
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নতুন সভাপতি হয়েছেন আমিনুল ইসলাম, বুলবুল নামেই যাঁকে চেনে বাংলাদেশের ক্রিকেট। তাঁর নেতৃত্বেই প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলেছে বাংলাদেশ, পেয়েছে প্রথম জয়ও। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি করে গড়েছিলেন অসাধারণ এক কীর্তি। আমিনুলের প্রায় পুরো ক্যারিয়ারই কাছ থেকে দেখেছেন প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র। বাংলাদেশের ১১ ক্রিকেটারের গল্প নিয়ে উৎপল শুভ্রর লেখা 'এগারো' বইয়ের এক চরিত্রও এই আমিনুল ইসলাম। তাঁকে নিয়ে লেখাটাতে ক্রিকেটার আমিনুলের সঙ্গে মানুষ আমিনুলকেও কিছুটা চিনতে পারবেন।
মেলবোর্নের শহরতলিতে ছিমছাম বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে একটু চমকেই গেলাম। চমকে গেলাম বাড়ির নম্বরটা দেখে। ১০০!
বাড়ির নম্বর ‘১০০’ হলে চমকে যেতে হবে কেন? কারণ, এই বাড়ির মালিকের নাম আমিনুল ইসলাম। বাংলাদেশের ক্রিকেট যাঁকে বুলবুল নামেই বেশি চেনে। ২০১৫ বিশ্বকাপ কাভার করতে মেলবোর্ন গিয়ে হোটেলে ওঠার আগে দুদিনের জন্য এক বন্ধুর আতিথ্য নিয়েছি। তখন জানি না, আমিনুল ইসলাম বুলবুল তাঁর প্রতিবেশী। মাঝখানে মাত্র দু-তিনটি বাড়ির ব্যবধান।

প্রথম দিনই দেখা হয়েছে। নিজের বাড়িতে ঘুরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আমিনুল। শুধু আমন্ত্রণ রক্ষার দায় থেকেই যাইনি, নিজেরও তুমুল আগ্রহ আছে। আমিনুলের ক্রিকেট-জীবন আর আমার সাংবাদিকতার জীবন একরকম সমান্তরালেই এগিয়েছে। অম্লমধুর কত স্মৃতি! আড্ডার সঙ্গী হিসেবেও আমিনুল দারুণ। যে আড্ডা শুরুই হলো বাড়ির নম্বর দিয়ে।
‘১০০’ দেখে চমকে যাওয়ার কারণটা কি ব্যাখ্যা করতে হবে? ১০০ মানে সেঞ্চুরি আর ক্রিকেট ইতিহাসে আমিনুল অমরত্ব তো একটি সেঞ্চুরির কারণেই। আমিনুল ইসলাম বুলবুল নামটা শুনলেই বাকি সব ছাপিয়ে প্রথমে কি সেটির কথাই মনে হয় না! আমিনুল ইসলাম বুলবুল মানেই তো বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান।
১০০ নম্বর বাড়িটাই যখন খুঁজে বের করলেন, আরেকটু কষ্ট করে ‘১৪৫’ খুঁজলেই পারতেন! আমিনুল হাসতে হাসতে বললেন, ‘সেটি খারাপ হতো না। তবে বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, ১০০ নম্বর বাড়িটা কিন্তু ঘটনাচক্রেই হয়ে গেছে। আমি এটা অনলাইনে কিনেছি। তখনো জানতাম না, বাড়ির নম্বর ১০০।’
বাড়ির নম্বর আর চমকে যাওয়ার যোগসূত্রটা না হয় ব্যাখ্যা করতে হলো। ‘১৪৫’-এরও কি ব্যাখ্যা লাগবে? বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুরাগী মাত্রেরই তো সেটি জানা থাকার কথা। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের মহাকাব্যিক সেই ১৪৫। মহাকাব্যই! আমার সেই সব ইনিংস বইয়ে আমিনুলের ১৪৫ নিয়ে লেখাটার শেষ লাইনটা ছিল এমন: ১৪৫ রান, ৩৮০ বল, ৫৩৫ মিনিট, ১৭টি চার—বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে প্রথম মহাকাব্যটি লেখা আছে এই পরিসংখ্যানে।

আমিনুলকে চিনতে হলে তাই ১৪৫-এর কথা জানতে হবে। পরিসংখ্যান দেখে যাঁরা চিনবেন, ১৩ টেস্টে ২১.২০ গড়ে ৫৩০ রান, তাঁদেরকে সাধারণ এক টেস্ট ক্রিকেটারের কথাই বলবে। কিন্তু আমিনুল সাধারণ তো ননই, আর দশজন টেস্ট ক্রিকেটারের মতোও নন। টেস্টে তাঁর ওই একটিই সেঞ্চুরি। ১৪৫ রানের সেই সেঞ্চুরিই অসাধারণত্বের লেবেল লাগিয়ে দিয়েছে তাঁর গায়ে। নিশ্চিত করে দিয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসে অমরত্বও। কারণ, সেই সেঞ্চুরি বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে। টেস্ট ক্রিকেটে কতজনের কত কীর্তি! কিন্তু এর একটি পাতায় আমিনুল ইসলাম ছাড়া নাম ছিল আর মাত্র দুজনের। ১৮৭৭ সালে ইতিহাসের প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান। ১৯৯২ সালে জিম্বাবুয়ের অভিষেক টেস্টে ডেভিড হটন। রেকর্ড নাকি গড়াই হয় ভাঙার জন্য। কিন্তু এ এমন এক রেকর্ড, যেটি কখনোই ভাঙার নয়। শুধু কেউ যোগ হতে পারেন।
যে কারণে আমিনুলের সঙ্গে দেখা করতে অমন ব্যগ্র হয়ে পড়েছিলেন ডেভ হটন। ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে বাংলাদেশের প্রথম সফর। ডেভ হটনের ইন্টারভিউ করেছি। নিজের গাড়িতে হারারে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন, নিয়ে গেছেন তাঁর একাডেমিতে। বিদায় দেওয়ার সময় বললেন, ‘আমাকে আমিনুলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ো তো! তিনজন মিলে আড্ডা মারতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু চার্লস ব্যানারম্যানকে তো আর পাব না। আমরা দুজন মিলেই আড্ডা দিই।’
এখন অবশ্য আর তিনজন নন। বিনি সুতোর মালায় গাঁথা ব্যানারম্যান-হটন-আমিনুলের সঙ্গে যোগ হয়েছেন আয়ারল্যান্ডের কেভিন ও’ব্রায়েন। যাঁর সঙ্গে আমিনুলের আগে থেকেই বন্ধুত্ব ছিল। আয়ারল্যান্ডের অভিষেক টেস্টের আগে কেভিন ও’ব্রায়েনকে টেলিফোন করে নিজেদের দলে আগাম আমন্ত্রণও জানিয়ে রেখেছিলেন আমিনুল। সেঞ্চুরি করার পর কেভিন ও’ব্রায়েন কৃতজ্ঞতাভরে তা স্মরণও করেছেন।
