Image description

খেলোয়াড় পরিচয়ে সবাই তাঁদের চেনেন সবাই। কিন্তু সেই পরিচয়ের বাইরে তাঁদের অন্য জীবনটা কেমন? সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই ঝটপট প্রশ্নোত্তরপর্বে সেটাই জানার চেষ্টা…

আজকের তারকা: লিটন দাস

তাঁর ব্যাটিং দেখেই ইয়ান বিশপ একবার বলেছিলেন, ‘লিটন দাস ইজ পেইন্টিং আ মোনালিসা হিয়ার’। ১০ বছরের ক্যারিয়ারে লিটন যত রান করেছেন, তার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে যেভাবে তা করেছেন। এখানে সেই লিটনের খেলার বাইরের জগত।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: উৎপল শুভ্র

প্রথম আলো

মানুষ লিটন দাসকে নিয়ে একটা রহস্য আছে। নিজেকে গুটিয়ে রাখেন, কথা কম বলেন, খুব মুডি। লিটন মানুষটা আসলে কেমন?

লিটন দাস: খুবই ফ্রেন্ডলি। যে ফ্রেন্ড, তার সঙ্গে ফ্রেন্ডলি। অচেনা মানুষের সঙ্গে একটু দূরত্ব বজায় রাখি। আমার কাছে মনে হয় যে মানুষটা অচেনা, যে মানুষটার সঙ্গে আমার কাজ নেই; আমি তার সঙ্গে কী কথা বলব। বা কেউ যদি আমার কাছে আসে কোনো কথা বলতে…এখন ধরুন, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, আমি কি কাউকে বলব, কেমন আছেন? যদি কেউ আমাকে বলে, ‘ভাই কেমন আছেন’; আমি রিপ্লাই দেব—হ্যাঁ ভাই, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? ধরুন, আমার যাঁরা ফ্রেন্ড সার্কেল, যাঁরা আমাকে চেনেন, তাঁদের সঙ্গে আমি যতটা ওপেন, স্বাভাবিকভাবেই অচেনা মানুষের সঙ্গে ততটা নয়।

 
পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে লিটনেরছবি: ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো

এটা তো সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। আচ্ছা, আপনার প্রিয় শখ কী? আপনার ফেসবুক দেখে অনুমান করছি, সেটা ঘুরে বেড়ানো। আসলেই কি তা–ই?

লিটন: ঘুরতে যাওয়াই যে প্রিয় শখ, তা না। তবে ঘুরতে ভালো লাগে। বিশেষ করে যদি কোনো সিরিজ খেলি, আমার কাছে মনে হয় এই সিরিজটাতে চাপ গেছে, তখন আমার মনে হয় মানসিকভাবে চাঙা হওয়ার জন্য অন্তত ছয়–সাত দিন একটা ব্রেক পাওয়া খুব দরকার। এ জন্য আমি বাইরে চলে যাই। যেন আমি আবার রিফ্রেশ হয়ে ফিরতে পারি।

প্রথম আলো

বেড়াতে যাওয়ার জন্য আপনার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা কোনটি? এভাবে যদি বলি, কোথায় গিয়ে সবচেয়ে ভালো লেগেছে?

লিটন: ঘোরার উদ্দেশ্যে যাওয়া হয়নি, তবে আমি যখন ইউকেতে (যুক্তরাজ্যে) খেলতে গিয়েছি, তখন এটাকে সেরা মনে হয়েছিল। ট্রাভেলিং কম, বাসে করেই এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে যাওয়া যায়। সব মিলিয়েই দারুণ।

 
প্রথম আলো

এমন কোনো জায়গা বা দেশ আছে, ভবিষ্যতে যেখানে যেতে চান?

লিটন: আগে আমি খুব শপিং মলে যেতাম। সব সময় কেনাকাটার জন্য নয়, খাওয়ার জন্যও মলে চলে যেতাম। বউকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে কোথাও গেলেও হয়তো বলতাম, ‘চলো, মল আছে, ঘুরে আসি, খেয়ে আসি।’ কিন্তু এখনকার লিটন দাস, বিশেষ করে আমার মেয়ে হওয়ার পর আমি প্রকৃতি খুব পছন্দ করি। পাহাড় বলেন, সাগর বলেন—এগুলোতেই এখন বেশি যাই।

 
লিটন দাসকে ইদানীং সবচেয়ে বেশি টানে প্রকৃতিছবি: ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো

সাগর নাকি পাহাড়, কোনটা বেশি পছন্দ?

লিটন: এ রকম কোনো পছন্দ নেই। তবে বেশি ভিড় ভালো লাগে না। নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করি।

প্রথম আলো

আপনার তো পোষা প্রাণীও আছে, তা–ই না?

লিটন: একটা খরগোশ, আর একটা কুকুর আছে। খরগোশের সঙ্গে অত ইয়ে নেই (হাসি), কুকুরটার সঙ্গে থাকতেই বেশি পছন্দ করি।

প্রথম আলো

কুকুরটার নাম কী?

