Image description
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণায় তৃতীয় পক্ষ!

ভারতে পলাতক মাফিয়া নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন টিপু মুনশি। বর্তমান কারাগারে এই টিপু মুনশিকে ঘিরে রংপুরে গড়ে উঠেছিল বিশাল নেটওয়ার্ক। আওয়ামী লীগের শাসনামলে তারাই থানা, উপজেলা পরিষদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের বেশির ভাগই উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) সাথে যুক্ত ছিলেন। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত ও শেখ হাসিনা পালানোর পর টিপু মুনশিসহ কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হন। এক সময়ের দুর্দান্ত প্রতাবশালী নেতা ও ব্যবসায়ী নেতারা পর্দার আড়ালে চলে যান। দীর্ঘদিন পর্দার আড়ালে থাকা নেতাদের কেউ কেউ ‘রাজনীতিকে ছুটি’ দিলেও এখন প্রকাশ্যে আসছেন। টিপু মুনশির রংপুর-৪ (পীরগাছা-কাউনিয়া) এলাকার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার সাথে কথা হয়।

তারা জানান, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কাফ্ফারা দিচ্ছেন। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে থেকে উপজেলা পর্যায়ে উঠে আসা আওয়ামী লীগের এক নেতা বললেন, হাসিনার নেতৃত্বে রাজনীতি করে যে ভুল করেছি; সেটার কাফফারা দিতেই জামায়াতের ফরম পূরণ করেছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চারজন নেতা জানান, তারা মনে করেন- শেখ হাসিনা তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। দলের নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে রেখে তিনি নিজ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। ভারতে পালিয়ে থেকে এখন হুঙ্কার দিচ্ছেন, নেতাদের রাজপথে নামার নির্দেশনা দিচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছেÑ সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ৫ আগস্ট রাজপথে নামবে। বাস্তবতা হচ্ছেÑ আওয়ামী লীগের পক্ষে রাস্তায় মিছিল নিয়ে নামবে, এমন পরিস্থিতি নেই। যারা আওয়ামী লীগ করতেন তাদের অনেকেই বিএনপিতে যাচ্ছেন; কেউ কেউ নীরবতা পালন করছেন। অনেকেই ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। তবে বেশির ভাগ নেতাই এলাকা ছেড়ে ঢাকায় আত্মগোপন করে রয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণায় কোনো নেতাই হাসিনার নির্দেশনা মানবে না। রংপুরে ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করেন এমন কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী জানান, উত্তরাঞ্চলের উপজেলা, জেলা পর্যায় দূরের কথা, বিভাগীয় শহরে আওয়ামী লীগের ব্যানারে মিছিল করবেÑ এমন ১০ জন নেতাকর্মী খুঁজে পাওয়া যাবে না; বরং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১৪শ ছাত্র-জনতার মৃত্যুর পরও শেখ হাসিনা নিজের ভুল স্বীকার করে অনুশোচনা না করায় তারা বিক্ষুব্ধ। দু’জন সাংবাদিক জানালেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ব্যবসায়ী নেতাদের বেশির ভাগই জার্সি বদল করেছেন। কেউ কেউ বিএনপির দিকে ভিড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন তারাও অবর্ণনীয় দুর্দশায় রয়েছেন, এমন বার্তা দিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে বিএনপিতে যোগদানের চেষ্টা করছেন।

রংপুরের মতোই সারা দেশেই প্রায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির অভিন্ন চিত্র। গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, শরীয়তপুর জেলাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে থাকলেও অন্যান্য জেলায় দলটির সাংগঠনিক মেরুদ- ভেঙে গেছে। কিছু ইউটিউবার, ব্লগার, কন্টেন ক্রিয়েটর, গণমাধ্যমকর্মী, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘আওয়ামী লীগ আসছে’ প্রচারণায় ঝড় তুললেও বাস্তব চিত্র একেবারে ভিন্ন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে- বিদেশে পালিয়ে থাকা সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা সেখানে থেকে জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের বিগ্রেট গঠন করেছেন। তাদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে।

৫ আগস্ট ঢাকা ঘেরাওয়ের লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করা হচ্ছে। এসবই প্রচারণা। বাস্তবে হাসিনা পালানোর পর আওয়ামী লীগের যে সব নেতা বিদেশে যারা পালিয়ে গেছেন সেখানেও তারা ভালো নেই। বিশেষ করে মোদি সরকার দিল্লিতে শেখ হাসিনাকে ভালোভাবে রাখলেও আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা সেখানে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না। কয়েক দিন আগে দিল্লিতে আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু চাপের মুখে বিজেপি সরকার সে সংবাদ সম্মেলন করতে দেয়নি। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী আওয়ামী লীগ নেতাদের ভারতে আশ্রয় দেয়ার মোদি সরকারের কড়া সমালোচনা করেছেন। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো খবর প্রচার করছে, ভারতে পলাতক আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-এমপি-ছাত্রনেতা-যুবনেতা মিলে কয়েকশ নেতা আসেন, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খ-, উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসায় পুলিশি গ্রেফতার এড়ানোর নিশ্চয়তা দিয়ে বাড়ির মালিকরা দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। গণভবনে শেখ হাসিনার এক সময় এপিএস ছিলেন পরবর্তীতে এমপি হন এমন একজন বিদেশ পালানো সাবেক এমপি সম্প্রতি পরিচিত গণমাধ্যমকর্মীকে ফোন করেছিলেন।