মাঝখানে মালয়েশিয়া ঘুরে আমিনুল ইসলাম যে চার্লস ব্যানারম্যানের দেশে থিতু হয়েছেন, তাতে একটুও অবাক হইনি। তাঁর অস্ট্রেলিয়ান কানেকশন অনেক পুরোনো। খেলোয়াড়ি জীবনে প্রায় নিয়মিতই ভিক্টোরিয়া লিগে খেলতে গেছেন। আইটি সেক্টরে ভালো চাকরি করা স্ত্রী পড়াশোনা করেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। যেটি অবাক হওয়ার মতো, তা হলো নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনায় তুমুল অনীহা। মেলবোর্নের আগে থাকতেন সিডনিতে। ২০০৫ সালে আইসিসি সুপার সিরিজ কাভার করতে গিয়ে আমিনুলের সিডনির বাড়িতেও ঘুরে এসেছি। তখনো দেখেছি, তাঁর কোনো কীর্তির কথা তুললেই আমিনুল নিরাসক্ত মুখে জবাব দিচ্ছেন, ‘আমি ওসব ভুলে গেছি।’

আসলে কি আর ভুলে গেছেন! ওসব কি ভোলা যায়! ক্রিকেট ভুলে গেলে আমিনুলের আর থাকে কী! খেলা ছাড়ার পরও তো ক্রিকেটই তাঁর জীবন। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের পতাকাতলে দাঁড়িয়ে ক্রিকেটের বিশ্বায়নের দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক দিন। ফাঁকে ফাঁকে দেশেও কোচিং করিয়েছেন। কোচিং করান অস্ট্রেলিয়াতেও। এসিসির ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে মূল কর্মক্ষেত্র ছিল চীন। চীনাদের ক্রিকেট শেখাতে গিয়ে মজার সব অভিজ্ঞতাও হয়েছে। মেলবোর্নে তাঁর বাড়িতে আড্ডায় তা নিয়ে অনেক হাসাহাসিও হলো। আসলেই কি ক্রিকেটে চীনের কোনো ভবিষ্যৎ আছে? ‘খুবই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। ক্লাসের সবচেয়ে মোটা, সবচেয়ে আনফিট, সবচেয়ে গাধা ছাত্রটা ক্রিকেটে আসে’—প্রথম কথাটা এমন গম্ভীর ভঙ্গিতে বলেছিলেন যে পরের কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগল। আমিনুলের হাসিতে যোগ দিতে তাই একটু দেরি হয়ে গেল।
ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকার পরও নিজের ক্যারিয়ার, নিজের অর্জন নিয়ে কথা বলতে অনীহার কারণটাও জানি। তীব্র অভিমান! অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির পর আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কমপক্ষে ২০টা টেস্ট খেলতে চাই, ৬০-৬৫টা ওয়ানডে।’ খেলতে পেরেছেন ১৩টি টেস্ট আর ৩৯টি ওয়ানডে। নিজের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার যন্ত্রণা এত দিন পরও তাঁকে কুরে কুরে খায়। বাংলাদেশকে তাঁর আরও অনেক কিছু দেওয়ার ছিল, এই আক্ষেপও মুহূর্তের জন্য দূর করতে পারেন না মন থেকে। এই অভিমান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরও নেননি। কী আশ্চর্য, ক্যারিয়ারের ‘অকাল’ সমাপ্তির জন্য তিনি দায়ী করেন আমাকেও! যা শুনে একবার তাঁকে বলেছিলাম, ‘আপনি তো না বুঝেই আমাকে অনেক বড় কমপ্লিমেন্ট দিয়ে ফেলছেন। আপনি হলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের লেজেন্ড, আর আমি এক তুচ্ছ সাংবাদিক নাকি আপনার ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছি!’ আমিনুল কনভিন্সড হয়েছেন বলে মনে হয়নি। হলে আমাকে ফেসবুকে আনফ্রেন্ড করে দিতেন না। সেটিও আমি টের পেয়েছি ঘটনাচক্রে। ২০০১ সালের ওই জিম্বাবুয়ে সফরে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া ফলস দেখতে গিয়ে দুপাশে মেহরাব হোসেন অপি আর আমিনুলকে নিয়ে একটা ছবি তুলেছিলাম। ছবিটার ঐতিহাসিক মূল্যের কথা ভেবেই। এক পাশে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান, অন্য পাশে টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম। দুজনের মাঝখানে হাইফেন হয়ে থাকতে পারাটাই আমার কাছে বড় গর্বের ব্যাপার। সেই ছবি ফেসবুকে আপলোড করে আমিনুলকে ট্যাগ করতে গিয়ে আর পারি না। অবাক হয়ে দেখি, আমিনুল আর আমার ফ্রেন্ড লিস্টে নেই। নিশ্চয়ই কোনো ভুল-টুল হয়েছে ভেবে তাঁকে নতুন করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম। তাতে সাড়া পাওয়ার বদলে ইনবক্সে আমিনুলের একটা মেসেজ পেলাম। সেটি ডিলিট করিনি বলে হুবহু তুলে দিতে পারছি, ‘শুভ্রদা, আপনার সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নাই। আপনি অনেক লেখা লিখেছেন আমাকে নিয়ে। তার একটি “বুলবুলকে মনে রাখতে হবে শুধুই খেলার কারণে নয়” আমি এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছি। কিন্তু যখন মনে পড়ে যায় কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের ডিউরিং ২০০১ থেকে ২০০৩, যার বোঝা এখনো বয়ে চলেছে বাংলাদেশ, তখন আমার সব রাগ আপনার ওপরে গিয়ে পড়ে। খুব মনে পড়ে আমার ফার্স্ট টেস্টে সেঞ্চুরির জাস্ট পরের সিরিজেই আপনি আর আল আমিন ( ডেইলি স্টার -এর সাংবাদিক) হারারেতে ইয়াং টিমের জন্য ওয়্যার ডিক্লেয়ার করলেন অনেকটা বুশের মতো। অনেক উদাহরণের মধ্যে একটা ছোট উদাহরণ দিলাম। কীভাবে ভুলি আমি এসব? কী যায় আসে আমি যদি আপনার বন্ধু না হই? আপনি ভালো থাকবেন।’
এই মেসেজ ২০১১ সালের। ফেসবুকের চোখে আমিনুল এখনো আমার বন্ধু নন। মাঝের সময়টায় অনেকবারই দেখা হয়েছে। আড্ডা হয়েছে। সিডনি আর মেলবোর্নে আমিনুলের বাড়িতে যাওয়ার কথা তো বললামই। আমিনুলকে শুধু ওই ‘কী আসে যায়...’ প্রশ্নটার উত্তর দিতে যাইনি। বলিনি, আপনি আমার বন্ধু না হলে আমার অনেক কিছুই আসে যায়। আমার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারের হিরণ্ময় কত স্মৃতি আপনার দেওয়া উপহার। সেসব আমি ভুলে গেছি নাকি! আর বন্ধুত্ব তো ছিলই। বন্ধুর বই পড়তে নিয়ে তো ফেরত না দিলেও চলে। আমিই যেমন আপনার কাছ থেকে ইয়ান চ্যাপেলের আত্মজীবনীটা নিয়ে আর ফেরত দিইনি!
