Image description

দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়ে ভারতে পাড়ি জমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার ফলে দীর্ঘ দেড় দশকের আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটে। আন্দোলনের সময়কার ঘটনাপ্রবাহ বিবেচনায় আওয়ামী লীগের এ পতন প্রাথমিকভাবে শেখ হাসিনাসহ তার কিছু ঘনিষ্ঠজনের কথাবার্তা, কার্যকলাপ এবং নানা অনিয়ন্ত্রিত ও বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণে নিশ্চিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

বিশেষ করে, অহিদুল ইসলাম তুষারের মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রিট থেকে শুরু করে আন্দোলনকারীদেরকে হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যা, ছাত্রলীগের হামলা, ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কঠোর দমন-পীড়ন—এই প্রতিটি ঘটনায় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরও গভীর ও ব্যাপক আকার ধারণ করে। একসময় তা রূপ নেয় অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনে, যা শেষপর্যন্ত সরকারের পতনে গিয়ে ঠেকে। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের আজকের এ আয়োজনে আওয়ামী লীগের পতনের পেছনে অবদান রাখা আওয়ামী লীগেরই ব্যক্তিবর্গের কার্যকলাপ বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। 

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কারণসমূহের পাশাপাশি দেশের মানুষকে দীর্ঘসময় ধরে জবরদস্তিমূলক ও একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার অপচেষ্টা, গণতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুতি, প্রহসনের নির্বাচন ও ভিন্নমতকে সহ্য না করার মতো ভুলের মাধ্যমে সৃষ্ট জনদ্রোহ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। 

‘দীর্ঘদিন ধরে যখন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলতে থাকে তখন যেকোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে স্যাচুরেশন ঘটে এবং এটা অনিবার্য হয়ে যায়, তা হোক ১০ বছর ‍কিংবা ২০ বছর পর। একের পর এক নির্বাচনের নামে যখন প্রহসন হচ্ছিল, সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল-মতকে যখন দমন করা হচ্ছিল তখন থেকেই সমন্বিত বিরোধ তৈরি হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত সরকার পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।’ - ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাবি। 

অহিদুল ইসলাম তুষার ও তার প্রাসঙ্গিকতা:
মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও প্রজন্ম, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী অহিদুল ইসলাম তুষার। ২০১৮ সালে পরিপত্র জারির পর থেকে চব্বিশের জুলাই পর্যন্ত তিনি কোটার পক্ষে লড়াই করেছেন এবং এ ব্যাপারে মুখপাত্র হয়ে কথা বলেছেন। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সে বছরের ৪ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র জারি করে শেখ হাসিনা সরকার। ৩ বছর পর ২০২১ সালে পরিপত্রটি চ্যালেঞ্জ করে অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন হাইকোর্টে একটি রিট করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে জারি করা ২০১৮ সালের পরিপত্র কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর রুল জারি করে হাইকোর্ট। সর্বশেষে ২০২৪ সালের ৫ জুন চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেয়। এরপর শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন-২০২৪।

এরই মধ্যে ২০২৪ সালের ২৪ জুন এক গণমাধ্যমকে তুষার  বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোনো প্রাপ্তি দেখলে কিছু মানুষের গা জ্বলে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশ উপহার দিয়েছেন, টানা ২১ বছর এক সময় তারা রাষ্ট্র থেকে তেমন কিছুই পাননি। ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের জন্য সম্পূর্ণ যৌক্তিক। 

তুষারের রিটকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের সূচনা ও অবশেষে সরকার পতন: 
৫ জুন এই মামলার রায় ঘোষণার প্রেক্ষিতে ঐ দিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ৬ জুন দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ সমাবেশ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই দাবিতে কয়েকদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন। ৯ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিক্ষোভ সমাবেশে ৩০ জুনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল না হলে দেশব্যাপী আন্দোলনের আল্টিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদনের প্রেক্ষিতে ১০ জুন আন্দোলনকারীরা দাবি মেনে নিতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন এবং ঈদুল আযহার কারণে আন্দোলনে বিরতি ঘোষণা করেন। ৩০ জুন থেকে আন্দোলন পুনরায় উজ্জীবিত হয়। ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে ও তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিনারের সামনে অবস্থান নেয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলন কর্মসূচি চলতে থাকে। 

