Image description

বাংলাদেশের ক্রিকেটে লম্বা সময় ধরে লেগস্পিনারের জন্য হাহাকার ছিল। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে সেই আক্ষেপ কিছুটা প্রশমিত করেছেন রিশাদ হোসেন। তবে এর বাইরে ক্রিকেটীয় পাইপলাইনে খুব একটা লেগস্পিনারের দেখা মেলে না। হাতেগোনা কয়েকজনের তালিকায় থাকা একজন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটার স্বাধীন ইসলাম। 

বাংলাদেশ যুব দল সম্প্রতি জিম্বাবুয়েতে ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতে এসেছে। সেখানে স্বাগতিক দেশটির পাশাপাশি প্রতিপক্ষ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাও। ওই সিরিজে স্বাধীন ১২ উইকেট শিকার করেন। একটি অনুশীলন ম্যাচেও নিয়েছিলেন ৬ উইকেট, সবমিলিয়ে তার ঝুলিতে উইকেট ১৮টি।

নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার, লালমনিরহাট থেকে যুব দলে যুক্ত হওয়া, রোজা রেখেও একদিনে ৫০০ বল করাসহ নিজের অধ্যাবসায়ের কথা ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদক সাকিব শাওনের কাছে তুলে ধরেছেন স্বাধীন। 

ক্রিকেটে পথচলার শুরুটা যেভাবে

আমি ২০১৮ সাল থেকে ক্রিকেট বলে অনুশীলন করতাম। প্রথমে জেলা পর্যায়ে ট্রায়াল দিই অনূর্ধ্ব-১৪ তে। তারপর শুরু হয় করোনা মহামারি, পরে ২০২২ সালে সরাসরি ‘এ’ দলের হয়ে রংপুর ডিভিশনে খেলেছি। সেখানে ৬ ম্যাচে ২৫ উইকেট পেয়েছিলাম, সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিও হই আমি।

পরের বছর আবার ভালো পারফর্ম করি। পরপর দুই বছর ইয়ুথ লিগে ভালো বোলিং করায় ডাক পাই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্পে। সব জায়গায় ভালো হচ্ছিল বোলিং, গত বছর প্রথমবার যুব দলের হয়ে আরব আমিরাতের বিপক্ষে সিরিজ খেলার সুযোগ আসে। যদিও সেখানে ভালো করতে না পারায় দল থেকে বাদ পড়ে যাই। ফলে এশিয়া কাপসহ আর কোথাও সুযোগ পাইনি।

আবারও যেভাবে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে প্রত্যাবর্তন

চলতি বছর ডিপিএলে ভালো করেছি, লিজেন্ড অব রূপগঞ্জের হয়ে তিন ম্যাচে ৬ উইকেট পেয়েছিলাম। বড় বড় দলের বিপক্ষে ভালো খেলার কারণেই মূলত আবারও যুব দলে আসতে পেরেছি। যদিও ছিলাম না শ্রীলঙ্কা সিরিজে। পরে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ ও ত্রিদেশীয় সিরিজের দলে ডাকা হয়। আলহাদুলিল্লাহ, এখন আমার লক্ষ্য আরও কীভাবে ভালো করা যায়।

রোজার দিনেও ৫০০ বলের অনুশীলন

আমার জীবনে আসলে অনেক কষ্ট ছিল। অনেক স্ট্রাগল ছিল, যা কাটাতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। ৬-৭ বছর ধরে আমি অনুশীলন করেছি। প্রচুর বোলিং করতাম একাডেমিতে, অনুশীলনে সময় দিতাম অনেক। এমনও হয়েছে যে, রোজার মাসে আমি দিনে ৫০০টি করে বল ড্রিল করতাম, রোজা রাখা অবস্থায়। আমার দুই হাতের আঙ্গুল দুই রকম, বোলিং করতে করতে এমন বদলে গেছে।

লালমনিরহাট থেকে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে যাত্রা

লালমনিরহাটের অনেক প্রত্যন্ত এলাকা তুষভান্ডার। যেখানে খেলার মতো সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। কোনো ধরনের সাপোর্টই নেই বলা যায়। এমনকি মানুষরাও সেভাবে সমর্থন দিতো না। এলাকার লোকজন আমাকে অনেক খোঁচা মারতো। আমি না খেয়ে প্র্যাকটিস করতাম দেখে কেউ বলত পাগল, আবার রোজা রেখে অনুশীলনের জন্য কথাও শুনতে হয়েছে।

বাড়ি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অনুশীলন করতে যেতাম। ট্রেনে সকাল ৭টায় যেতাম, রাতে আবার চলে আসতাম। সারাদিন অনুশীলন করতাম, অনেক অনুশীলন করেছি। এমনও হয়েছে ট্রেন কোনোদিন ছাড়তে রাত ১২/১টা বেজে গেছে। ফলে ট্রেনের ভেতর আমি ঘুমিয়ে গেছি। আসলেই অনেক কষ্ট করেছি এতটুকু আসতে।

