
শুধু গত পাঁচ আসরেই স্পট ফিক্সিং হয়েছে, এমন সন্দেহ করার মতো ঘটনা ১৪০টির মতো। এবারের মৌসুমে এ রকম ঘটনা ছিল ৩৬টি। সন্দেহভাজন স্থানীয় ও বিদেশি খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৬০-এর বেশি, কারও কারও নামে অভিযোগ এসেছে দু-তিনবারও।
ছোট্ট এ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, স্পট ফিক্সিংয়ের বিষবাষ্প দেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে (বিপিএল) কতটা ছেয়ে ফেলেছে।
ব্যাপ্তিটা টাকার অঙ্কেই জানা যাক। বাংলাদেশে বেটিং অবৈধ হলেও অনেক দেশেই বৈধ। বেটিং ওয়েবসাইটগুলোতে দেওয়া থাকে বিপিএলের ম্যাচের লিংক; বিপিএলের লোগোসহ আগে থেকেই যেগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচার করে সেসব ওয়েবসাইট। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদেশে বেটিংয়ের বৈধ বাজারে প্রতিটি বিপিএল ম্যাচকে ঘিরে ৫০-৬০ লাখ ডলারের লেনদেন হয়। অবৈধ বাজারে অঙ্কটা এর চেয়ে ৯-১০ গুণ বেশি। অর্থাৎ বিপিএলের একটি ম্যাচের বেটিংকে কেন্দ্র করে সব মিলিয়ে ৫-৬ কোটি ডলারের লেনদেন চলে।
* সর্বশেষ আসরেই ৩৬টি অভিযোগ
* সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ৪টি ফ্র্যাঞ্চাইজির
* পাঁচ আসরে ৬০ জনের বেশি সন্দেহভাজন খেলোয়াড়
বিপিএল: ‘বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত লিগ’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) দুর্নীতি দমন ইউনিট নিয়মিতই চোখ রাখে বিপিএলের ওপর। প্রতিটি আসরেই তারা সন্দেহজনক ঘটনা এবং সন্দেহভাজন ক্রিকেটারদের তালিকা পাঠায় বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের কাছে। ২০১৩ সালের বিপিএল ব্যতিক্রম, নইলে এসব ঘটনা খতিয়ে দেখার কার্যকর উদ্যোগ এরপর আর তেমন দেখা যায়নি। ২০১৩ সালেও মূলত আইসিসির চাপেই তদন্ত করে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িতদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তদন্তে অনীহা বা অপারগতা এবং কখনো কখনো উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে সামনে আসেনি অনেক কিছুই। বিপিএলে স্পট ফিক্সিংয়ের ঘটনা ঘটছে, আইসিসি থেকে বিসিবির সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সেগুলো জানানো হচ্ছে অথচ তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না—বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সংশ্লিষ্টদের কাছে বিপিএল এরই মধ্যে ‘বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত’ ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হিসেবে দুর্নাম কুড়িয়ে ফেলেছে।
আবারও বিসিবির তদন্ত কমিটি
গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সর্বশেষ একাদশ বিপিএলে ওঠা স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ তদন্তে অবশ্য দৃশ্যমান উদ্যোগ নিয়েছে ফারুক আহমেদের নেতৃত্বাধীন বিসিবির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের স্বাধীন তদন্ত কমিটি। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দারকে প্রধান করে গঠিত কমিটির অপর দুই সদস্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. খালেদ এইচ চৌধুরী এবং সাবেক ক্রিকেটার শাকিল কাসেম। শাকিল কাসেম ২০১৩ সালের বিপিএলের ফিক্সিং নিয়ে গঠিত বিসিবির ট্রাইব্যুনালেরও সদস্য ছিলেন।

তদন্ত কমিটি তাদের কাজ অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে বলে জানিয়েছে বিসিবির একটি সূত্র। বিসিবির গুলশান কার্যালয়ে গত তিন মাসে কমিটি বিপিএল-সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়, কোচ, ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্মকর্তা মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছে। বর্তমানে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির প্রক্রিয়া চলমান।
তদন্ত কমিটিকে বিসিবি মূলত এবারের বিপিএলের সন্দেহজনক ঘটনাগুলোই খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দিয়েছিল। তবে তদন্তপ্রক্রিয়ায় উঠে আসা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত এবং অভিযোগ কমিটির দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়েছে টুর্নামেন্টের বিগত আসরগুলোর দিকেও। কমিটি চেষ্টা করছে প্রতিটি ঘটনাই যত দূর সম্ভব যাচাই করে এমন কিছু সুপারিশ সামনে আনতে, যাতে বিসিবি ভবিষ্যতে বিপিএলকে স্পট ফিক্সিংয়ের কলঙ্কমুক্ত করতে পারে।
আইসিসির দেওয়া তালিকায় এই পাঁচ আসরে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত সন্দেহে খেলোয়াড়দের নাম এসেছে ৬৬ বার। তবে নির্দিষ্টভাবে খেলোয়াড়দের নাম পাওয়া গেছে গত দুই আসরে। কয়েকজনের নাম একাধিকবার এসেছে বলে খেলোয়াড়ের সংখ্যা এর চেয়ে একটু কম।
পাঁচ আসরে ১৪০টি সন্দেহজনক ঘটনা এবং...