বিক্ষোভ, ৫ জুন
৫ জুন কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের রায়ের প্রতিবাদে ঢাবিতে বিক্ষোভ

ধারাবাহিক আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচির প্রেক্ষিতে ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে এক প্লাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করে। প্লাটফর্মটির ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি লাগাতার কর্মসূচি দেন। পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের সহিংস তৎপরতায় আন্দোলনকারীদের উপর মাসব্যাপী গণহত্যা চালিয়ে এবং কারফিউ জারির মাধ্যমে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেও আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয় শেখ হাসিনার সরকার। আন্দোলন ঘটনাচক্রে অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নিলে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যায় এবং শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে।

প্রভাষ আমিন: 
বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ ছিলেন প্রভাষ আমিন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মো: মোশাররফ হোসেনের স্বাক্ষর করা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাকে চাকরিচ্যুত করে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। তিনি আওয়ামী লীগের শাসনামলে সরকারপন্থি সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে প্রাইম মিনিস্টার বিটের বিশেষ সাংবাদিক হিসেবে সরকারের প্রশংসা করতে তাকে নিয়মিত সেসব সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিতে দেখা যেত। সাংবাদিক হিসেবে প্রশ্নের পরিবর্তে শেখ হাসিনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়ার কাজেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন বলে জানা যায়। 

প্রভাষ আমিনের সেই ঐতিহাসিক প্রশ্ন ও শেখ হাসিনার বেফাঁস মন্তব্য:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সারাদেশে যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন চলছিল সেই মুহূর্তে ১৪ জুলাই বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে চীন সফর প্রসঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেই সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামীপন্থি সাংবাদিকরা আন্দোলন ইস্যুতে শেখ হাসিনার ভূমিকার জন্য তার ভূয়সী করেন। এসময় প্রভাষ আমিনও তার প্রশংসা করে বক্তব্য দেন এবং প্রশ্নের পরিবর্তে আন্দোলন কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, সে পরামর্শ তিনি দেন। 

এসময় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তিনি বলেন, মনে হতে পারে যারা কোটায় চাকরি পায় তাদের কোনো মেধা নেই। কিন্তু আবেদন করার ক্ষেত্রে কোটা লাগেনা, প্রিলিমিনারি বা লিখিততে কোটা লাগেনা। একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে কোটা অ্যাপ্লাই হয়। তখন আসলে মেধায় সবাই সমান। এখন আমার সামনে যদি দুটি অপশন থাকে যে, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং একজন রাজাকারের সন্তান, দুজনই সমান মেধাবী। তাহলে অবশ্যই আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে চাকরি দিবো। তখন শেখ হাসিনাও বলে উঠেন, ‘অবশ্যই’। ফলে মেধা এবং কোটার তুলনা করে খুব সহজেই মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাচ্ছে যে, মেধাবীদের চাকরি না দিয়ে কোটায় চাকরি দেওয়া হচ্ছে। 

১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে প্রভাষ আমিনের প্রশ্ন

এসময় শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আপনাকে খুবই ধন্যবাদ যে, গত ১০-১২ দিন ধরে আন্দোলন হচ্ছে, কিন্তু আপনারা অসীম ধৈর্যের সাথে আন্দোলন মোকাবেলা করছেন। যারা আন্দোলন করছে, তারা সংক্ষুব্ধ, চাকরি না পেয়ে তারা বঞ্চিত, তাদের ক্ষোভের সাথে আমিও একমত। তবে তাদের পেছন থেকে ভুল বুঝিয়ে বা ইন্ধন জুগিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি করছে কিনা। আপনার কাছে আমার আবেদন থাকবে, আপনারা যে ধৈর্য্য দেখাচ্ছেন, তা দেখিয়েই যদি কোনোভাবে তাদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সংবেদনশীলতার সাথে বিবেচনা করতেন তাহলে ভাল হত। আগামী ৭ আগস্ট পর্যন্ত কিছু করার নেই, কারণ ওইদিন আপিল বিভাগের শুনানি হবে, তারপর আপিল বিভাগের রায়ের পর নির্বাহী বিভাগ কি করবে না করবে সেটা পরে দেখা যাবে। 