এই যে ‘আমিনুল’ ‘আমিনুল’ করে লিখছি, এতেও তো কেমন অস্বস্তি হচ্ছে! বারবার ‘বুলবুল’ লিখে ব্যাক স্পেস দিতে হচ্ছে। বাকি লেখাটায় তাহলে ‘বুলবুল’ই লিখি। বুলবুলের ব্যাটিং প্রথম মন কাড়ার দিনক্ষণটাও আমার পরিষ্কার মনে আছে। সেটি টেলিভিশনে দেখা। ১৯৮৮ এশিয়া কাপে ঢাকায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ। রুমেশ রত্নায়েকের ফাস্ট বোলিংয়ে থরহরিকম্পমান বাংলাদেশ ৬২ রানে হারিয়ে ফেলেছে ৬ উইকেট। সাদা হেলমেট মাথায় ছোটখাটো এক ব্যাটসম্যান নামলেন এরপর। নেমেই রুমেশ রত্নায়েকের বাউন্সারে হুক। সেই ম্যাচে ২৭ রান করেছিলেন বুলবুল। রানটা এখানে মুখ্য নয়, যদিও এই ২৭-ই ছিল বাংলাদেশের ইনিংসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (সর্বোচ্চ আতহার আলী খানের ৩০)। আমার চোখ কেড়েছিল বুলবুলের ব্যাটিং করার ধরন। কে জানে, হয়তো বা রুমেশ রত্নায়েকেকে অমন পাল্টা জবাব দেওয়াটাই। এখন আর এসব ব্যাপার নয়, সাকিব-তামিমরা আকসারই এমন করেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের হাঁটি হাঁটি পা পা সেই সময়ে অমন ছোটখাটো জিনিসই মনে দাগ কেটে যেত।
তাঁর ব্যাটিং দেখে মু্গ্ধতার সেই প্রথম স্মৃতির কথা বুলবুলও জানেন। ফেসবুকে পাঠানো মেসেজে ‘বুলবুলকে মনে রাখতে হবে শুধুই খেলার কারণে নয়’ শিরোনামে যে লেখাটার কথা বলেছেন, সেটি শুরুই হয়েছিল ওই ঘটনা দিয়ে। লেখাটার বিষয় ক্রিকেটার বুলবুল হলেও আমি বলতে চেয়েছিলাম, খেলার কারণে তো বটেই, বুলবুলকে মনে রাখতে হবে মাঠে ও মাঠের বাইরে তাঁর আচার-আচরণ, ক্রিকেট নিয়ে পড়াশোনা, অন্য দেশের ক্রিকেটারদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ—এসবের জন্যও। শুধু ক্রিকেটার বুলবুলকে নিয়ে লিখলে অবশ্যই তাঁর মা ফোন করে আবেগময় প্রতিক্রিয়া জানাতেন না।

সেই সময়টায় বাংলাদেশ কালেভদ্রে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ পায়। মূলত দুই বছর পরপর, কখনো-বা আরও বেশি বিরতি দিয়ে আসা এশিয়া কাপে। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটের মুখ’ হয়ে উঠেছিলেন বুলবুল। আইসিসি ট্রফি জিতে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার আগে এশিয়া কাপের বাইরে ওয়ানডে খেলার একটাই সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালে শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপে। যেখানে বাংলাদেশের গ্রুপে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। অন্য গ্রুপে এশিয়ার তিন টেস্ট খেলুড়ে দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। ওই টুর্নামেন্টে এত রথী-মহারথীর ভিড়ে শুধু দুজন ব্যাটসম্যানের কোনো ব্যাটিং অ্যাভারেজ ছিল না। তাঁরা যে আউটই হননি! এঁদের একজন পাকিস্তানি লেগ স্পিনার মুশতাক আহমেদের (দুই ইনিংস মিলিয়ে ২১ রান) নামটা ধর্তব্য নয়। বুলবুলের ঘটনা তা নয়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০ রান করে অপরাজিত থাকার পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচেও অপরাজিত ৪১। ওই সময়ে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের ওই রানকে এখনকার প্রেক্ষাপটে বুঝতে দুই, এমনকি তিন দিয়ে গুণ করতে হয়।
বুলবুল ছিলেন তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা এক ক্রিকেটার। ১৯৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ইয়ুথ ওয়ার্ল্ড কাপে ডাক পাওয়াও এর একটি প্রমাণ। সে সময়কার টেস্ট খেলুড়ে সাতটি দেশের সঙ্গে টুর্নামেন্টের অষ্টম দল গড়া হয়েছিল আইসিসির সহযোগী সদস্যদেশগুলোর খেলোয়াড়দের নিয়ে। ব্রায়ান লারা, ইনজামাম-উল হক, মাইক আথারটন, নাসের হুসেইনের মতো ক্রিকেটারের আগমনী বার্তা শুনিয়েছিল সেই যুব বিশ্বকাপ। যেটিতে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ব্যাটিংয়ে মনে রাখার মতো কিছু করতে পারেননি। তবে অফ স্পিন বোলিংয়ে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি যত দিন গেছে. ততই আরও বেশি করে মনে রাখার মতো হয়ে উঠেছে। উইকেটটি ছিল ব্রায়ান লারার।
আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে বাংলাদেশে যখন ‘যুদ্ধ’ লেগে যায়, সেই সময়ে গাজী আশরাফ হোসেন লিপু আবাহনীর অধিনায়ক, বুলবুল মোহামেডানের। প্রথাগত প্রিভিউয়ে একটু বৈচিত্র্য আনতে এই ম্যাচের আগে দুই অধিনায়কের কলাম ছাপতে শুরু করলাম। গাজী আশরাফের লেখাটা দু-একবার অনুলিখন করতে হয়েছে, তবে বুলবুল তাঁর লেখাটা সব সময় নিজেই লিখেছেন।