তিনি জানান, টাকা পয়সার সমস্যা না হলেও বিদেশে যারা পালিয়েছেন তারা খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। কেউ কেউ এমন পরিস্থিতির জন্য হাসিনাকে দায়ী করছেন। কেউ কেউ বিএনপি ও জামায়াতের সাথে পর্দার আড়ালে সমঝোতা করে দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন। আবার অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। নাম প্রকাশে ওই নেতা জানান, শেখ হাসিনা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দেশে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের সংগঠিত হওয়ার নির্দেশনা দিলেও বাস্তবতা ভিন্ন। পলাতক নেতাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করবেন না- এমন বক্তব্য দিচ্ছেন এবং হাসিনার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে সব প্রচারণা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ৫ আগস্ট ঘিরে সংগঠিত হচ্ছে, এসব ফেইক প্রচারণা। ওইসব প্রচারণার সঙ্গে বিদেশে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পর্ক নেই। উত্তরাঞ্চলের একটি আসনের এমপি ছিলেন বর্তমানে আসামে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন এমন একজন আওয়ামী লীগ নেতা একজন সাংবাদিককে জানান, তিনি মনে করেন- আওয়ামী লীগ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবে এমন প্রচারণা সোশ্যাল মিডিয়ায় তৃতীয় কোনো পক্ষ ছড়াতে পারে। রাজনৈতিক কৌশলের কারণে তারা এমনটি ছড়াতে পারে। কারণ জাতিসংঘের তদন্তে ১৪শ মানুষকে হত্যা করে শেখ হাসিনা পালিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে হত্যা ও দুর্নীতির কয়েকটি মামলার বিচার দ্রুত গতিতে চলছে। এমন অবস্থায় হাসিনা দেশে ফিরবেন বা আওয়ামী লীগ নেতার নির্দেশে আন্দোলনে মাঠে নামবেÑ এমন এটি দিবাস্বপ্ন; বরং যারা বিএনপিকে ঠেকিয়ে আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, সেই এনসিপি ও জামায়াত নির্বাচনে পেছানোর লক্ষ্যে পর্দার আড়াল থেকে এমন প্রচারণা চালাতে পারে। 

জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী সমমনা ১২ দলীয় জোটের নেতা ও গণদলের চেয়ারম্যান আবু তাহের মোহাম্মদ গোলাম মাওলা চৌধুরী বলেন, ৫০ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ‘আওয়ামী লীগ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে’ এটা যারা বিশ্বাস করে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আওয়ামী লীগে বিদেশে পলাতক অনেক নেতাই এখন মনোকষ্টে আছেন, তারা হাসিনার উপর চরম ক্ষুব্ধ। তবে আমার মনে হয়, যারা ভারতের অ্যাজেন্ডা বস্তবায়নে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি তুলছেন; আওয়ামী লীগ আসছে- এমন প্রচারণা তারাই করছেন। কারণ আওয়ামী লীগ নেতারা এটুকু বোঝেন, তাদের সহসা ফেরার কোনো সুযোগ নেই। আর আওয়ামী লীগ বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে বিএনপি কী বসে থাকবে?

এর আগে আওয়ামী লীগ রাজপথে বিশৃঙ্খলা করতে পারে এমন প্রচারণায় সতর্ক করে দিয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সিনিয়র সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নাম দিয়ে রাজনীতি করার কোনো অধিকার রাখে না। গণহত্যা করেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। উল্টো বিদেশে বসে শেখ হাসিনা দেশকে অস্থিতিশীল করতে আবারো মানুষ হত্যার নির্দেশ দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সেই নির্দেশ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ রাজপথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চিন্তাভাবনা করলে বিএনপি সমুচিত জবাব দেবে।’

কয়েকটি জেলার স্থানীয় সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায, গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ এখনো প্রকাশ্যে রয়েছে। মাঝে মধ্যে এখানে-সেখানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ঝটিকা মিছিল করছে। এগুলো কার্যত বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নিস্তেজ অবস্থায় আছেন। বেশির ভাগ নেতাই ঘর থেকে বের হন না। ব্যবসায়ী নেতারা বিএনপিতে এবং এনসিপিতে যাওয়ার তদবির করছেন। বিশেষ করে ১৫ বছর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেছেন এমন নেতারা শেখ হাসিনার বিদেশে পালানোয় হাসিনায় বিক্ষুব্ধ। বেশির ভাগ নেতাই আওয়ামী লীগ রাজনীতির ‘মরা লাশ টেনে তোলার মতো’ বোকামি করতে নারাজ। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা দিল্লি পালানোর পর কয়েকবার বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। সেনা অভ্যুত্থান, জুডিশিয়াল ক্যু, সচিবালয় ঘেরাও, সংখ্যালঘু নির্যাতন, গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা, পাহাড়ে অশান্তিসহ অনেক অপকা- করেছে। কোনোটিতেই সফল হয়নি। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করেন, দেশের রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা দূরের কথা রাজনীতিতে ফিরে আসার অবস্থা আওয়ামী লীগের নেই। ফলে দিল্লিতে নিরাপদে থেকে হাসিনার নির্দেশে প্রকাশ্যে এসে মাঠে নামা আত্মহত্যার নামান্তর। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘নিজগৃহে স্বেচ্ছাবন্দি রয়েছে’ এমনকি হাট-বাজারেও যাচ্ছেন না এমন নেতারা মনে করেন ৫ আগস্ট ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ফিরে আসছে এমন প্রচারণায় দলটির মাঠপর্যায়ের নেতারা নেই। এমনকি যারা বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন তারাও এমন মানসিক অবস্থায় নেই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ঝড়ের বেগে ফিরে সবকিছু তছনছ করবে- সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন প্রচারণার নেপথ্যে কারা? ফ্যাসিস্ট ও গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে দেশের রাজনীতিতে কারা ফেরাতে চায়? পিআর পদ্ধতির নির্বাচন দাবির নামে কারা আগামী সংসদে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চায়?