এরপর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আসলে কার মেধা কত তা প্রিলিমিনারি, পরীক্ষা, ভাইবা ও ফলে যাচাই হয়। সেই সময় যেটা হয়। ‍যদি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয় তাহলে সেইই পাবে। আর সব কোটাই যে পূর্ণ হয় তাওনা। যেখানে বাকি থাকে সেখানে তো ওই তালিকা থেকেই দেওয়া হয়। এর মধ্যে অনেক চাকরি কিন্তু তালিকা থেকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা অগ্রাধিকার পাবে। এগুলা তো দিতেই হবে। তো কোটা আর মেধা তো এক জিনিস না। এখানে দ্বন্দ্বটা সৃষ্টি করা একটা ট্যাকটিস। তার মানে কী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিরা কেউ মেধাবী না, যত রাজাকারের বাচ্চারা, নাতি-পুতিরা সব মেধাবী, তাইনা? কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, যাদেরকে মেধাহীন বলছে, তাদের কাছে কিন্তু ওরা (আন্দোলনকারীরা) পরাজিত। যুদ্ধে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারাই বিজয়ী হয়েছিল, রাজাকাররা জয়ী হয়নাই। তারা পাকিস্তানিদের পদলেহন করেও পরাজিত হয়েছিল। এই কথাটা তো মনে রাখা উচিত। 

এদিন শেখ হাসিনা আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। অপরাধটা কী? নিজের জীবনবাজি রেখে, সংসার সব ফেলে দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। দিনরাত খেয়ে না খেয়ে, কাদামাটি ভেঙে, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মোকাবিলা করে যুদ্ধ করে এ দেশের বিজয় এনেছে। বিজয় এনে দিয়েছিল বলে সবাই উচ্চপদে আসীন। তারা (কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা) আদালতে যাক, বলুক। তা না, তারা রাজপথে সমাধান করবে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আমার তো দাঁড়ানোর অধিকার নেই, সংবিধানও বলে না। সংসদও বলে না, কার্যপ্রণালিবিধিও বলে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না আসবে, ততক্ষণ আমাদের কিছু করার থাকে না। এ বাস্তবতা তাদের মানতে হবে। না মানলে কিছুই করার নেই।

আন্দোলনকারীদেরকে ইঙ্গিত করে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যায়িত করার প্রভাব যেভাবে আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়:
সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ‘রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘অবমাননা’র অভিযোগে সেদিনই রাত ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এসময় তাদের কণ্ঠে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’, ‘চাইলাম কোটা সংস্কার, হইলাম রাজাকার’সহ নানা ব্যঙ্গাত্মক স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এ বিক্ষোভে ঢাবির সায়েন্সের তিন হল, মুহসীন, বিজয় একাত্তর, সূর্যসেন, জিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জসিম উদদীন, এ এফ রহমান, জহুরুল হক ও এসএমসহ সকল হল থেকেই শত শত শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে এসে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি সেদিন ঢাবির রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, শেখ ফজিলাতুন নেছা, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী ও শামছুন নাহার হলের নারী শিক্ষার্থীরাও গেট খুলে হাতে থালা-বাসন ও ঝাড়ু নিয়ে ছেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দেন, যদিও এসব হলগুলোতে রাত ১০টার পর কারো প্রবেশ বা বের হওয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ কর্মসূচির পর সারাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও মধ্যরাতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে। এ কর্মসূচিই কোটা আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণের টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এদিনের পর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিগুলোতে রেকর্ডসংখ্যক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ দেখা যায় এবং সে সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। 

‘কোটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থীদের যে দাবির ভিত্তিতে সে দাবির প্রতিফলন সর্বশেষ রায়ে বাস্তবায়িত হওয়ার পরও আওয়ামী সরকারের পতন নিশ্চিত হয়েছে। কারণ, সেসময়টাতে দলটির  রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের সদিচ্ছার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।’-মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