বুলবুলের আরেকটি ‘প্রথম’-এর কথাও মনে পড়ে। ১৯৯১-ই হবে। অস্ট্রেলিয়ায় খেলে দেশে ফিরেছেন বুলবুল। অস্ট্রেলিয়ান অনেক ক্রিকেটারের সঙ্গেই দেখা হয়েছে সেখানে। এর মধ্যে গ্রাহাম ইয়ালপের সঙ্গে লম্বা সময় কাটিয়েছেন। বুলবুলের মুখে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৩৯ টেস্ট খেলা ইয়ালপের গল্প শুনতে শুনতে কী ভেবে যেন বললাম, ‘লিখে ফেলেন না এই অভিজ্ঞতার কথা!’ বুলবুল লিখলেনও। আমি তখন অধুনালুপ্ত আজকের কাগজ পত্রিকায় কাজ করি। বুলবুলের সেই লেখা ছাপাও হয়ে গেল। এমন গোছানো লেখা যে বলতে গেলে সম্পাদনার প্রয়োজনই পড়েনি। আমার জানামতে এটাই সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারের প্রথম কলাম। পরে যা তিনি নিয়মিতই লিখেছেন। আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে বাংলাদেশে যখন ‘যুদ্ধ’ লেগে যায়, সেই সময়ে গাজী আশরাফ হোসেন লিপু আবাহনীর অধিনায়ক, বুলবুল মোহামেডানের। প্রথাগত প্রিভিউয়ে একটু বৈচিত্র্য আনতে এই ম্যাচের আগে দুই অধিনায়কের কলাম ছাপতে শুরু করলাম। গাজী আশরাফের লেখাটা দু-একবার অনুলিখন করতে হয়েছে, তবে বুলবুল তাঁর লেখাটা সব সময় নিজেই লিখেছেন।
বুলবুলের সঙ্গে যে অম্লমধুর সম্পর্কের কথা বলেছি, সেটির শুরুও এই আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ দিয়েই। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক এ দেশে ক্রিকেট জাগরণের সাক্ষী। যে জাগরণের মশাল ছিল আবাহনী-মোহামেডানের হাতে। বিশ্ব ক্রিকেটের বড় বড় তারকা তখন ঢাকার ক্রিকেটে নিয়মিত অতিথি। রমন লাম্বা, অতুলা সামারাসেকারা, নিল ফেয়ারব্রাদার, রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ, অজয় জাদেজা, সনাৎ জয়াসুরিয়া, ওয়াসিম আকরাম...অন্তহীন সব তারার মিছিল। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে পনেরো-বিশ হাজার দর্শক হয়। মাঠে খেলা করে বিদ্যুৎ। এক অর্থে আবহটা এখনকার বাংলাদেশের ম্যাচের চেয়েও বেশি বিদ্যুতায়িত। বাংলাদেশের ম্যাচে তো দর্শকেরা সব এক দলে। আবাহনী-মোহামেডানে পরিষ্কার দুই ভাগ। সেই আবহের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নিয়মিতই ক্ল্যাসিক উপহার দিত আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ। উত্তেজনায় থরথর নখ কামড়ানো সমাপ্তি পরিণত হয়েছিল নিয়মে। ১৯৯৫-’৯৬ এর দিকে টানা চারটি আবাহনী-মোহামেডানের শেষটায় এমন অবিশ্বাস্য মিল ছিল, যেন ক্রিকেট-বিধাতা নিজ হাতে সেগুলোর পাণ্ডুলিপি লিখেছেন।
চারটি ম্যাচেরই নিষ্পত্তি শেষ ওভারে। চারটিতেই জয়ী এর আগে আবাহনীর কাছে টানা ছয় ম্যাচে হারা মোহামেডান। প্রথমটিতে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান ২ উইকেট। সর্বশেষ তিনটিতে ১ উইকেট। এই তিনটি ম্যাচে আরেকটি অবিশ্বাস্য মিল, প্রতিবারই ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান মোর্শেদ আলী খান সুমনকে সঙ্গে নিয়ে ম্যাচ জিতিয়েছেন বুলবুল। ৫৮ বলে অপরাজিত ৭৫, ৬৪ বলে অপরাজিত ৬৩, ১১৬ বলে অপরাজিত ৯৯—বুলবুলের ম্যাচ জেতানো তিনটি ইনিংসে আরেকটি মিল, তিনটিতেই শুরুর দিকে তাঁর ক্যাচ পড়েছে। শেষ ম্যাচটিতে তো কোনো রান করার আগেই। অবধারিতভাবেই তাই আমার ম্যাচ রিপোর্টের শিরোনাম হলো: আবারও ‘লাইফ’ পেলেন বুলবুল, আবারও জেতালেন মোহামেডানকে। বিকেলে কী একটা কাজে বুলবুলকে ফোন করেছি। কথা শুরু করেছি রসিকতা দিয়ে, ‘কী, ফিল্ডারদের কত টাকা দেন? খালি আপনার ক্যাচ ফেলে।’ উল্টো প্রান্ত থেকে প্রত্যাশিত হাসি আর পাল্টা রসিকতার বদলে বুলবুলের কণ্ঠ অসম্ভব গম্ভীর। ‘হা-হু’র বাইরে কথাই বললেন না। পরে শুনলাম, বিকেলে মোহামেডান ক্লাবে যাওয়ার পর কর্মকর্তারা তাঁর কান ভারী করেছেন, ‘খুব তো খাতির তোমার সঙ্গে। দেখেছ, কী লিখেছে! তুমি নাকি ফিল্ডারদের দয়ায় রান করো।’
পুরোটা শুনে এমন মন খারাপ হলো যে পরের দিনের পত্রিকায় একটা লেখাই লিখে ফেললাম। ‘কিছু কাকতালীয় ঘটনা ও অদ্ভুত ভুল বোঝা’ শিরোনামের শেষটা ছিল বুলবুলের উদ্দেশেই, ‘লাইফ’ পাওয়া ক্রিকেটেরই অংশ। তিনটি লাইফকেই কাজে লাগিয়েছেন জাতীয় দলের সহ-অধিনায়ক এবং তা লাগিয়েছেন বলেই এগুলোর কথা বারবার ফিরে আসে। ক্রিকেটে ‘লাইফ’ পাওয়া খুব বিরল ঘটনা নয়, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা অপচয় করেন ব্যাটসম্যান, মানুষের স্মৃতি থেকেও তাই তা মুছে যায় খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু বুলবুলের মতো কেউ যখন একটা ভুলের জন্য প্রতিপক্ষকে এমন চরম দণ্ড দেন, তখন তা নিয়ে আলোচনা চলে অনেক দিন। অথচ এতে নাকি ব্যাটসম্যানটিকে খাটো করা হয়, এমন ভুলও বোঝে অনেকে।