লিটন: চেরি।

 
লিটনের প্রিয় পোষ্য এই কুকুর। তাঁর স্ত্রী নাম রেখেছেন চেরিইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো

নামকরণের রহস্য?

লিটন: কোনো রহস্য নেই। আমার ওয়াইফের দেওয়া নাম। ও বলল, চেরি; আমি বললাম, ঠিক আছে।

প্রথম আলো

অবসর সময়ে আপনি কী করেন?

লিটন: তেমন কিছু না। ফ্রি থাকলে পরিবারকে সময় দিই। আর যদি মন চায়, বউকে নিয়ে বাইরে যাই।

প্রথম আলো

একটু আগে বলছিলেন, আপনি গান–ফ্রিক। কী ধরনের গান বেশি শোনেন?

লিটন: নির্দিষ্ট কোনো গান না। মন যদি চায় পুরোনো দিনের বাংলা গান শুনতে, তা–ই শুনি। পুরোনো দিনের হিন্দি গান, ইংলিশ শুনলে ইংলিশ। নির্ভর করে আমার মুড কী চাচ্ছে। যাঁর গান শুনতে ইচ্ছা করে, শুনি। নির্দিষ্ট পছন্দের কেউ নেই।

প্রথম আলো

এমন কেউ কি আছেন, যাঁর সঙ্গে আপনি দেখা করতে চান?

লিটন: এ রকম কেউ নেই।

বাংলাদেশের তারকা ফুটবলার হামজা চৌধুরীর সঙ্গে লিটন দাস। ক্রিকেটের বাইরে ফুটবল লিটনের প্রিয় খেলা
বাংলাদেশের তারকা ফুটবলার হামজা চৌধুরীর সঙ্গে লিটন দাস। ক্রিকেটের বাইরে ফুটবল লিটনের প্রিয় খেলাছবি: ফেসবুক
প্রথম আলো

ক্রিকেটের বাইরে আপনার প্রিয় খেলা কী?

লিটন: ফুটবল। আগে খুব একটা দেখতাম না। এখন বিশ্বকাপ হলে খেলা দেখার চেষ্টা করি। আমি লিগ–টিগগুলো দেখি না।

প্রথম আলো

বাংলাদেশ দলে ক্রিকেট খেললে তো ভালোই টাকাপয়সা হয়। আপনার কাছে টাকার অর্থ কী?

লিটন: টাকা হচ্ছে আপনার...টাকা তো বলতে গেলে হ্যাপিনেস। টাকা থাকলে আপনি কিছু জিনিস করতে পারবেন। ধরেন, আমার টাকা নেই। আমি চাচ্ছি বউকে একটা জিনিস গিফট করতে। আমি দেব কীভাবে? আমি যদি তাঁকে দিতে না পারি, আমিও খুশি হতে পারব না, সে–ও পারবে না। আমার কাছে মনে হয়, টাকা থাকাটা খুব জরুরি।

প্রথম আলো

অনেক টাকা লাগবে, খুব ধনী হতে হবে—এমন কিছুও কি তাহলে ভাবেন?

লিটন: খুব বড়লোক হতে চাই, তা না। যেটা দিয়ে আমি মোটামুটি চলতে পারব, ভালোভাবে চলতে পারব, আমার বউ–বাচ্চা খুশি থাকবে, এটুকুই।

প্রথম আলো

বউয়ের সঙ্গে পরিচয় কবে, কীভাবে?

লিটন: ২০১৪–এর দিকে মনে হয়...ফেসবুকে দেখে একদিন হাই দিলাম, রিপ্লাই এল। কীভাবে, কী দেখে হাই দিয়েছিলাম, মনে নেই। আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। আর ও তখন ওর হোম ডিস্ট্রিক্ট মাগুরায় থাকত।

২০১৪ সালে দেবশ্রী বিশ্বাস সঞ্চিতার সঙ্গে পরিচয় হয় লিটন দাসের
২০১৪ সালে দেবশ্রী বিশ্বাস সঞ্চিতার সঙ্গে পরিচয় হয় লিটন দাসেরছবি: ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো

বউয়ের সঙ্গে আপনার তুই–তুই সম্পর্ক জেনে মনে হয়েছিল, আপনারা হয়তো ক্লাসমেট বা বন্ধু। সেটি তাহলে ঠিক নয়?

লিটন: না।

প্রথম আলো

তাহলে তুই–তুই হলো কীভাবে?

