Image description

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি সামনে রেখে নতুন উত্তাপ দেখা দিয়েছে রাজনীতিতে। গণ-আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের বার্ষিকীতে জুলাই সনদ ঘোষণা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে আছে টানাপড়েনও। অভ্যুত্থানের এক বছরের ব্যবধানে দলগুলোর মধ্যে বিভেদ বেড়েছে। নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে বাড়ছে দ্বন্দ্ব-বিতর্ক। এই সুযোগে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠী নানা অপপ্রচার ও গুজব ছড়িয়ে মাঠ গরম করছে। এই সময়ে তারা মাঠে নাশকতা করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে এমন তথ্য দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে। এজন্য সারা দেশে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ২৯শে জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট এই সময়ের মধ্যে নাশকতা হতে পারে বলে গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশের পর এ নিয়ে উদ্বেগও দেখা দিয়েছে জনমনে। কেউ কেউ প্রশ্নও তুলেছেন এই সময়ে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে কেন এই উদ্বেগের তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ৫ই আগস্ট নিয়ে কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি সরকার দেখছে না। 

ওদিকে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি ঘিরে এই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া দলগুলো নানা কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। হুমকি দেয়া হচ্ছে। এসব কারণে মানুষের মাঝে পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। 

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরিস্থিতির মধ্যেই অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে জুলাই সনদ ঘোষণার আলোচনা শেষ হয়েছে। এখন এই সনদ ঘোষণা বা স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে দলগুলো। আগামী দুু’একদিনের মধ্যেই এ সনদ চূড়ান্ত হবে বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে বলা হলেও সব দল এতে স্বাক্ষর করবে কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। দলগুলো জুলাই সনদে একমত হতে না পারলে অভ্যুত্থানের বার্ষিকীর এই সময়ে নতুন রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে কিছু কিছু বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে চরম বিরোধ স্পষ্ট হয়েছে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকেও সামনের কয়েক দিনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি সামনের কয়েক দিনে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হলে নির্বাচন নিয়েও ইতিবাচক একটি ঘোষণা আসতে পারে। অভ্যুত্থানের বার্ষিকী ৫ই আগস্ট সামনে রেখে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন বলে জানানো হয়েছে। এই ভাষণে তিনি জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা তুলে ধরতে পারেন। নির্বাচনের স্পষ্ট ঘোষণা এলে এটি হবে জাতির জন্য একটি স্বস্তির খবর। তবে জুলাই সনদ নিয়ে নেতিবাচক কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে নির্বাচনের পরিকল্পনা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।  

গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী চার-পাঁচদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য একটি ‘ক্রুশিয়াল’ সময়। এই কয়েকদিনে বোঝা যাবে সামনে কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত, নির্বাচন দেরি হবে না।

বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে গণমাধ্যম কেন্দ্রে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন। ৫ই আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিকে সামনে রেখে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ তৈরির বিষয়ে কাজ হচ্ছে উল্লেখ করে শফিকুল আলম বলেন, ‘আগামী পাঁচ-ছয়টা দিনে বুঝবো যে, আমরা সামনে কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু একটি বিষয় আপনি নিশ্চিত থাকেন, নির্বাচন দেরি হবে না। নির্বাচন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে সময়ে বলেছেন, তার থেকে একটা দিনও দেরি হবে না।

 
নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রেস সচিব আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রথমে বলেছিলেন নির্বাচন এপ্রিলের প্রথমার্ধে হবে। পরবর্তী সময়ে লন্ডনে বলা হয়েছে যদি অনেকগুলো সংস্কার হয় এবং বিচারের কাজগুলো এগিয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে এটা ফেব্রুয়ারিতে হবে। তারা সেই জায়গায় এখনো আছেন। এটি একদিন দেরি হবে না, যাই হোক না কেন। সনদ বা ঘোষণাপত্র যাই হোক না কেন যেটা, যেভাবেই সনদ গ্রহণ করা হোক না কেন... নির্বাচন তার সময়মতো হয়ে যাবে। এ বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূসের দৃঢ় অবস্থান, পুরো উপদেষ্টা পরিষদেরই এখানে দৃঢ় অবস্থান। উপদেষ্টারা তাদের পুরনো কাজে ফিরে যেতে চাইছেন।

কিছুদিনের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা: আসিফ নজরুল
ওদিকে আগামী কিছুদিনের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।  হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা ও মব সন্ত্রাসকে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা বলে মনে করেন তিনি। তবে মিথ্যা মামলা থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। গতকাল সচিবালয়ে সংস্কার ও সমসাময়িক বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা এ কথা জানান। গত এক বছরে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে যেসব কাজ হয়েছে, সংবাদ সম্মেলনে সেসব তুলে ধরেন তিনি।

কবে আগামী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে জানতে চাইলে আইন উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের সময় তো জাস্ট ওয়েট করুন, কিছুদিনের মধ্যে ঘোষণা শুনবেন। আসিফ নজরুল বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, এরসঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি। ২০০৮-এর নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। আপনারা যারা সাংবাদিকরা আছেন- কাজ করেন, অনেক ভয়াবহ তথ্য পাবেন ২০০৮-এর নির্বাচন নিয়ে। উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনী কার্যক্রম তো নির্বাচন কমিশন দেখবে। আমি শুধু আমাদের সরকারের নিয়তের কথা আপনাদের বলতে পারি। আমাদের নিয়ত আছে বাংলাদেশের ইতিহাসে বেস্ট ইলেকশন দেয়া, এটা স্যার (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের সব সময় বলেন।

তিনি বলেন, আমাদের সরকারের আমলে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, একটা হচ্ছে মিথ্যা মামলা, মামলা হতে পারে, কিন্তু মিথ্যাভাবে লোককে ফাঁসানো, মানে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা; আরেকটা হচ্ছে জব জাস্টিস। মব সন্ত্রাস আমি বলি। এই দুইটা আমাদের খুবই পীড়িত করে। আইন উপদেষ্টা বলেন, মিথ্যা মামলা ঠেকানোর জন্য বা এই মামলা থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়ার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধন করা হয়েছে। পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা না করে একটা প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করে আদালতে দেবেন। আদালত যদি দেখেন, এখানে ৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, কিন্তু ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য আছে, বাকিদের বিরুদ্ধে নেই, তাহলে আদালত তখনই ছাড় করে দিতে পারবেন। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে সুফল পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, পর্যালোচনার পর ১৫ হাজারের বেশি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সাইবার আইনের অধীনে ৪০৮টি ‘স্পিচ অফেন্স’সংক্রান্ত মামলা এবং জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে করা ৭৫২টি হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব মামলা প্রত্যাহারের কারণে কয়েক লাখ রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও স্বাধীন মতের মানুষ হয়রানি থেকে রেহাই পেয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা তার মন্ত্রণালয়ের এক বছরের কাজের চিত্র তুলে ধরে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে আইনটিকে ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ জারি, দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন, ফৌজদারি বিধি সংশোধন, মামলাপূর্ব বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার বিধান সংযোজন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালায় সংশোধন, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি, বিবাহ নিবন্ধন বিধিমালা সংশোধন, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫ এবং জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের আইন ও বিচার বিভাগে পদায়নে বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য তুলে ধরেন উপদেষ্টা।