লেখাটায় কাজ হয়েছিল। বুলবুলের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টার সহজ সম্পর্ক ফিরে এসেছিল আবারও। তাঁর মাত্রা ছাড়ানো স্পর্শকাতরতার প্রমাণ অবশ্য এরপরও বেশ কবারই পেয়েছি। অভিষেক টেস্টের দল থেকে হাবিবুল বাশারের বাদ পড়ার প্রতিবাদ জানিয়ে লেখাটায় প্রাসঙ্গিকভাবেই তাঁর সাম্প্রতিক অতীতের পারফরম্যান্সের কথা এসেছিল। কিছুদিন আগে কেনিয়ায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ভালো ব্যাটিং করতে করতে বুলবুলের ভুলেই রান আউট হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গও। এরপর বুলবুলের সঙ্গে প্রথম দেখা বিকেএসপিতে। অভিষেক টেস্টের ক্যাম্প চলছে সেখানে। দেখা হতেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে মেশানো কথা বলায় মাস্টার বুলবুল। মাত্রই অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন। বেচারার এমনিতেই মন খারাপ। আমি তাই নীরবে হজম করে গেলাম। লেখা নিয়ে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া এর আগে-পরে বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারের কাছ থেকেই পাইনি।
বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপের অধিনায়ক তিনি। যে বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে টেস্ট স্ট্যাটাসের সিঁড়িতে পা রাখা। অভিষেক টেস্টে অধিনায়কত্ব করার স্বপ্ন দেখাটাই ছিল তাই স্বাভাবিক। ফর্মহীনতার কারণে তাঁকে বাদ দিয়ে অধিনায়ক করা হলো নাঈমুর রহমানকে। বুলবুল সেই খবরটা পেলেন ইংল্যান্ডে বসে। প্রচণ্ড মন খারাপ করা সেই দিনটির কথা পরে শুনেছি তাঁর কাছে। ইংল্যান্ডে যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেটির মালিক এক টেলিভিশন সাংবাদিক। বুলবুলের জন্য তিনি ইয়ান বোথামের খেলার কিছু ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে এলেন। বুলবুলকে তা দিয়ে বললেন, ‘এগুলো দেখো। ক্যাপ্টেনসি যাওয়ার পর বোথাম আরও ভালো খেলেছে।’
অনেক দিন ব্যাটে রান নেই বলে অভিষেক টেস্টে তাঁর খেলা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। বুলবুল সেঞ্চুরি করার পর সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন অধিনায়ক নাঈমুর রহমান। বুলবুলকে একাদশে রাখতে যে একরকম লড়াই-ই করতে হয়েছিল তাঁকে। দ্বিতীয় টেস্টেও সেঞ্চুরি প্রায় করেই ফেলেছিলেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বুলাওয়েতে আউট হয়ে যান ৮৪ রানে। দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে অনভ্যস্ত বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একেবারেই অনুপস্থিত টেস্ট মেজাজ সেই ইনিংসেও ফুটে বেরিয়েছিল শুধু বুলবুলের ব্যাটেই। প্রায় পৌনে পাঁচ ঘণ্টা ব্যাটিং করেছিলেন, বল খেলেছিলেন ঠিক ২০০টি।
একদিক থেকে অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। সীমিত ওভারের ম্যাচেও বুলবুলের ব্যাটিংয়ে এমন একটা গোছানো ব্যাপার চোখে পড়ত, যেটিকে এককথায় বলা যায় ক্ল্যাসিকাল ব্যাটসম্যানশিপ। যে কারণে যখন বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার নামগন্ধও নেই, তখনো আতহার আলী খান বুলবুলের কথা উঠলেই বলতেন, ‘হি ইজ টেস্ট ক্লাস।’ জেনুইন পেসে একটু দুর্বলতা ছাড়া বুলবুলের ব্যাটিংয়ে বলতে গেলে কোনো খুঁতই ছিল না। প্রথাগত সব শটই ছিল হাতে। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দ ছিল, উইকেট থেকে বেরিয়ে এসে স্পিনারদের বলে মারা তাঁর একস্ট্রা কাভার ড্রাইভ। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে নিয়মিত প্যাডল সুইপ মারতেও তাঁকেই প্রথম দেখেছি। এই দুটি শট খেললেই বোঝা যেত, বুলবুল আজ ছন্দে আছেন। অভিষেক টেস্টে ওই ইনিংসে বাংলাদেশের বর্তমান স্পিন বোলিং কোচ সুনীল যোশির বলে একস্ট্রা কাভার ড্রাইভেই তাঁর হাফ সেঞ্চুরি। পরদিন সেঞ্চুরির পর রাতে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে টিম হোটেলে গিয়েছি। বুলবুলের রুমে গিয়ে সেই টেস্টে আমন্ত্রিত বাংলাদেশের সাবেক কোচ গর্ডন গ্রিনিজকেও পেলাম।
গ্রিনিজও ওই শটের কথা আলাদা করে বললেন, ‘ওই শটটাই বুঝিয়ে দিয়েছে, তুমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছ।’
আমি বললাম, ‘এটা তো বুলবুলের পেট শট।’
গ্রিনিজের জবাবটাই বুঝিয়ে দিল ওই টেস্টের আগে বুলবুলের ব্যাটের দহনকালকে, ‘পেট শট! গত বছর দেড়েক ও এই শট খেলেছে কি না সন্দেহ!’
