Image description
ক্ষমতার পরিবর্তনের পর থেকে জোড়াতালিতে চলছিল বিসিবি

মঙ্গলবার প্রথম সভায় বসেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নতুন কমিটি। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে সেই সভায় গঠিত স্ট্যান্ডিং কমিটির কোনোটিতেই জায়গা হয়নি সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদের, যা কিনা অস্বাভাবিকই ঠেকেছে অনেকের কাছে। অথচ বোর্ড পরিচালনা পর্ষদে নির্বাচিতদের মাঝে এমন অনেকে আছেন, ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে দক্ষতা প্রায় শূন্যের কোঠায়, পরিচিতিও সামান্যতম। অনভিজ্ঞদের নিয়ে গড়া এমন বোর্ডকেই মোকাবিলা করতে হবে ঘরোয়া ক্রিকেটে শক্ত এক প্রতিপক্ষকে। যারা কি না এরই মধ্যে নতুন কমিটির অধীনে ক্রিকেট বর্জনের ডাক দিয়েছে। বিসিবির নতুন এই পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে আগামীতে সেই পক্ষের সংঘাত এখন অনিবার্য। আর তাতে ক্ষতিটা যা হওয়ার, সেটা হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটেরেই—মানছেন ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা সবাই। এরই মধ্যে দেশের প্রভাবশালী ক্রিকেট ক্লাবগুলোর বয়কটের ডাকে ঘরোয়া ক্রিকেটে অশনিসংকেত দেখছেন তারা। সর্বোপরি মহাবিতর্কিত বিসিবি নির্বাচন প্রক্রিয়ার ক্রীড়ামোদী সবাই হয়েছেন ক্ষুব্ধ। বিসিবি নির্বাচনে ক্যাটাগরি-৩ থেকে পরিচালক পদে নির্বাচন করে হেরে যাওয়া প্রার্থী দেবব্রত পাল তো অভিযোগ করে বলেন, ‘এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ক্রীড়া প্রশাসনের সবাই জড়িত। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সবকিছুই হয়েছে তাদের মতো করে। এতেই স্পষ্ট, দেশের ক্রিকেটের অবস্থানটা কোথায়, যাচ্ছেই বা কোনদিকে, সেটি বিবেচনার সময় এসেছে।’ ঢাকা বিভাগের হয়ে নির্বাচনের প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদুয়ান তো এবারের বিসিবির নির্বাচনকে ‘আলোচিত রাতের ভোট’কেও হার মানিয়েছে বলে মন্তব্য করেন।

দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে নজিরবিহীন বিতর্কিত সব ঘটনার সাক্ষী হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন। একের পর এক ঘটে যাওয়া সব ঘটনার মধ্য দিয়ে ভোট সম্পন্ন করে ২৫ পরিচালক পেয়েও অস্বস্তি কাটাতে পারছে না দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিবি। দেশের ক্রীড়া প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদের প্রমাণসহ বিরোধী পক্ষের গুরুতর সব অভিযোগ মাথায় নিয়ে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নেতৃত্বে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আবার নতুন নাটক জমে উঠেছে। নির্বাচন চলাকালে ভোটার তালিকায় পরিবর্তনের মতো নজিরবিহীন ঘটনাও ঘটেছে। এরপর নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) থেকে বিসিবি পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয় ইশফাক আহসান নামের এক ব্যবসায়ীকে, যা এককথায় নজিরবিহীন। পরে অপরিচিত সংগঠক ইশফাক সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত আওয়ামী সরকারের সমর্থক ইশফাক আহসান ছিলেন যুবলীগের সক্রিয় সদস্য। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটিতেও কাজ করেছেন তিনি। চেয়েছিলেন গত সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন। এসব তথ্য ফাঁস হতেই তোলপাড় পড়ে যায় সরকারি মহলে। ফলে তার মনোনয়ন বাতিল করার ঘোষণা দেয় এনএসসি। সবশেষ বিতর্কের তালিকায় যোগ হয়েছে আরও এক নির্বাচিত পরিচালকের নাম। নারী নির্যাতনের সেই মামলা চুকে গেলেও তার রেশ সামনে টেনে এনেছে একটি পক্ষ।

নতুন পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভায় স্ট্যান্ডিং কমিটি ঘোষণার পর দেখা গেল আরেক নাটকীয়তা। ২৩ কমিটির দায়িত্বে ২৩ পরিচালক থাকলেও নেই সাবেক প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদ! আমিনুল ইসলামের তৈরি খসড়া স্ট্যান্ডিং কমিটিতে বাংলাদেশ টাইগার্সের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। কিন্তু অজানা কারণে কমিটি করেন প্রেসিডেন্ট আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ২৩ কমিটির কোথাও নেই তার নাম। এত এত বিতর্কিত ঘটনার নির্বাচনকে ‘অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমিনুল হক। তার দাবি, ‘সরকারি হস্তক্ষেপের প্রমাণ রয়েছে। এই অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে দেশের ক্রিকেট ভবিষ্যতে অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।’

