Image description

'যতদিন মিরাজ খেলবে, ততদিন মোসাদ্দেকের সুযোগ নেই।' প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর এই বক্তব্যটা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল। আবারও প্রশ্ন উঠল জাতীয় দলের দল নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে। কিন্তু যাকে নিয়ে এই মন্তব্য, সেই মোসাদ্দেক হোসেন নিজে কীভাবে নিলেন ব্যাপারটা? দ্য ডেইলি স্টারের আবদুল্লাহ আল মেহদীকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ৮০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা এই ২৯ বছর বয়সী অলরাউন্ডার খোলাখুলি বললেন নিজের অভিজ্ঞতা।

দ্য ডেইলি স্টার: মিডিয়ায় মন্তব্য দেওয়ার পর প্রধান নির্বাচক আপনাকে কী বলেছিলেন?

মোসাদ্দেক হোসেন: হ্যাঁ, আমি টেলিভিশনে ওনার বক্তব্য শুনেছি (৯ জুলাই)। তবে চট্টগ্রামে এসে তিনি সরাসরি আমাকে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, তার মন্তব্যটা মূলত টেস্ট দল নিয়ে ছিল। তিনি বলেন, আমি যেন মন খারাপ না করি, আমি নির্বাচকদের বিবেচনায় আছি।

আপনি বুঝতেই পারছেন, আমি তখন মানসিকভাবে খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম। তার মতো একজন সিনিয়র ব্যক্তি এসে সরাসরি কথা বললে, আমার পক্ষে কিছু বলার থাকে না।

ডেইলি স্টার: আপনি প্রথমে মিডিয়া থেকেই জানতে পারলেন? কেমন লেগেছিল?

মোসাদ্দেক: আসলে প্রথম জানতে পারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে। সেদিনই আমাদের একটি প্র্যাকটিস ম্যাচ ছিল, যেখানে নাথান কেলি ক্যাম্প পর্যবেক্ষণ করছিলেন (শ্রীলঙ্কা সিরিজের জন্য)। আমি মোটামুটি ভালো বোলিং করেছিলাম। কিন্তু এরপরের ম্যাচে শরীর মাঠে থাকলেও মন ছিল না। ওই খবরটা দেখে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম… অন্য কোনো খেলোয়াড়কে এভাবে নিয়ে এমন কথা বললেও খারাপ লাগত।

একজনকে আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করাটা কখনোই ভালো না। এতে খেলোয়াড়দের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। অথচ মিরাজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো। আমরা বহুদিন ধরে একসঙ্গে খেলছি। রিয়াদ ভাই, মিরাজ আর আমি বহু ম্যাচে একসঙ্গে খেলেছি।

আমি নাসির ভাই, রিয়াদ ভাইয়ের সঙ্গে খেলেছি, আবার রিয়াদ ভাই, শুভাগত ভাইয়ের সঙ্গে খেলেছি। এমনকি সাম্প্রতিক সিরিজেও শান্ত, মিরাজ আর শামীম বোলিং করেছে। তাই আমার প্রশ্ন, তাহলে আসলে কী ঘটল? আমি কী করতে পারি এমন পরিস্থিতিতে?

ডেইলি স্টার: আপনি তো এবারের প্রিমিয়ার লিগে ব্যাটে-বলে দারুণ করেছেন, বিশেষ করে ফাইনালে। জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার আশা করেছিলেন?

মোসাদ্দেক: এটা আসলে অনেক বড় গল্প। আবাহনী কিংবা মোহামেডান সবসময় শক্তিশালী দল গড়তে চায়। তাই তারা পারফরম্যান্স ও ধারাবাহিকতা চায়। আমি তো এমনি এমনি ১৩ বছর ধরে আবাহনীতে খেলছি না।

আবাহনী নিশ্চয়ই কিছু দেখেছে বলেই আমাকে রেখেছে। এ বছরও সময়টা কঠিন ছিল। ৪০-৬০ শতাংশ কম পারিশ্রমিকে খেলতে হয়েছে। বেশির ভাগ খেলোয়াড়দের জন্য এটা তো প্রধান আয়ের উৎস। নিরাপত্তাও কম ছিল। এমন পরিস্থিতিতে প্রিমিয়ার লিগ খেলে আমি স্বাভাবিকভাবেই মনে করেছিলাম, হয়তো একটা সুযোগ পাব। কিন্তু ঐ মন্তব্যটা শোনার পর শুধু আত্মবিশ্বাস নয়, আমার আগ্রহও অনেকটা কমে গেছে।

ডেইলি স্টার: মনে হয়েছিল জাতীয় দলে আর ফিরতে পারবেন না?

মোসাদ্দেক: হ্যাঁ, ওরকমই মনে হয়েছিল। আমি কি চাইব মিরাজ খারাপ খেলুক? সে তো এখন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। আমাদের ভূমিকা আলাদা। সে তো আমার ছোট ভাইয়ের মতো। আমি তো শত্রুকেও খারাপ চাই না, সেখানে মিরাজ তো অনেক কাছের একজন।

ডেইলি স্টার: আপনি তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ছিলেন, যখন বিশ্বকাপ স্কোয়াড গঠন হচ্ছিল। কিন্তু তখনও দলে সুযোগ হয়নি কেন?