সাদ্দাম হোসেন ও শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান: 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী, ডাকসুর সাবেক এজিএস এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন) সভাপতি হলেন সাদ্দাম হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় তার নির্দেশে ছাত্রদল ও ছাত্র অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন ভিন্নমতের সংগঠনকে মোকাবেলা করতে তাদের নেতাকর্মীদের ওপর বিভিন্ন সময়ে হামলার অভিযোগ রয়েছে। ঢাবিতে আয়োজিত ছিলছিলা ব্যান্ডের কাওয়ালি গানের অনুষ্ঠান, ছাত্রদলের ওপর ও ভিপি নুরের ওপর হামলার ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে তিনি উল্লেখযোগ্যভাবে অভিযুক্ত। অন্যদিকে, শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বর্তমানে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। 

কোটা আন্দোলনে সাদ্দাম-ইনান নেতৃতাধীন ছাত্রলীগের অবস্থান, ভূমিকা ও শেষ পরিণাম: 
চব্বিশের জুলাইয়ে কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই সাদ্দাম ও ইনান দেশব্যাপী তাদের শাখা নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে আন্দোলন বানচালের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছিলেন। এ প্রেক্ষিতে আন্দোলনে যোগ না দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে চাপ প্রয়োগ, হুমকি, মারধর, বাধাপ্রদান ও পাল্টা কর্মসূচি গ্রহণ থেকে শুরু করে এহেন কোনো কর্মসূচি বা পদক্ষেপ নেই যা তারা গ্রহণ করেননি। 

এরই মাঝে, ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার সেই বিতর্কিত বক্তব্যের পরে জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করে আইন প্রণয়ন ও শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ শীর্ষক বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে ১৫ জুলাই সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত সমাবেশে ঢাবির বিভিন্ন হলসহ আশেপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা যোগ দিতে থাকেন। অন্যদিকে, ঢাবির মধুর ক্যান্টিনে ঢাবির বিভিন্ন হল, সাত কলেজ, ঢাকা মহানগর ও আরও বিভিন্ন শাখা থেকে বহিরাগত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকে। অন্যদিকে, দুপুরের দিকে হলগুলো থেকে কোটা আন্দোলনের সমাবেশে যোগ দিতে শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় ছাত্রলীগ। পরে শিক্ষার্থীরা টিএসসি থেকে হল পাড়ার দিকে মিছিল নিয়ে গেলে তাদের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ভিসি চত্বরে চলে যাওয়ার পর ক্যাম্পাসে জড়ো হওয়া সকল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালালে অসংখ্য নারী শিক্ষার্থীসহ দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এসময় হামলায় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম, সম্পাদক ইনান, ঢাবি সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন, সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নেতৃবৃন্দকে সরাসরি নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। এদিন অন্যান্য ক্যাম্পাসগুলোতেও ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালায়। পরে সারাদেশে ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়লে মানুষ ক্ষোভে ফেঁটে পড়ে এবং আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে থাকে। এর মধ্যে ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে সর্বস্তরের মানুষের অন্তরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সেদিন রাতে ও পরের দিন ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে হলগুলোকে রাজনীতিমুক্ত ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার প্রতিফলন ঘটান দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও। 

১৫ জুলাই ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা

প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ইন্টারনেট বন্ধকরণ এবং জাতির সঙ্গে ধোঁকার গল্প:  
গত ১৫-১৬ জুলাই সময়কালে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এবং ৫ আগস্ট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ ও চালু করার ঘটনায় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সরাসরি জড়িত ছিলেন। এক্ষেত্রে তার মৌখিক নির্দেশনায় বিটিআরসি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন আহমেদ এ কাজের বাস্তবায়ন ঘটান। অন্যদিকে, ১৭ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত এবং ৫ আগস্ট মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ও চালু করার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) নির্দেশনায় সম্পন্ন করা হয়। এসময়ে পলক ইন্টারনেট বন্ধ নিয়ে ডেটা সেন্টার পুড়ে যাওয়াসহ নানা গল্প ফাঁদেন। আন্দোলন দমন করতে ইন্টারনেট বন্ধ করে গত ১৮ জুলাই থেকে মূলত শেখ হাসিনা সরকারের আনুষ্ঠানিক গণহত্যা শুরু হয়, যা চলতে থাকে সরকার পতনের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা অঁচল করে শেখ হাসিনা ও পলকসহ সংশ্লিষ্টরা ক্র্যাকডাউন, দমন-পীড়ন ও ধরপাকড় চালিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমগুলোতে আন্দোলনকারীদেরকে নিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার চালান। যার কারণে, সর্বস্তরের মানুষ বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে সরকার হঠানোর প্রতিজ্ঞা করেন। কারণ, বর্তমানে ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক মানুষের জন্য এক ধরনের মৌলিক অধিকারে রূপ নিয়েছে, এটার অনুপস্থিতি সকলকে সীমাহীন ভোগান্তির মুখে ফেলতে বাধ্য করে। 

