেরি হয়েছে। এখন বই ছাপার গতি ভালো। আশা করছি, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রাথমিকের সব বই চলে যাবে।’
বিতরণ শাখার একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘মাধ্যমিকের বই ছাপানোর কাজে গতি আছে। আশা করছি ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বই দিতে পারব। সেটি কোনো কারণে সম্ভব না হলেও ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বই চলে যাবে।’ তবে সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একেএম রিয়াজুল হাসানের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও সাড়া মেলেনি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলে তা দেখার পরও সাড়া দেননি তিনি। বিল না পেয়ে সংকটে প্রেস মালিকরা: প্রেস মালিকরা বলছেন, এনসিটিবি থেকে বিল না পাওয়ায় তারা সংকটে পড়েছেন। সে কারণে দ্রুত বুঝে পাওয়া কাজের বিল দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। একজন প্রেস মালিক কালবেলাকে বলেন, বই যে প্রক্রিয়ায় সরবরাহ করার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছে না। প্রথমে বলা হয়েছিল তিনটি করে মাধ্যমিকের বই দিতে হবে। সেটিও মানা হয়নি। এরপর দশম শ্রেণির বই আগে দিতে বলল। আগে এক শ্রেণির বই ছাপার কাজ শেষ হলে প্রেস মালিকদের সেটির টাকা দেওয়া হতো। সেই টাকা দিয়ে অন্য বই ছাপার কাজ করা হতো। কিন্তু এবার বলা হয়েছে, ৫০ শতাংশ বই না দিলে টাকা দেওয়া হবে না। এটি প্রেস মালিকদের সংকটে ফেলেছে। কারণ, ব্যাংক মোট কাজের ৬০ শতাংশ টাকা লোন দিয়েছে। এখন লোন চাইলেও পাওয়া যাবে না। প্রেস মালিকরা বিষয়টি এনসিটিবিকে জানিয়েছেন। তারা বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আগে যে কাগজ ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় কিনতাম, সেটি এখন ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। তার পরও বকেয়া টাকা পেলে সমস্যা হবে না।’