মোসাদ্দেক: ব্যাপারটা ছিল আমার পজিশন নিয়ে। আমি সাধারণত ৬-৭ নম্বরে ব্যাট করি, কিন্তু তখন ৭-৮ নম্বরে নামতাম। ২২-২৫ জনের একটা তালিকা থাকে, সেখান থেকে দল নির্বাচন হয়। আমার ভূমিকা ছিল অলরাউন্ডারের। কোনো দিন ৪৮তম ওভারে ব্যাট করতে হতো, আবার কোনোদিন ২৭তম ওভারে।

শেষ সিরিজে আমি মনে করি, দলের চাহিদা অনুযায়ী বল করেছি এবং একটা প্রভাব রেখেছি। আপনারা যদি বলেন যে আমার পারফরম্যান্স যথেষ্ট নয়, তাহলে না রাখাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্তত বলা তো উচিত, এই পজিশনের জন্য আপনাকে ভাবা হচ্ছে না।

ডেইলি স্টার: কেউ আপনাকে কিছু বলেননি?

মোসাদ্দেক: না, কেউ কিছু বলেননি। ধরুন, অফ-স্পিনিং অলরাউন্ডার নিয়ে বলি, মিরাজ আর রিয়াদ ভাই খেলেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপে রিয়াদ ভাই কয় ওভার বল করেছেন? (৮ ম্যাচে মাত্র ৪ ওভার)। যদি তখন বলা হতো, আমরা এমন দুজন অলরাউন্ডারকে নিচ্ছি যাদের ব্যাটিং-বোলিং দুইদিকেই বিশ্বাস আছে, কিন্তু রিয়াদ ভাই কম বোলিং করছেন, তাহলে এমন একজনকে না নেওয়া যে নিয়মিত পারফর্ম করে, তার ব্যাখ্যা তো থাকা উচিত।

সেই সময় কোনো ব্যাখ্যাই পাইনি। বরং যদি বলা হতো, 'একজন খেলছে, তাই তোমার সুযোগ নেই'। সেটাও একটা পরিষ্কার ব্যাখ্যা হতো। অন্তত বুঝতাম কেন আমি দলে নেই।

ডেইলি স্টার: আপনি কি কখনো সরাসরি নির্বাচকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?

মোসাদ্দেক: বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখনো এমন সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি যে একজন খেলোয়াড় সরাসরি নির্বাচকের সঙ্গে কথা বলবে বা তারা নিজে থেকে ব্যাখ্যা দেবেন। হয়তো দু-একটা ব্যতিক্রম উদাহরণ আছে, কিন্তু আমি কখনো পাইনি। অথচ অনেক সময় খেলোয়াড়দের ইনপুটও কাজে লাগতে পারে। কিন্তু আমরা সবসময় তথ্য পাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেই।

ডেইলি স্টার: এখন আপনি মনে করছেন নির্বাচকদের নজরে আছেন?

মোসাদ্দেক: আমি খুব বিভ্রান্ত। ভারতের বিপক্ষে আগস্টের সিরিজটা বাতিল হয়ে গেছে। বছরের শেষ দিকে কিছু সিরিজ আছে, কিন্তু কোনো ওয়ানডে নেই। তাহলে এই ছয় মাসে আমার করণীয় কী?

আগস্ট ৬ থেকে ১৬ তারিখে আমেরিকায় 'সিক্সটি স্ট্রাইকস টুর্নামেন্ট' আছে। সেখানেই সাকিব ভাইও খেলবেন, আমাদের একই দলে ডেট্রয়েট ফ্যালকনস। যদি বোর্ড অনুমতি দেয়, আমি এমন টুর্নামেন্টগুলো খেলতে চাই। আরও কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আছে, সেগুলোতেও সুযোগ পেলে খেলব। খেলারই তো কথা। এতে নতুন কিছু শেখা যাবে। আগে তো আমাদের খেলোয়াড়রা বিদেশে কম খেলত, এখন রিশাদ, তানজিম সাকিবরা খেলছে। এটা ভালো দিক।

ডেইলি স্টার: দলের মিডল অর্ডার আর নিজের সম্ভাবনা নিয়ে কী ভাবছেন?

মোসাদ্দেক: দেখুন, রিয়াদ ভাই আর মুশফিক ভাই চলে গেছেন। এমন সময় সব দলে আসে। শ্রীলঙ্কাতেও এসেছে। সময় লাগে। কিন্তু যারা এখন খেলছে, তারা তো ৩০-৪০ ম্যাচ খেলেছে। তাদের বুঝতে হবে যে এখন দায়িত্ব নেওয়ার সময়। হুট করে কিছু হয় না, শুরুটা করতে হবে।

এই কঠিন সময়টা আমরা পার করব ইনশাআল্লাহ। মিরাজ এখন পাঁচ নম্বরে ব্যাট করছে এবং ওর অভিজ্ঞতাও আছে। ও যদি হাল ধরে রাখতে পারে, তাহলে বেশি সময় লাগবে না আবার ঘুরে দাঁড়াতে, কারণ ওয়ানডেতে আমরাই সবচেয়ে আত্মবিশ্বাসী দল ছিলাম।

ডেইলি স্টার: ওয়ানডে ক্যারিয়ার নিয়ে সংক্ষেপে কী বলবেন?

মোসাদ্দেক: আমি নিজের জায়গা থেকে চেষ্টা করি। কিন্তু নির্বাচনের বিষয়টা তো আমার হাতে নেই। আমাকে না নিলে কি আমি ক্রিকেট ছেড়ে দেব? না, আমি লড়ব, ভালো খেলার চেষ্টা করব, আবার ফিরে আসার চেষ্টা করব। যদি কপালে থাকে, তাহলে হবেই, নইলে বলব আমি পারিনি।