ডিবিপ্রধান হারুন-অর-রশিদ (ডিবি হারুন) ও আন্দোলনে তার অস্বাভাবিক কার্যকলাপ:
জুলাই আন্দোলন চলাকালে হারুন-অর-রশিদ ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান। যদিও আগস্টের শুরুতে তাকে ডিএমপির ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করে শেখ হাসিনা সরকার। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে হেফাজতে তুলে নিয়ে নির্যাতনের জেরে আলোচনায় আসেন হারুন অর রশীদ।

সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নিয়ে নির্যাতন

পরে সমন্বয়কদের সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার ছবি এবং তাদের দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি দেওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেন তিনি। এসময় তার এই কর্মকাণ্ডকে জাতির সাথে মশকরা বলে মন্তব্য করেন উচ্চ আদালত। হাইকোর্টের এমন মন্তব্যের পরও ওই ছয় সমন্বয়ককে বেআইনিভাবে আটকে রাখা হয় প্রায় এক সপ্তাহ। এসময় নাহিদ ইসলামের পুরো শরীরজুড়ে নির্যাতনের চিহ্ন সংবলিত একটি ছবি ভাইরাল হলে সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে ডিবি হারুন ও সরকারের প্রতি একধরনের ক্ষোভের উদ্রেক হয় এবং সরকারের ভীত অনেকটা নড়বড়ে হয়ে উঠে।  

তুলে নেওয়া ৬ সমন্বয়ককে হুমকির মুখে বিবৃতি দেওয়ান ডিবি হারুন

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার জনবিদ্বেষী কথা-বার্তা-কর্মকান্ড: 
বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম, খুন ও মিথ্যা মামলার মাধ্যমে ভিন্নমতের প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, দল ও ব্যক্তিদেরকে দমন, প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে যুগের পর যুগ ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত, ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ঔপনিবেশিক এক শক্তির স্বার্থে যা খুশি তাই করা এবং মুক্তিযু্দ্ধের চেতনার ব্যবসার মাধ্যমে জাতিকে আলাদা করাসহ শেখ হাসিনার অনেক এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। তার সময়ে মামলা-মোকাদ্দমা ও গুম-খুন স্বাভাবিক রুটিনে পরিণত হয়েছিল। বিশেষ করে, বিগত তিনটি নির্বাচনে জনগনকে তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বন্দোবস্ত মানুষকে একপ্রকার বিষিয়ে তুলেছিল। এরই মধ্যে চব্বিশের জুলাই আন্দোলন চলাকালে ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে লেলিয়ে দেন। পাশাপাশি তার নির্দেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও সহযোগী সংগঠন অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, হত্যা করে, আহত করে এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। এসময় রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র, নিরীহ আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। আন্দোলনে তার নির্দেশে প্রায় দেড় হাজার লোককে হত্যা করা হয় এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করা হয়। এভাবে তার বেফাঁস মন্তব্য ও কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নজিরবিহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত করে তাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। 

এর বাইরে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী মো. আনিসুল হক, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, হাসানুল হক ইনু, মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, মোহাম্মাদ আলী আরাফাত, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মেয়র আতিকুল ইসলাম, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক র‌্যাবের প্রধান মো. হারুন আর রশিদ, বিপ্লব কুমার সরকার, জিয়াউল আহসান, এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (সাবেক বিচারক, আপিল বিভাগ), মুহাম্মদ জাফর ইকবাল (অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়), নিঝুম মজুমদার (আইনজীবী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট) এবং নাঈমুল ইসলাম খানসহ (সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব) আওয়ামী লীগকে মনেপ্রাণে ধারণকারী বিভিন্ন পর্যায়ের আরও অনেকের কার্যকলাপে বিরক্ত হয়েও জনতা গণ-অভ্যুত্থানের দিকে অগ্রগামী হয় বলে মনে করেন অনেকে।