অভিজ্ঞ ক্রীড়া সংগঠক ও নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারকারীদের নেতা রফিকুল ইসলাম বাবুর মতে, নির্বাচনের নামে বিসিবিতে এবার যা হলো, তাতে কলঙ্কিত হয়েছে ক্রিকেট। ই-ভোটের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। নির্বাচনে ৮৫ শতাংশ পড়েছে ই-ব্যালটে। আবার নির্বাচনের দিন ই-ভোট দেওয়া সবাইকেই দেখা গেছে ভোটকেন্দ্রে। যদি তারা কেন্দ্রেই আসতে পারলেন, তাহলে কেন ই-ভোট দেবেন—এ প্রশ্ন রেখে ক্লাব সংগঠক পরিষদের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের ক্রিকেট উন্নয়নে সবচেয়ে বড় অংশীজন ঢাকার ক্লাব। এবার তাদের সঙ্গে নিশ্চিতভাবে প্রতারণা করা হয়েছে। আমরা সেই প্রতারণার শিকার। নির্বাচনে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় বড় স্টেকহোল্ডার আবাহনী, মোহামেডান, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের মতো প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোকে বিসিবি থেকে দূরে রাখা হয়েছে। তাদের কূটকৌশল আর নোংরামির কারণে আমরা নির্বাচন বয়কট করেছি।

গত বছরের ৫ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে জোড়াতালির মাধ্যমে চলছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ৭ অক্টোবরের মধ্যে বিসিবি নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা ছিল বোর্ডের। ১ সেপ্টেম্বর সিলেটে হওয়া এক বোর্ড সভা শেষে জানানো হয়েছিল, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই হবে বিসিবি নির্বাচন। এখান থেকেই নির্বাচনী নাটকীয়তার শুরু। ১৪ সেপ্টেম্বর নির্বাচন সামনে রেখে কাউন্সিলরদের নাম পাঠানোর সময়সীমা বৃদ্ধি করে বিসিবি। ১৮ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলরদের ফরম বাতিল করে নতুনভাবে পাঠাতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং জেলা-বিভাগের ক্রীড়া সংস্থা বরাবর চিঠি পাঠান বিসিবি প্রেসিডেন্ট আমিনুল ইসলাম বুলবুল। পরদিনই প্রেসিডেন্টের এমন চিঠি গ্রহণ না করতে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাকে চিঠি দিয়েছিলেন বাংলাদেশ জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠকরা। কিন্তু সেটা আর মানা হয়নি। বিএনপি নেতা আমিনুল ইসলামের অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে প্রভাব ছিল সরকারের, ‘বিসিবি সমগ্র বাংলাদেশের, এটি কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি নয়। সরকার কার্যত বিসিবিকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। আমি শুনে অবাক হয়েছি যে ক্রীড়া উপদেষ্টার পক্ষ থেকে বিভিন্ন কাউন্সিলরকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেক কাউন্সিলর আমাকে ফোন করে বলেছেন যে তাদের ডেকে নিয়ে এভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে।’

নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর আরও নাটকীয়তার দেখা মিলেছিল। নির্ধারিত সময়ে কাউন্সিলর তালিকা প্রকাশে বিলম্ব হওয়ায় নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। এরপর নির্ধারিত সময়ের আড়াই ঘণ্টা পর প্রাপ্ত একটি নাম কাউন্সিলর তালিকায় শুধু যোগই করেননি, তাকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়েছে। আরও বড় নাটকীয়তার দেখা মেলে খসড়া ভোটার তালিকায়। নির্বাচন কমিশন সে তালিকায় রাখেনি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পর্যবেক্ষণ থাকায় ১৫টি ক্লাবের কাউন্সিলরদের। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করলে তা আবার ফিরিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন। এরপর আবারও নাটক। এবার সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদ ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে এ নিয়ে এক রিট করলে দ্বিতীয় দফা আটকে যায় ১৫ ক্লাবের কাউন্সিলরশিপ ও প্রার্থিতা। নজিরবিহীনভাবে ভোটের ঠিক ২০ ঘণ্টা আগে আবার কাউন্সিলরশিপ ফিরেও পায় ১৫ ক্লাব। নাটকীয়তার পর নাটকীয়তা। চরম অনিশ্চয়তার পর ভোটগ্রহণ হলেও দেখা যায় আরেক নাটকীয় ঘটনা। ভোটের লড়াই শেষে বিসিবিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন ২৩ পরিচালক। এর মধ্যে ১৫৬ জনের ভোট দেওয়ার কথা থাকলেও বর্জন করে বিরত ছিলেন ৪১ জন। ১১৫টি ভোট পড়লেও এর মধ্যে ই-ভোটই দেন ৮৫ শতাংশ কাউন্সিলর। কিন্তু ভোটের দিন আবার তাদের দেখা মিলেছে নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত হোটেলেও। এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে রফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘যে প্রক্রিয়ার নির্বাচন হয়েছে আমরা তা মানি না, দেশের জনগণও মানবে না। আমরা বৃহৎ কর্মসূচিতে যাব। আজ সেই কর্মসূচি ঘোষণার জন্য আমরা বসব।’ অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলে সে কথাই জানালেন ক্লাব ক্রিকেটের সংগঠকদের একাংশ। আজ সংবাদ সম্মেলন করে তারই ঘোষণা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ক্লাবগুলোর সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বাবু।