
দেশের ফুটবলে ‘পোস্টার গার্ল’ ঋতুপর্ণা চাকমা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা মগাছড়ি গ্রামের মেয়ে, দেশের ফুটবল-বোদ্ধাদের চোখে লাল-সবুজের ‘মেসি’। আগামী বছরের মার্চে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য নারী এশিয়ান কাপে বাংলাদেশের টিকিট কাটার মূল কারিগর ২১ বছর বয়সী এই উইঙ্গার। মিয়ানমারে সদ্য সমাপ্ত এএফসি উইমেনস এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে দৃষ্টিনন্দন পাঁচ গোল করেন তিনি। তবে শুধু মাঠেই নন, জীবনের কঠিন সংকটে নিজের মায়ের পাশে থেকেও মানুষের হৃদয় জয় করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দর্শন বিভাগে অধ্যয়নরত ঋতু।
পাহাড়ি এলাকার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম হলেও, ক্রীড়ার প্রতি ভালোবাসা আর এক মায়ের প্রতি অটুট ভালোবাসার কারণে ঋতুপর্ণার জীবন অদম্য এক সংগ্রামের গল্পে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে দুর্গম এলাকায় থেকে চিকিৎসার খোঁজে যাত্রা করা, চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা—সবই তার ওপর অর্পিত কঠিন দায়িত্ব। কিন্তু অটুট মনোবল, হৃদয়ে সঞ্চারিত সাহসে কখনো পিছিয়ে যায়নি ঋতুপর্ণা।
ঋতুপর্ণার পায়ের জাদুর তীব্রতা প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন, মগাছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা। এরপর বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবলের প্রধান কোচ পিটার জেমস বাটলার।

তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন, একেবারে ছোট্ট ঋতুপর্ণা। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গ্রামটির ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করাটা ছিল তার অন্যতম শখ। খেলার তালিকায় দড়িলাফ, গুলি, বরফ-পানি ছিল—তবে একদিন একটা ফুটবল হাতে এসে পড়ল। ক্রমেই ভালোবেসে ফেললেন বলটাকে। তখনো জানতেন না, মেয়েরাও ফুটবল খেলতে পারে।
খেলতে খেলতে একবার ব্যথা পেয়েছিলেন, তীব্র ব্যথায় ভেবেছিলেন আর খেলবেন না। তখনই তার জীবনে আলো হয়ে আসেন বীরসেন চাকমা। তিনি ঋতুকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার পায়ে অন্য রকম কিছু লুকায়িত। তিনিই ঋতুকে আশ্বস্ত করেন, উৎসাহ দেন, বলেন— ‘তুই পারবি’। সেই থেকে শুরু। পরের গল্পটা এখনো লিখছেন পাহাড়ের এই ফুটবল রাজকন্যা।
২০১১ সালে বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে স্কুল টিমের হয়ে মাঠে নামেন তিনি। দলকে ফাইনালে তুলতে দারুণ ভূমিকাও রাখেন। ক্রমেই বড় হতে থাকে তার ফুটবল রাজত্ব। তবে কেবল খেলোয়াড় হওয়ার গল্প নয়, পাহাড়ের পথে-প্রান্তরে বেড়ে ওঠা মেয়েটি এখন হাজারো স্বপ্নময়ী মেয়ের অনুপ্রেরণা।

২০১৬ সালে বিকেএসপিতে ভর্তির পর ঋতুর জীবনে নতুন এক দিগন্তের সূচনা হয়। সেবারই বাফুফের জুনিয়র ক্যাম্পে ডাক মেলে তার। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে ঋতু এখন দেশের ফুটবল ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। জাতীয় দলের হয়ে এরই মধ্যে অসংখ্য ম্যাচ খেলেছেন তিনি। দুটি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপায়ও নিজের নাম জড়িয়েছেন। সর্বশেষ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা খেলোয়াড়ও তিনি।
প্রায় ১১ বছর আগে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে পরলোকে পাড়ি জমান ঋতুপর্ণার বাবা বরজবাঁশি চাকমা। ঋতুপর্ণার মা ভুজোপতিও ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। ইতোমধ্যে তিনটি কেমোথেরাপি নিয়েছেন তিনি। প্রতি ২১ দিন অন্তর অন্তর তাকে চট্টগ্রাম নিয়ে গিয়ে কেমোথেরাপি দিতে হচ্ছে।

এশিয়ান কাপের টিকিট নিশ্চিতের পর মায়ের কাছে প্রথম ফোন করেছিলেন ঋতুপর্ণা। এ নিয়ে ঋতুপর্ণা বলেছেন, ‘মা যখন জানলেন, আমরা কোয়ালিফাই করেছি এবং আমি জোড়া গোল করেছি, তখন তিনি বলছিলেন, নিজেকে এখন আর অসুস্থ মনে হয় না। তিনি অনেক খুশি হয়ে নিজে যে অসুস্থ তা-ও ভুলে গিয়েছিলেন।’
এদিকে তিন বছর আগে একমাত্র ভাই পার্বণ চাকমাকে হারিয়েছেন ঋতু। এখন তিন বোনের সঙ্গে মাকে নিয়ে চলছে তাদের সংসার। এরই মধ্যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তার তিন বোন। অবশ্য ঋতু প্রেরণায় এখনো বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনেন তার মা ভুজোপতি। আর নানান প্রতিকূলতার মধ্যেই সংসারকে সচ্ছলতার আলোকবার্তায় প্রজ্বলিত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের এই শিক্ষার্থী। তবে শুধু এশিয়া নয়, বিশ্বমঞ্চে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর স্বপ্ন পাহাড়ি এই রাজকন্যার।

দৃষ্টিনন্দন খেলা, নির্ভরযোগ্য পারফরম্যান্স আর নেতৃত্বগুণে—প্রতিনিয়তই আস্থার প্রতিদান দিচ্ছেন ঋতুপর্ণা। সংসারে দুর্ভাবনা, পারিবারিক অসুস্থতা, সামাজিক সংকীর্ণতা—সবকিছু ডিঙিয়ে আজ দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বে পৌঁছেছেন ঋতুপর্ণা, তা শুধু একজন খেলোয়াড়ের নয়, এক নারীর, এক পাহাড়ি মেয়ের—নিজেকে নিজেই গড়ার সিনেমাটিক এক গল্প।