এ বিষয়ে গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যখন স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলতে থাকে তখন যেকোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে স্যাচুরেশন ঘটে এবং এটা অনিবার্য হয়ে যায়, তা হোক ১০ বছর ‍কিংবা ২০ বছর পর। একের পর এক নির্বাচনের নামে যখন প্রহসন হচ্ছিল, সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল-মতকে যখন দমন করা হচ্ছিল তখন থেকেই সমন্বিত বিরোধ তৈরি হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত সরকার পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। নির্বাচন ও মতামত প্রকাশকেন্দ্রিক এবং সমালোচনা করলেই গুণী বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক বা যেকাউকেই বিরোধী পক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে ট্রিট করাও একটা দীর্ঘমেয়াদি কারণ ছিল, তবে আন্দোলন ছিল একটা ওয়াছিলা। 

তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের সময় একটা  বুদ্ধিজীবী মহল বা প্রভাব বিস্তারকারী গ্রুপ স্বৈরতন্ত্রকে প্রমোট করার চেষ্টা করেছে, মানুষকে এটা বুঝানোর মাধ্যমে যে, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিশ্চিত হলে স্বৈরতন্ত্রও মানানসই হতে পারে। এরকম ‍যুক্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা যখন আওয়ামী লীগকে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় রাখার চেষ্টা করেছে, তখন তাদের এ ভুলের পাশাপাশি আরও কিছু ভুল হয়েছে। এরকম একটা বড় ভুল ছিল কোটার পক্ষে রিট করে অনেকটা মীমাংসিত ইস্যুকে বিতর্কিত করে তোলা। এই ধরনের ভুলগুলোকে তারা আপাত দৃষ্টিতে রাজনৈতিক অর্জন মনে করলেও বুমেরাংয়ে পরিণত হওয়া স্বাভাবিক ছিল, যা সম্পর্কে তারা অজ্ঞ ছিল। তবে এ ভুলটা আজ বা কাল হতোই। কারণ, জবরদস্তিমূলক রাজনীতির ভয়ানক পরিণামের বহু নজির পৃথিবীতে আছে। 

রাজনীতি বিশ্লেষক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কারণ হিসেবে অহিদুল ইসলাম তুষারের কোটা পুনর্বহালের রিট, আন্দোলনকারীদেরকে হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যা, ছাত্রলীগের হামলা, ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কঠোর দমন-পীড়নের দায় অবশ্যই রয়েছে। আর কোটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থীদের যে দাবির ভিত্তিতে সে দাবির প্রতিফলন সর্বশেষ রায়ে বাস্তবায়িত হওয়ার পরও আওয়ামী সরকারের পতন নিশ্চিত হয়েছে। কারণ, সেসময়টাতে দলটির  রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের সদিচ্ছার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। 

তিনি বলেন, এর বাইরে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতায় থাকা এবং অন্য কোনো প্রতিদ্বন্ধী শক্তি না থাকায় আওয়ামী লীগের ভিতরেও ক্ষমতাকেন্দ্রিক অন্তর্কোন্দল সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, এমন সময় আওয়ামী লীগ যখন ক্রাইসিসে পড়লো তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও আমলাতন্ত্রকে এমনভাবে সাজিয়েছিল যে, তারা ভেবেছিল এই সাজানো উইং তাদেরকে টিকিয়ে রাখবে। আওয়ামী লীগ জনগণের উপর আস্থা না রেখে রেখেছে এ উইংয়ের উপর। গণতান্ত্রিক আদর্শের বাস্তবায়ন তাদের কাছে উপেক্ষিত বিষয় ছিল, বছরের পর বছর নির্বাচন দেওয়া হয়নি, মত প্রকাশ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা কুক্ষিগত করা হয়েছিল। এসব ব্যর্থতার দরুন আওয়ামী লীগ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে হয়।