লিটন: এটাকে বলতে পারেন দিনাজপুরের অভ্যাস। আমরা বন্ধুদের কাউকে তো তুমি করে বলিই না, চাচা–কাকাদেরও তুই করে বলি। এটা খুবই কমন জিনিস। আমার বড় ভাই আছেন, তাঁকে হয়তো বলি—কিরে, তুই কই গেছিলি। যখন ওর (স্ত্রী) সঙ্গে প্রথম প্রথম পরিচয় হলো, দেখাসাক্ষাৎ হলো, কথাবার্তা হচ্ছে, সম্পর্কটা আস্তে আস্তে ফ্রেন্ডশিপের দিকে এগিয়েছিল। ওখান থেকে তুই–তুই, বিয়ের পরও ওখান থেকে আর ব্যাক করিনি। আমি যখন বাড়িতে যাই, আমার বাবা বলে, নিজের ওয়াইফকে তুই করে বলাটা কেমন, তুমি করে বলো। দু–একবার চেষ্টা করেছি বউকে তুমি করে বলার, কিন্তু তাতে সম্পর্কটা দূরের মনে হয়।

প্রথম আলো

কী দেখে মনে হলো, সঞ্চিতাই আপনার জীবনসঙ্গী হওয়ার জন্য উপযুক্ত মানুষ?

লিটন: যখন ওর সঙ্গে পরিচয়,, তখন আমি খুবই মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা ছেলে। ঢাকা শহরে থাকি...আমার বাবা–মা দিনাজপুরে। আমি যেহেতু ক্রিকেটে বেশি ফোকাসড ছিলাম, কখনো এক দিন পর, কখনো দুই দিন পরও বাবা–মাকে ফোন দিতাম। আমার বাবা–মা নিজেরাই ফোন করে বলতেন, তুমি ফোন দাও না কেন। ও সব সময় আমাকে বলত, তুমি ফ্যামিলি ওরিয়েন্টেড হও, মা–বাবার খোঁজ নাও। এটা তোমার দায়িত্ব। ওর এই জিনিসটা আমাকে খুব টাচ করেছে। মনে হয়েছে, কেউ আছে, যে আমার ফ্যামিলি নিয়ে চিন্তা করে।

প্রথম আলো

আপনার প্রিয় খাবার কী?

লিটন: আগে প্রিয় খাবার ছিল হাঁসের মাংস আর খিচুড়ি। ভালো হাঁসের মাংস খেতে গেলে দিনাজপুর যাওয়া লাগে। ওখানে যাওয়া হয় না অনেক দিন হয়ে গেছে।

প্রথম আলো

বউ সবচেয়ে ভালো কী রান্না করে?

লিটন: অনেক কিছু্ই। ইদানীং পোলাও ভালো রান্না করে। যদিও ও খুব কম রান্না করে, এটা ওর মুডের ওপর নির্ভর করে। যদি মন চায় হাজব্যান্ডকে খাওয়াবে বা নিজে খাবে, তাহলেই শুধু করে।

স্ত্রী সঞ্চিতার জন্মদিনে লিটন
স্ত্রী সঞ্চিতার জন্মদিনে লিটনছবি: ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো

বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারের স্ত্রী ফেসবুকে স্বামীকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে অনেক সময়ই আলোচিত হয়েছেন। আপনার স্ত্রী–ও সম্ভবত একসময় এমন দু–একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ফেসবুকে সমালোচনা কি আপনাদের খুব আক্রান্ত করে?

লিটন: এ জন্যই তো বাইরে চলে যাই...(হাসি), এটা মজা করে বললাম। প্রত্যেক মানুষের যখন বয়স হয়, ম্যাচিউরিটি ডেভেলপ করে। এটাই স্বাভাবিক। আমি বললাম না আগেকার লিটন দাস, বিয়ে হওয়ার পর লিটন দাস আর বাচ্চা হওয়ার পর লিটন দাসের মধ্যে অনেক পার্থক্য। ওর ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। আগে হলে এসবে রিঅ্যাক্ট করত, এখন করে না।

সন্তান আসার পর জীবন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা বদলে গেছে লিটনের
সন্তান আসার পর জীবন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা বদলে গেছে লিটনেরছবি: ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো

বাচ্চা হওয়ার পর লিটন দাসের পরিবর্তনটা কোথায় হয়েছে?

লিটন: আগে একটু বেশি আপসেট থাকতাম, জীবন নিয়ে অনেক চিন্তা করতাম, কী করতে হবে, না করতে হবে। আমরা যে কাজ করি (ক্রিকেট খেলা), সেটা তো একটা অফিস—সেখানে দিন কখনো ভালো যাবে, কখনো খারাপ। দিন যখন ভালো যায়, বাচ্চাকে দেখলে আরও ভালো লাগে। দিন যদি খারাপও যায়, বাচ্চাকে দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। আর আগে শুধু চিন্তা ছিল ভালো ক্রিকেট খেলতে হবে। এখনো সেই চিন্তা আছে। তবে ভালো ক্রিকেট খেলতে চাওয়ার সঙ্গে আরেকটি চিন্তাও কাজ করে—বাচ্চাকে যেন একটা ভালো জায়গায় নিতে পারি।