টেস্টের প্রথম দিন শেষে বুলবুল ৭০ রানে অপরাজিত। বেলা ১১টার দিকে উইকেটের দিকে হেঁটে যাওয়া কম্পমান ব্যাটসম্যানের সঙ্গে তখন তাঁর আকাশ-পাতাল পার্থক্য। হোটেলে ফেরার পর লিফটে সৌরভ গাঙ্গুলীর সঙ্গে দেখা। ভারতীয় অধিনায়ক হুমকির সুরে বলেছেন, ‘কাল সকালেই নতুন বল নেব।’ বুলবুল জবাব দিয়েছেন, ‘তোমার যা ইচ্ছা কোরো। আমি সেঞ্চুরি করব।’

ব্যাট করতে নামার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর—২০০০ সালের ১১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪ মিনিটে বাঁহাতি স্পিনার মুরালি কার্তিককে সুইপ করে স্কয়ার লেগ বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে তা করলেনও। দিন-তারিখ-ক্ষণ এমন সুনির্দিষ্টভাবে নথিবদ্ধ করে রাখার কারণ আছে। এটা ঐতিহাসিক দাবি। এটি তো আর দশটা সেঞ্চুরির মতো নয়। আজ থেকে অনেক বছর পরও যে এর খোঁজ পড়বে। তাহলে আরেকটু বিস্তারিতই বলি। ৬ ঘণ্টা ২৯ মিনিটে ওই সেঞ্চুরি, খেলেছেন ২৮২ বল। যাঁর ওই টেস্টে খেলাই অনিশ্চিত ছিল, তাঁর ব্যাটিং দেখে ইয়ান চ্যাপেল বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে ছেলেটা ৫০তম টেস্ট খেলছে!’
মনে হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। বুলবুলের ওই ইনিংস আসলে সব যুক্তি-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ডটি হারিয়ে ফেলেছেন চার বছরের মধ্যেই। কিন্তু তাঁর ৩৮০ বল খেলার রেকর্ড ভাঙতে লেগেছে প্রায় ১৩ বছর। আর সময়ের হিসাবে দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ডটি তো ভেঙেছে এই সেদিন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মুশফিকুর রহিমের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংসে। ১৯৯৯ সালে আমারই নেওয়া বুলবুলের পুরোনো একটা সাক্ষাৎকারে দেখছি, টেস্ট খেলার স্বপ্ন দেখেন কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলছেন, ‘আগে কয়েকটি তিন/চার দিনের ম্যাচ খেলে নিই।’ বছর ঘুরতে না-ঘুরতেই সেই বুলবুল কীভাবে টেস্ট ক্রিকেটের অচেনা ভুবনে পা রেখেই প্রায় নয় ঘণ্টা ব্যাটিং করে ফেললেন, এই বিস্ময় আমার এখনো যায় না!
বুলবুলের ওই সেঞ্চুরি আরেক দিক থেকেও অনন্য। যেদিন সেঞ্চুরি করলেন, শবে বরাত উপলক্ষে সংবাদপত্রে ছুটি। এমন একটা কীর্তি হয়ে গেল, আর সেটির কোনো চিহ্ন থাকবে না! প্রেসবক্সে সাংবাদিকেরা তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা বিশেষ বুলেটিন বের করে ফেললেন। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের লেখা দিয়ে সাজানো সেই বুলেটিনটির নাম ছিল ‘প্রেসবক্স’।
১৩ টেস্ট আর ৩৯ ওয়ানডেতেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার পেছনে বুলবুল ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজতে পারেন, তবে বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। প্রথম দুই টেস্টে ১৪৫ আর ৮৪-এর পরের ১১ টেস্টে তাঁর মাত্র একটিই হাফ সেঞ্চুরি। সেটি মোহাম্মদ আশরাফুলের অভিষেকেই ইতিহাস গড়ার ওই টেস্টে। পরের বছর সেই শ্রীলঙ্কাতেই প্রথম টেস্টে ‘পেয়ার’ পাওয়ার পর প্রথম বাদ পড়েন টেস্ট দল থেকে। এরপর আর একটি টেস্টই খেলার সুযোগ পেয়েছেন। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঢাকায় দুই ইনিংসে ৫ ও ১২ রান করার পর নির্বাচকেরা আর ফিরে তাকাননি তাঁর দিকে।
ওই টেস্টটাও খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ‘ট্রায়াল’ উতরেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের আগে ধানমন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ‘চ্যালেঞ্জ কাপ’ ছিল সে সময়ের প্রধান নির্বাচক আলিউল ইসলামের মস্তিষ্কপ্রসূত অলিখিত নির্বাচনী টুর্নামেন্ট। তিন দলের টুর্নামেন্টে একেবারেই তরুণদের নিয়ে গড়া ডেভেলপমেন্ট স্কোয়াডের ভূমিকা ছিল শুধুই ‘স্প্যারিং পার্টনার’-এর। মূল লড়াইটা কদিন আগেই দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত জাতীয় দল ও বাংলাদেশ ‘এ’ দলের মধ্যে। ‘এ’ দলে জাতীয় দলে ফেরার দাবিদার সব ক্রিকেটার, যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম বুলবুল, আকরাম ও আশরাফুল। তখনো টেস্ট খেলার আশা করে যাওয়া নান্নুও ছিলেন সেই ‘এ’ দলে। মূলত এই চারজনের ওপরই ছিল সবার চোখ। বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘তরুণ’ আর ‘বুড়ো’র মধ্যে তখন সম্মুখ সমর। সেই টুর্নামেন্টের প্রিভিউয়ে আমি তাই লিখলাম, আকরাম-বুলবুলকে নিয়ে প্রশ্ন এবং জাতীয় দলে ফিরতে এই যে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে, সেটির কারণ বয়স নয়, তাঁদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স। প্রাসঙ্গিকভাবেই দুজনের সর্বশেষ ৭/৮টি টেস্ট ইনিংসের রানও উল্লেখ করা হয়েছিল।
টুর্নামেন্টটি হয়েছিল আবাহনী মাঠ-সংলগ্ন ধানমন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। প্রথম ম্যাচ শুরুর আগে ড্রেসিংরুমের উল্টো দিকে সাংবাদিকদের জন্য টানানো অস্থায়ী তাঁবুতে যাওয়ার আগে ক্রিকেটারদের সঙ্গে ‘হাই-হ্যালো’ করতে গেছি। ড্রেসিংরুমের বারান্দায় বুলবুল তাঁর কিট ব্যাগ খুলে তৈরি হচ্ছেন। আমাকে দেখেই বললেন, ‘আপনাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। গত কিছুদিনে আমার কোন ইনিংসে কত রান, এটা আমার মনেই ছিল না। মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’
কথার সুরে তীব্র ব্যঙ্গ।
আমি তা গায়ে না মেখে উল্টো হেসে বললাম, ‘লেখাটা তো আমার নামে ছাপা হয়নি। অন্য কেউও তো লিখতে পারে।’
বুলবুল একটা তির্যক হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমি জানি, এসব কে লিখতে পারে!’