বিপিএলের গত পাঁচ আসরে ১৪০টির মতো সন্দেহ জাগানো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে বিসিবির সংশ্লিষ্ট সূত্রে। আইসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকেই এসব ঘটনা ও ব্যক্তির তালিকা বিস্তারিত বিশ্লেষণসহ বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগকে পাঠানো হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী সর্বশেষ একাদশ আসরে এ রকম ঘটনার সংখ্যা ৩৬, তার আগের মৌসুমে চিহ্নিত হয়েছে ৫০টি ঘটনা। এবারের ৩৬টি ঘটনার ৩৪টির সঙ্গেই সংশ্লিষ্টতা আছে নির্দিষ্ট তিনটি ফ্র্যাঞ্চাইজির খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের। বাকি দুটি ঘটনায় জড়িত আরেকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি।
আইসিসির দেওয়া তালিকায় এই পাঁচ আসরে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত সন্দেহে খেলোয়াড়দের নাম এসেছে ৬৬ বার। তবে নির্দিষ্টভাবে খেলোয়াড়দের নাম পাওয়া গেছে গত দুই আসরে। কয়েকজনের নাম একাধিকবার এসেছে বলে খেলোয়াড়ের সংখ্যা এর চেয়ে একটু কম। সর্বশেষ বিপিএলে সন্দেহভাজন হিসেবে যাঁদের নাম সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাঁদের অনেকেই আগের তালিকায়ও ছিলেন।
তদন্তকাজে আছে বাধাবিপত্তিও
ফিক্সিং-স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগের ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনার মতো অকাট্য তথ্যপ্রমাণ বা সাক্ষী পাওয়া সহজ নয়। একে তো শক্ত তথ্যপ্রমাণ প্রয়োজন, তার ওপর এসব ক্ষেত্রে অনেক অপ্রত্যাশিত বাধাবিপত্তিও চলে আসে সামনে। বিচারপতি হায়দারের কমিটিরও এসব সমস্যার মুখোমুখি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া তাদের হাতে তদন্তের রসদ তুলে দেওয়ার কথা যাদের, বিসিবির সেই দুর্নীতি দমন বিভাগের কাছ থেকে কমিটি যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছে কি না, প্রশ্ন আছে সেটা নিয়েও। অবশ্য আইসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছ থেকেও কমিটি প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়ে নিতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্যরা স্বাভাবিকভাবেই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সংশ্লিষ্ট অন্য একটি সূত্র বলেছে, অতীতের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিলে বিপিএলের এতটা দুর্নাম হতো না, একই খেলোয়াড় বারবার এসব করার সাহস পেতেন না।
নজরদারিতে ফাঁকফোকর
স্পট ফিক্সিং ঠেকাতে অন্যান্য দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলো নানা রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলেও বিপিএলে সেই ‘প্রটোকল’ খুবই ঢিলেঢালা। নিয়ম অনুযায়ী ম্যাচের সময় ড্রেসিংরুমে থাকা খেলোয়াড়-কর্মকর্তা-টিম স্টাফরা যাঁর যাঁর মুঠোফোন দুর্নীতি দমন বিভাগের কাছে জমা দিয়ে যান। কিন্তু সবার সঙ্গে থাকা কিট ব্যাগে আর কোনো ফোন থাকে কি না, সেটি তল্লাশি করে দেখা হয় না। টিম বয়রাও অনেক সময় তল্লাশি ছাড়াই অবাধে বাইরে যাতায়াত করেন। এ ছাড়া বিপিএলের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে থাকা দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রতিনিধিরা এ কাজে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নন বলেও মনে করেন অনেকে।
বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের দাবি
বিপিএল তদন্ত কমিটিকে সব রকম সহযোগিতা করা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রধান রাইয়ান আজাদ এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে দুর্নীতি দমন বিভাগের অন্য একটি সূত্রের দাবি, সর্বশেষ বিপিএল এবং তার আগের আসরেরও যতটুকু সম্ভব তথ্য তারা তদন্ত কমিটিকে সরবরাহ করেছে। সূত্র এ-ও বলেছে, আইসিসির প্রটোকলের কারণে সব তথ্য তাঁদের পক্ষে বাইরের কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, স্বাধীন তদন্ত কমিটিকে যেহেতু বিসিবিই দায়িত্বটা দিয়েছে, বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের কি দায়িত্ব নয় তাদের সাহায্য করা? জবাবে যা পাওয়া গেছে, তার সারমর্ম—বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগ মনে করে, এসব ঘটনা তদন্তে তাদেরই যথেষ্ট সামর্থ্য আছে।
কী থাকতে পারে তদন্ত রিপোর্টে
প্রক্রিয়া অনুযায়ী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সন্দেহভাজন খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, ফ্র্যাঞ্চাইজি এবং সন্দেহজনক ঘটনা উল্লেখ করার পাশাপাশি বেশ কিছু সুপারিশ থাকার কথা। যার অন্যতম হতে পারে, অভিযুক্ত খেলোয়াড়-কর্মকর্তা-ফ্র্যাঞ্চাইজিদের ব্যাপারে ভবিষ্যতে অধিকতর তদন্তের সুপারিশ। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক কোনো এজেন্সি বা আইসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগকে কাজে লাগানোর প্রস্তাবও থাকতে পারে।
সে ক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে লম্বা সময়ই লেগে যাবে হয়তো। সম্প্রতি বিদেশের একটি টি-টেন লিগে স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগে শাস্তি কাটানো বাংলাদেশের এক ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গঠন করতে আইসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগই সময় নিয়েছিল প্রায় দেড় বছর।