যাদের সমর্থন পেয়েছেন শুরুতে

পরিবার থেকে আসলে শুরু থেকে ওরকম কোনো সাপোর্ট ছিল না। আমার এক মামা প্রচণ্ড অনুপ্রাণিত করতো। উনার কথায় খুব অনুপ্রাণিত হয়েই শুধু আমি অনুশীলন করতাম। ঝড়-তুফান যাই হোক না কেন, আমি আমার অনুশীলন করেছি। আমার অনুশীলন লাগবেই। এরপর যখন ভালো করা শুরু করেছি, তখন সাপোর্ট করছে সবাই। আমার একাডেমিক জেলা কোচের অনেক অবদান। আলাদা করে আসলে কারও নাম বলতে চাই না, আমার জীবনে সবারই অনেক অবদান রয়েছে। 

আর্থিক সংকটে কাজ করেছেন রাজমিস্ত্রী হিসেবেও

এমন কোনো কাজ নেই যা আমি করিনি। কমবেশি সব কাজই করেছি। রাজমিস্ত্রির কাজ বলেন, আর টাইলস অথবা ধান মাড়াইয়ের কাজ। আমার বাবা অটো চালায়, আমিও সেটা চালিয়েছি। বাজারের সবজি দোকান আছে আমার ভাইয়ের সেখানেও বসেছি। অনেক ঝড়-ঝপটা পেরিয়ে আমি এখানে এসেছি। পরিবারকে সাহায্য করতে এখন নিজে চেষ্টা করছি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো চলছে। এর বাইরে আমার এমনও দিন গেছে যে রাতে ঘুমাইনি, ইউটিউব দেখতাম। কীভাবে বোলিং আরও ভালো করা যায়, ভিডিও দেখতাম শেন ওয়ার্নের। আমি নিজে অনেক এনালাইসিস করেছি আমার বোলিং নিয়ে।

যেভাবে লেগস্পিনের শুরু

যখন টেপ টেনিসে এলাকায় বোলিং করতাম, তখন কিছুটা লেগস্পিনারের মতো হতো। তাই এলাকার বড় ভাইরা ডাকতো ইমরান তাহিরের নামে, যদিও আমি তাকে চিনতাম না। এরপর যখন একাডেমিতে ভর্তি হই, সেখানেও একইভাবে বল করেছি কোচের সামনে। এরপর থেকে সেভাবে (লেগস্পিন) বোলিং করছি। তবে আমি সেভাবে কাউকে ফলো করি না। নিজেই কীভাবে আইডল হব সেটা ভাবি। আমি নিজেকে এমনভাবে তৈরি করব যে নিজের লেভেল অন্যমাত্রায় নিয়ে যাব। আমি সবাইকে ফলো করি, সবার বোলিং দেখি কীভাবে করতেছে।

জার্সির নম্বর কেন ১৯

জার্সি নম্বর ১৯ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল ছোটবেলা থেকেই। অনেক ছোট থাকতেই প্রথম লক্ষ্য ছিল নাইন্টিন নিয়ে খেলা। ১৯ নম্বর জার্সিটা দেখলে যেন আমি বলতে পারি যে আমাকে দলে ঢুকতে হবে। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলার কথা সবসময়ই মাথায় ছিল।

স্বাধীন নিজেকে চেনাতে চান বড় মঞ্চে

সামনে এশিয়া কাপ ও যুব বিশ্বকাপ। সেখানে অন্য লেভেলের পারফর্ম করতে চাই। আমি যেন ডমিনেট করতে পারি বাংলাদেশের হয়ে। আসলে বিশ্বকাপে ভালো করতে চাই। জাতীয় দলের খেলার চিন্তা অবশ্যই আছে। যদি বিশ্বকাপে ভালো করতে পারি এবং এরপর বিপিএলে দল পাই। প্রসেস অনুযায়ী বিপিএলে ভালো করে জাতীয় দলের ঢোকার চিন্তা রয়েছে।

জাতীয় দলের খেলার চিন্তা অবশ্যই সবার থাকে। আর যেসব কোচের সঙ্গে কথা হয়েছে তারাও আমাকে এভাবে বলেছেন। সালাউদ্দিন স্যার, সোহেল স্যার তারা বলেছেন– ভালো করছি, পাশাপাশি আমাকে ব্যাটিংয়ে ভালো করতে জোর দিয়েছেন। এভাবে কনফিডেন্স পেয়েছি। এ ছাড়া তালহা জুবায়ের স্যারও আরও কিছু বিষয়ে বলেছেন। তার মতে– আমি যথেষ্ট ম্যাচিউর হয়েছি, এখনই জাতীয় দল নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এখন লক্ষ্য বিশ্ব ক্রিকেটেও কীভাবে বাংলাদেশের হয়ে ডমিনেট করা যায়। 

ক্রিকেটকেই ধ্যান-জ্ঞান বানাতে চান স্বাধীন

আমার চিন্তা সাকিব ভাই যেরকম করেছে এরকম ভিন্ন কিছু একটা করব। শুধু জাতীয় দলে খেলব এমন না, ভিন্ন লেভেলের কিছু করার খেয়াল। অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছি, এমনকি ঈদের দিনও আমি সকালে ফজরের পর অনুশীলন করে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছি। এই কথাটা আমি কখনোই কাউকে বলিনি। নিজের পরিশ্রম দিয়ে চেষ্টা করছি, এখন বাকিটা আল্লাহ ভরসা। ঈদের দিনও প্র্যাকটিস করেছি মানে আমার জীবনে ক্রিকেট ছাড়া কিছু নাই। পড়াশোনাটা করিনি সেভাবে। ক্রিকেটেই আমাকে সবকিছু করতে হবে।