আমি সন্ধির সুরে বললাম, ‘আমি তো নির্জলা পরিসংখ্যানই তুলে ধরেছি। কোনো মন্তব্য তো করিনি।’
বুলবুলের মুখের হাসিটা বদলাল না, ‘হ্যাঁ, আপনি তো সব সময় তাই-ই করেন।’
আমি আর কথা না বাড়িয়ে সাংবাদিকদের তাঁবুর দিকে পা বাড়ালাম।
প্রধান নির্বাচক টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই বলে দিয়েছিলেন, ‘একস্ট্রা অর্ডিনারি’ কিছু করলেই শুধু কেউ দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত জাতীয় দলে ঢুকতে পারবে। ‘এ’ দলের অধিনায়ক বুলবুল জাতীয় দলের বিপক্ষে ১৩৫ রান করে সেই শর্ত পূরণ করেই আবার দলে ফিরেছিলেন। কে জানত, সেটি মাত্রই এক টেস্টের জন্য!

ওয়ানডেতে তাঁকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল আগেই। শেষটা হয়েছে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে, তবে সেটির সূচনা ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে, টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রথম সফরেই। যেটির জন্য বুলবুল আজও আমাকে দায়ী করেন। আসল ঘটনা ভিন্ন। পুরোনোদের বাদ দিয়ে তরুণদের নিয়ে ওয়ানডে দল গড়ার চিন্তার পুরোটাই ছিল কোচ ট্রেভর চ্যাপেলের মস্তিষ্কপ্রসূত। সেই সফরে বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার মাহবুবুল আনামেরও তাতে সায় ছিল। টিম হোটেলে তাঁর রুমে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে এমন একটা পথে এগোনোর পরিকল্পনা জানিয়ে সেটির পক্ষে যুক্তিও দিয়েছিলেন। আরও বুঝতে পরদিন ট্রেভর চ্যাপেলের ইন্টারভিউ করেছিলাম। পত্রিকার পুরোনো ফাইল ঘেঁটে সেই ইন্টারভিউয়ের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু খুঁজে বের করলাম। যেখানে ট্রেভর চ্যাপেল বলছেন, ‘ওয়ানডের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা ভাবছি ২০০৩ বিশ্বকাপের কথা। অন্তত ওয়ানডেতে আমরা সেরা ফিল্ডিং সাইড নামানোর চিন্তা করছি। সে জন্য অভিজ্ঞতাকে যদি স্যাক্রিফাইস করতে হয়, করব।’
সেই চিন্তা থেকেই সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডের দল থেকে বাদ পড়েন আমিনুল। হারারেতে ওই ম্যাচের আগের রাতটির কথা এখনো মনে পড়ে। ক্রাউন প্লাজা হোটেলের লবিতে বসে আছেন বুলবুল। রাত এগারোটা বাজতে চলেছে। অপেক্ষা করছেন, আকরাম ঘুমিয়ে পড়লে তবেই রুমে ফিরবেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সিঙ্গেল রুমের প্রথা তখনো শুরু হয়নি। এক দিন আগে-পরে জাতীয় দলে অভিষেকের পর থেকে প্রায় তেরো বছর ধরে আকরাম তাঁর রুমমেট। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ দল থেকে বাদ পড়েছেন। তাঁর মুখোমুখি হতে আকরামের নিশ্চয়ই অস্বস্তি হবে। সেই অস্বস্তি থেকে তাঁকে বাঁচাতেই বুলবুলের ওই অপেক্ষা। এমন সময় প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া নিষ্ঠুর হয়ে যায়। তারপরও সাংবাদিকদের এই নিষ্ঠুরতা না করে উপায় থাকে না। বুলবুল শুধু বললেন, ‘কেন বাদ পড়েছি, এটাই বুঝতে পারছি না। প্রথম ম্যাচেও আমার খেলাটা অনিশ্চিত ছিল।’
ওয়ানডে দল নিয়ে ট্রেভর চ্যাপেলের নতুন চিন্তা অনুযায়ী পরের ম্যাচে আকরাম খানেরও বাদ পড়ার কথা ছিল। কীভাবে যেন তিনি টিকে যান। একটা সূত্রে ‘কীভাবে যেন’-এর যে উত্তর পেয়েছিলাম, তা হলো বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর একটা ফোন। বুলবুলের তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণ খুঁজতে ওই বিতর্কের সময় নিজের ভূমিকা আমি বারবার খুঁটিয়ে দেখেছি। বাড়তি কিছু করেছি বলে কখনোই মনে হয়নি। সাংবাদিক হিসেবে ওয়ানডে দল নিয়ে কোচ ও ম্যানেজারের নতুন চিন্তাভাবনাটা তুলে ধরাই ছিল আমার কাজ। আমি তো শুধু সেটিই করেছিলাম। চিন্তাটা ঠিক কি বেঠিক, সেই আলোচনাতেই যাইনি। বুলবুলের মনে অমন জট পাকানোর আরেকটি কারণ অবশ্য খুঁজে পাই। দেশে ফিরে ম্যানেজার মাহবুবুল আনাম সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে বসলেন, আকরাম-বুলবুলকে বাদ দিয়ে তরুণদের নিয়ে দল গড়ার কোনো পরিকল্পনা নাকি জিম্বাবুয়েতে আলোচিতই হয়নি। তিনিও কোনো সাংবাদিককে এমন কিছু বলেননি। সেই সংবাদ সম্মেলনে আমি ছিলাম না। যে সহকর্মী ছিলেন, তাঁর কাছ থেকে এটি শোনার পর এমনই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম যে ‘ম্যানেজার সত্যি বলছেন না’ হেডিং দিয়ে ছোট্ট একটা লেখা না লিখে পারিনি।
