
প্রস্তাবিত বাজেটের আকার কমালেও উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আহরণের প্রাক্কলন করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাজেটে আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আসবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে। স্বাভাবিক স্থিতিশীল পরিস্থিতিতেও এই উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা সংস্থাটির নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বাজেটে করজাল বাড়ানোর ঘোষণা থাকলেও আদতে করভার বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন উত্তরণ ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক সামাল দিতে বহু পণ্যের শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। এতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এর বাইরে করবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ও কঠিন হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ব্যয়ের লাগাম টানতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। এই বাজেটে আয়ের ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ আসবে এনবিআরের মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে আসবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান সরকার এই লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে। এরই মধ্যে অর্থবছরের ১১ মাস পেরিয়ে গেছে। আলোচ্য সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। সরকারের দেওয়া সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে এক মাসে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৪২ হাজার ৫০ কোটি টাকা, যা অসম্ভব বলে জানিয়েছেন খোদ এনবিআর কর্মকর্তারা। চলতি অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে বলেও মনে করেন তারা। এই পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার, যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও আদায় করা সম্ভব নয়। এনবিআরের বাইরেও ৬৫ হাজার কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই রাজস্ব আহরণও কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা এক কথায় অর্জন করা অসম্ভব। কারণ দেশের স্বাভাবিক সময়েও রাজস্ব আহরণের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। এর বাইরের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেটা অর্জন করা কঠিন বলেও জানান এ অর্থনীতিবিদ।
অর্থ উপদেষ্টা প্রস্তাবিত বাজেটে কর বাড়াতে সাধারণ মানুষের জন্য আয়করে ছাড় দেননি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকাই রেখেছেন। তবে ভবিষ্যতের রূপরেখা দিয়েছেন। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করেছেন। অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে এই সীমা প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে করজাল না বাড়লেও মধ্যবিত্তের করের বোঝা বাড়ছে। তবে কর বাড়ানোর জায়গায় অর্থ উপদেষ্টা বিত্তশালীদের ছাড় দিয়েছেন। বড়লোকদের সারচার্জের হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে বিত্তশালীদের কর ভার কমবে। অন্যদিকে বিত্তশালীদের পছন্দের ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর পরিবেশ সারচার্জ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩৩ সেবার বিপরীতে রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতায় শিথিলতা আনা হয়েছে। এতে নতুন করে এসব সেবাগ্রহণের জন্য রিটার্নের আওতায় আসার সুযোগও বন্ধ হয়ে গেল। শুধু কর অফিস বাড়িয়ে করজাল বাড়ানোর পরিকল্পনা আদতে কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া আয়করের বেশিরভাগ অর্থ আসে উৎসে কর এবং অডিট থেকে। কারণ হিসেবে কর কর্মকর্তারা বলছেন, অডিট নিয়ে হয়রানির কিছু অভিযোগ থাকলেও সরকারের বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়। এক্ষেত্রে আরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এতে আয়কর আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ঘাটতি তৈরি হবে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের এনবিআরের মাধ্যমে আদায় করা রাজস্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে পরোক্ষ করে। অর্থাৎ ভোক্তার করে জোর বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণে ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং আয়কর খাতের লক্ষ্যমাত্রা ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বাজেটে রাজস্ব আহরণের প্রধান খাত হিসেবে ভ্যাটকে বিবেচনায় নেওয়ায় আঘাত আসতে পারে মূল্যস্ফীতিতেও। এ ছাড়া বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না থাকায় নতুন অর্থবছরের রাজস্ব আহরণ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যদিও গতকাল মঙ্গলবার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এবারের বাজেট মানুষের বাজেট। মানুষের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সীমিত সম্পদের মধ্যে এ বাজেট করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ব্যবসাবান্ধব কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেই। আর নতুন করে এলডিসি উত্তরণের জন্য শুল্ক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। নতুন করে কর অব্যাহতি তুলে দেওয়ায় খরচ বাড়ারও আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না বাড়লে পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে বলেও জানান তারা।
রাজস্ব আহরণ নিয়ে বাজেট পর্যালোচনায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সব সময় রাজস্ব আদায় একই ধারায় রয়েছে। এবারও উচ্চ আকাঙ্ক্ষার রাজস্ব আহরণ বাজেটের বড় চিন্তার বিষয়। ১০ বছর ধরেই আমরা দেখছি, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না।