ম্যানেজারের ডিগবাজি খাওয়া বুলবুলের ভুল বোঝার একটা কারণ হতে পারে। আরেকটা কারণও অনুমান করি। প্রায় তেরো বছর ধরে বাংলাদেশ দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকা আকরাম-বুলবুলকে বাদ দেওয়ার চিন্তাটা এমনই আলোড়ন তুলেছিল যে প্রথম আলো র সাপ্তাহিক স্টেডিয়াম পাতায় ‘সময় কি হলো তবে?’ শিরোনাম দিয়ে গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর একটা বিশেষজ্ঞ কলাম ছাপা হয়েছিল। সব মিলিয়েই হয়তো বুলবুলের মনে হয়েছে, তাঁকে বাদ দেওয়াটাকে সাংবাদিক তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডা বানিয়ে ফেলেছেন।
মনে করে থাকলে বুলবুল ভুল করেছেন। কারণ, বুলবুলকে বাদ দিয়ে আকরাম খানকে ঠিকই খেলিয়ে যাওয়ার দ্বৈত নীতির প্রতিবাদে আমি প্রথম আলো তেই লিখেছিলাম, ‘বুলবুলকে বাদ দেওয়া হয়েছিল “ভবিষ্যতের দল গড়ার” নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। সেটা যখন করা গেল না, তখন বুলবুলের কাছে ক্ষমা চেয়েই তাঁকে ফিরিয়ে আনা উচিত।’ তুলেছিলাম এই প্রশ্নও, ‘ভবিষ্যতের কথা ভাবলে বুলবুল কেন? ফিল্ডিংয়ের কথা বললে দুজনের মধ্যে বুলবুলই তো ফিল্ডার হিসেবে তুলনামূলক ভালো।’ বুলবুলের কেন যে সেসব চোখে পড়েনি!
এখন মনে হয়, মুলতানের ওই ঘটনাটারও প্রভাব থাকতে পারে। জিম্বাবুয়ে সফরের পর সেখানে পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ। আকরাম-বুলবুল দুজনই ব্যর্থ। রান করতে না পারার চেয়েও দৃষ্টিকটু তাঁদের আউট হওয়ার ধরন। তিন দিনে টেস্ট ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মাঠে দাঁড়িয়েই কোচ ট্রেভর চ্যাপেলের সঙ্গে কথা বলছি। পাশে বাংলাদেশের আরেকজন সাংবাদিক। ট্রেভর চ্যাপেলকে আমি প্রশ্ন করলাম, ‘দলের সিনিয়ররা যেভাবে আউট হচ্ছে, তাতে কি আপনার মনে হয়, ভবিষ্যতের কথা ভেবে তরুণদের সুযোগ দিলেই ভালো?’
এই প্রশ্ন থেকে বেশির ভাগ মানুষই বুঝে নেবেন, প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক বোধ হয় এমনই চাইছেন। সেটি ভুল বোঝা হবে। সাংবাদিকদের অনেক সময়ই এমন প্রশ্ন করতে হয়, যেটি হয়তো তাঁর নিজের মতের বিপরীত। কিন্তু তাঁর নিজের মতে কী আসে যায়! দলের চিন্তাভাবনাটা পাঠককে জানাতেই হয়তো নিজে যা ঠিক মনে করেন, তার উল্টো প্রশ্নটা করছেন তিনি। আমার প্রশ্নটাও সে রকমই ছিল। ট্রেভর চ্যাপেল কী উত্তর দিয়েছিলেন, মনে নেই। তবে এই প্রশ্নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া টের পেলাম করাচিতে এসে। পাকিস্তান থেকে পরের টেস্ট খেলতে শ্রীলঙ্কা যাবে বাংলাদেশ, কিন্তু দলের ফ্লাইট তো ঠিক করা হয়েছে পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচ ধরে। প্র্যাকটিসের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে বাংলাদেশ দল বাড়তি দুই দিন করাচিতে থাকল। আমিও একই হোটেলে। রুমে চেক-ইন করে লবিতে নামতেই আকরাম খানের সঙ্গে দেখা। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘কী ব্যাপার, আপনি নাকি আমাদের বাদ দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন!’ আমি বুঝে ফেললাম, রংচং মিশিয়ে জায়গামতো খবর চলে গেছে। ট্রেভর চ্যাপেলের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় আমাদের দুজনের বাইরে একজনই ছিলেন, তাই সংবাদদাতার পরিচয় সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতেও সমস্যা হলো না। আকরামের সবকিছু সহজভাবে নেওয়ার একটা ক্ষমতা আছে। তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়াতেই তীব্রতা থাকে না। এখনো যেমন থাকে না, তখনো ছিল না। বুঝিয়ে বলাতে তিনি বুঝলেন বলেই মনে হলো। নইলে তাঁর রুমে আমন্ত্রণ জানাবেন কেন! রুমে ঢুকতেই বুলবুলের সঙ্গে দেখা। কুশল জিজ্ঞাসার জবাবে দায়সারা কী একটা বলে তিনি বাথরুমে ঢুকে গেলেন। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলব বলে বসে আছি তো বসেই আছি। ‘কী ব্যাপার, বুলবুল কি বাথরুমে ঘুমিয়ে পড়ল নাকি’—আমার রসিকতার জবাবে আকরাম বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। আপনি বরং আজ চলেই যান। আপনি না যাওয়া পর্যন্ত বুলবুল বেরোবে না।’
কেন যেন এখনো বুলবুলের সঙ্গে দেখা হলে সব স্মৃতি ছাপিয়ে করাচি পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেলের ওই ঘটনাটাই সবার আগে মনে পড়ে। বুলবুল, মনে আছে আপনার?